Published : 22 Jun 2025, 06:25 PM
মাত্র আট সপ্তাহ আগে প্রকাশিত একটি মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়েছিল—ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির পথে এগোচ্ছে, এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তারা এমন কিছু করছে না। অথচ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ১৯৯৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অন্তত ১৯ বার দাবি করেছেন—ইরান কয়েক বছরের মধ্যে, কয়েক মাসের মধ্যে, এমনকি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেলবে।
এই অভিযোগের ধাঁচ একেবারে চেনা—যেভাবে ইরাকের বিরুদ্ধে ‘মারাত্মক সমরাস্ত্র’ থাকার অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালিয়েছিল, অথচ শেষ পর্যন্ত সেই সব অস্ত্রের কোনো হদিসই মেলেনি। বহুদিন ধরে একই নাটকীয় প্রক্রিয়া ইরান ঘিরেও অনুসরণ করা হচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত, সেই বহুল আশঙ্কিত হামলা বাস্তবে ঘটল—১৩ জুন। চলছে সেই থেকে। যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত হামলাটি আর সমর্থিত নয়, যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধেও পরিণত হয়েছে। ইরানের তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্রে বোমা হামলা চালিয়েছে মার্কিন বিমান। কয়েক এই হামলার কথা জানিয়েছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো মিউচুয়ালি এশিওর্ড ডেস্ট্রাকশন (এমএডি) বা পারস্পরিক নিশ্চিত ধ্বংসের নীতি। এ নীতি অনুযায়ী, যদি কোনো অঞ্চলে দুই প্রতিপক্ষই পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়, তাহলে তারা একে অপরের জন্য হুমকি হলেও সরাসরি আক্রমণে যায় না—কারণ উভয়ের সমান ধ্বংসের আশঙ্কা থাকে। এই ভয়টাই যুদ্ধকে প্রতিহত করে এবং একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থা বজায় রাখে।
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে এই ভারসাম্যহীনতার সুযোগটিই কাজে লাগাতে চায় ইসরায়েল। যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরির পেছনে তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট: পারমাণবিক অসাম্যকে পুঁজি করে নিজেদের আধিপত্য আরও বিস্তৃত করা এবং ‘পত্তনিকৃত জিও রাষ্ট্র’ হিসেবে প্রভাব বাড়ানো। তবে গোটা ইসরায়েলি জাতি এই যুদ্ধ চায় না—চায় যুদ্ধবাজ জায়নবাদী সরকার এবং ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এ যুদ্ধে তার পাশে দৃশ্যমানভাবে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বলা ভালো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।
ইসরায়েল ও আমেরিকার ভাষ্য অনুযায়ী, ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা শুধু মুখ্য কারণ নয়—মূল লক্ষ্য হলো ইরানে ‘রেজিম চেঞ্জ’, অর্থাৎ ক্ষমতা পরিবর্তন। খামেনির ‘নিঃশর্ত ক্ষমা’ অথবা বিকল্প হিসেবে তার ‘অপসারণ’ বা ‘হত্যা’—এই হলো তাদের চাওয়া।
কিন্তু প্রশ্ন জাগে, তারা কি সত্যিই ইরানের জনগণকে একটি সভ্য ও আলোকিত সমাজ উপহার দিতে চায়? বাস্তবতা হলো, এই পরিকল্পনাকারীদের অনেকেই জানেন না ইরানের প্রকৃত জনসংখ্যা কত, বা কোন ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী, কিংবা ইতিহাস নিয়ে ইরান দাঁড়িয়ে আছে। তাদের আকাঙ্ক্ষা আসলে ভিন্ন—এটা আধিপত্যবাদ, এটি নয়া ঔপনিবেশিকতা।
১৮৯০ সালে তৎকালীন পারস্যের রাজা নাসির আল-দীন দেশের সবচেয়ে লাভজনক খাত—তামাক ব্যবসা—একজন ইংরেজ বণিকের হাতে তুলে দেন। বিনিময়ে তিনি পান এককালীন সামান্য অর্থ ও লাভের মাত্র ২৫ শতাংশ হিস্যা। এতে ওলেমাদের নেতৃত্বে শুরু হয় ‘টোবাকো প্রোটেস্ট’, যা ক্রমেই গণআন্দোলনের রূপ নেয়। এই আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় ১৮৯৬ সালে এক তরুণ বিপ্লবী, মির্জা রেজা কিরমানি, রাজাকে গুলি করে হত্যা করেন।
এই ঘটনার এক দশক পর বিশ্বব্যাপী বাড়তে থাকে তেলের চাহিদা, এবং জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে বিপুল তেলসম্ভার। কিন্তু পারস্যে তখন তেল অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও প্রযুক্তি ছিল না। তাই রাজা মোহাম্মদ আলী শাহ কাজারির আমলে উইলিয়াম ডি’আর্সি নামে এক ব্রিটিশকে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের অধিকার দেওয়া হয়—এককালীন অল্প অর্থ ও লাভের মাত্র ১৬ শতাংশের বিনিময়ে।
ডি’আর্সি অনেক খরচ করে একটি কোম্পানি গঠন করেন—‘অ্যাংলো-পার্সিয়ান অয়েল কোম্পানি’। কিন্তু পরে আর্থিক সমস্যায় পড়ে গেলে ব্রিটিশ সরকার কোম্পানির শেয়ার কিনে নেয় এবং কার্যত মালিকানা গ্রহণ করে। ১৯০৯ সালে যখন ইরানে তেলের সন্ধান মেলে, তখন থেকে ব্রিটেন বিপুলভাবে লাভবান হতে শুরু করে।
তেলের এই বাণিজ্যিক সুবিধা থেকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে—এমন অনুভূতিতে পারস্যে প্রতিবাদ শুরু হয়। ধর্মভিত্তিক মজলিসের সমর্থনে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৯২১ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান রেজা শাহ পাহলভীকে ক্ষমতায় আনে ব্রিটিশরা। রেজা শাহ ব্রিটিশদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার পাশাপাশি দেশটিকে আধুনিকীকরণের জন্য কাজ করতে থাকেন। দেশটির নামটাও বদলে ‘পারস্য’ থেকে ‘ইরান’ রাখেন।
রেজা শাহ পাহলভীর শাসনামলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব বাড়তে থাকে, নারীদের জন্য হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়, নারী শিক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ইসলামপন্থী মজলিসের চাপ থেকে ব্রিটিশরা তাকে রক্ষা করবে ভেবে তেল বাণিজ্যে ব্রিটিশদের লাভের হিস্যা ১৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশে উন্নীত করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরানের তেল ব্যবসায় ব্রিটেনের প্রভাব কমতে থাকে, আর যুক্তরাষ্ট্র হয়ে ওঠে নিয়ামক শক্তি। আমেরিকা ইরানকে বছরে ৫০০ মিলিয়ন ডলার (৬১ হাজার কোটি টাকা) অনুদান দিত, আর বিনিময়ে ইরানের তেল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত।
এই সময়েই জাতীয়তাবাদী নেতা ও মজলিস সদস্য মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের নেতৃত্বে তেল সম্পদ রাষ্ট্রীয়করণের দাবি জোরালো হয়। রেজা শাহ পরিস্থিতি শান্ত করতে তাকে প্রধানমন্ত্রী করেন। মোসাদ্দেক পার্লামেন্টে ভোটাভুটি করিয়ে তেল শিল্প রাষ্ট্রীয়করণ করেন। এর জবাবে ব্রিটেন ও আমেরিকা একসঙ্গে ইরানের ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং বার্ষিক অনুদান বন্ধ করে দেয়।
১৯৫৩ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-সিক্সের যৌথ তৎপরতায় ইরানে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে সরিয়ে পুনরায় রেজা শাহ পাহলভীর হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়। তখন ইরান তেল রপ্তানি করে বছরে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৫ লাখ কোটি টাকা) আয় করত। কিন্তু এই বিপুল আয়ের সুফল সাধারণ জনগণের জীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলছিল না। বরং পাশ্চাত্য-অনুরাগী সংস্কার, আরবি হিজরি বর্ষপঞ্জি বাতিল এবং ইসলামী রীতিনীতির অবমূল্যায়নের ফলে জনঅসন্তোষ বাড়তে থাকে।
এই প্রেক্ষাপটেই ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির উত্থান ঘটে। তিনি রেজা শাহের ধর্মবিরোধী পদক্ষেপের কঠোর সমালোচক হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ইসলামী গণমানস। এর জেরে ১৯৬৪ সালে খোমেনিকে নির্বাসনে পাঠান রেজা শাহ।
ফলে আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক অব্যাহত থাকে। এই সময় যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে ৫ কেজি ৯৩ শতাংশ পরিশোধিত ইউরেনিয়াম এবং ৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পারমাণবিক গবেষণা রিঅ্যাক্টর সরবরাহ করে।
১৯৭৮ সালে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। নির্বাসিত খোমেনির আহ্বানে তেহরানে ৬০ থেকে ৭০ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসে। এই গণআন্দোলনে সেনাবাহিনী গুলি চালায়, বহু মানুষ হতাহত হয়। আন্দোলনের চাপে পড়ে রেজা শাহ ১৯৭৯ সালের শুরুতে ক্যান্সার চিকিৎসার অজুহাতে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।
১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯—আয়াতুল্লাহ খোমেনি দেশে ফিরে আসেন এবং গণভোটের মাধ্যমে ইরানে ইসলামী শাসন কায়েম হয়। তখনই বিক্ষুব্ধ জনতা তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায়, ৫২ জন মার্কিনিকে জিম্মি করে। তাদের মুক্তির শর্ত হিসেবে রাজা রেজা শাহকে ফেরত পাঠানোর দাবি তোলা হয়।
রেজা শাহকে যুক্তরাষ্ট্র ফিরিয়ে না দেওয়া এবং সেই আশ্রয় না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তিনি যুক্তরাজ্য হয়ে মিশরে আশ্রয় নেন—রানী ফারাহ দিবার পারিবারিক সূত্রে। ১৯৮০ সালে রেজা শাহ সেখানেই মারা যান।
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে এরপর শুরু হয় দীর্ঘ শীতলতা ও দ্বন্দ্বের পর্ব। ৫২ জন জিম্মির ইস্যু ঘিরে আমেরিকা একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে থাকে। যদিও ১৯৮১ সালে বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়, কিন্তু নিষেধাজ্ঞার চক্র আর থামে না।
এরপর শুরু হয় রক্তক্ষয়ী পাল্টা হামলার পালা।
১৯৮৩ সালে ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ লেবাননে মার্কিন দূতাবাসে আত্মঘাতী হামলা চালায়, এতে ১৭ জন মার্কিন কর্মকর্তা নিহত হন।
একই বছর, লেবাননে মার্কিন সেনাঘাঁটিতে আরেক হামলায় নিহত হন ২৪১ জন মার্কিন সেনা।
১৯৮৮ সালে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমানে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করলে বিমানে থাকা ২৯০ জন যাত্রীর সবাই নিহত হন। বলা হয়ে থাকে এটি ঘটেছিল ভুলবশত।
১৯৯০-এর দশকে এই উত্তেজনার রেশ আরও বাড়তে থাকে। ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে আরেক দফা কঠোর বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যার ফলে দেশটি ক্রমেই আন্তর্জাতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
৭৫ বছর আগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগেই ইরানে পারমাণবিক শক্তির গবেষণা ও উন্নয়নের সূচনা ঘটেছিল। অথচ সেই মার্কিনিরাই ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইরানকে একটি পরমাণু সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি নেতৃত্বাধীন জোটের আরোপিত কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় কোণঠাসা হয়ে ইরান আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার তত্ত্বাবধানে পরমাণু কর্মসূচি সীমিত রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়।
যদিও তেহরান বারবারই জানিয়ে এসেছে—তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সামরিক নয়, শান্তিপূর্ণ চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যেই এগোচ্ছে।
তবে ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন একতরফাভাবে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ তুলে ওই সমঝোতা থেকে বেরিয়ে আসে। বাইডেন প্রশাসন চুক্তি পুনরুজ্জীবনের কিছু উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়।
২০২৫ সালে ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় ফিরে এসে চুক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। ইতিবাচক আলোচনা চলতে থাকলেও আচমকা যুক্তরাষ্ট্রের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানানো হয়, ইরান কোনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কার্যক্রম চালাচ্ছে না। এই প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আনার মাধ্যমে ইরানকে কূটনৈতিকভাবে অপ্রস্তুত করেই ২০২৫ সালের ১৩ জুন হামলা চালায় ইসরায়েল।
এদিকে, স্বীকৃত তথ্য অনুযায়ী, পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য ইউরেনিয়ামকে ৯০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ করতে হয়। ইরান এরই মধ্যে ৬০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি মাত্রায় সমৃদ্ধ করেছে তাদের ইউরেনিয়াম মজুদ। যদি তারা পূর্ণমাত্রায় সমৃদ্ধকরণে পৌঁছে যায়, তবে তাদের বিদ্যমান ইউরেনিয়াম মজুদ দিয়ে অন্তত ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব—এমন আশঙ্কা এখন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মধ্যেও।
সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলার আগে গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানের ভেতরে থেকে এমন নিখুঁত প্রস্তুতি নিয়েছিল যে, ইরানের শীর্ষ সেনা ও গবেষণা ব্যক্তিরা পর্যন্ত নিজ নিজ শোবার ঘরে নির্ভুল নিশানায় নিহত হয়েছেন। মোসাদের গুপ্তচরদের মাধ্যমে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অচল করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে বিমান হামলা নির্বিঘ্নে চালানো সম্ভব হয়।
এমনই এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা হলো—ক্যাথেরিন পেরেজ শকদম নামে এক ফরাসি তরুণীর ইসলাম গ্রহণ। শিয়াপন্থী মুসলিম বলে নিজের পরিচয় দেওয়া এই লেখক, সাংবাদিক ও গবেষক হিসেবে ইরানে প্রবেশ করেন তিনি। তিনি এতটাই ইসলামী বিপ্লবপন্থী ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন যে, তার লেখা আয়াতুল্লাহর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে পর্যন্ত প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল। রেভুলেশনারি গার্ড, রাজনীতিবিদ এমনকি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সঙ্গেও তার সাক্ষাৎ এবং গবেষণার নাম করে রাষ্ট্রের বহু সংবেদনশীল দপ্তরে যাতায়াত ছিল। তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের স্ত্রীর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
পরে জানা যায়, এই পেরেজ শকদম ছিলেন মোসাদের একজন শীর্ষ গুপ্তচর। একইভাবে, ইরানের বন্দর পরিচালনার কাজে যুক্ত কিছু বিদেশিও মোসাদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন বলে বলা হচ্ছে।
ইসরায়েলি হামলার প্রথম দিনে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করার পর, ইরানে মোসাদ সদস্যদের অবস্থান ও সরঞ্জামের কিছু অংশ চিহ্নিত করে ধরপাকড় চালানো সম্ভব হয়। কিন্তু শকদম এর অনেক আগেই নিরাপদে ইরান ছেড়ে যেতে সক্ষম হন।
এবারের ইসরায়েলি হামলায় আমেরিকার সম্মতি ছিল—এ কথা এখন আর গোপন নয়। ইরানকে কথিত আলোচনার টেবিলে আনার নামে যুক্তরাষ্ট্র একদিকে ‘শান্তি উদ্যোগ’ দেখালেও, অন্যদিকে এই হামলার পুরো সামরিক সক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত ভিত তৈরি করে দিয়েছে। ইসরায়েল হামলা চালালেও, ক্ষেপণাস্ত্র থেকে বিমান—সবই ছিল মূলত মার্কিন সামরিক সহায়তার অংশ।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্য মিত্রদের তুলনায় ইসরায়েলকে বরাবরই অধিকতর উন্নত ও বিধ্বংসী সমরাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই সক্ষমতা দিয়েই ১৩ জুনের হামলা পরিচালিত হয়। তবে, পরবর্তী আরেক দফা হামলার আগেই ইরান আশ্চর্যজনকভাবে তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুনরায় সচল করতে সক্ষম হয়।
বিশ্ব কূটনৈতিক ও সামরিক মহলে প্রচার রয়েছে ইরান দ্রুত প্রতিরক্ষা সক্ষমতা পুনর্গঠনে বাইরের শক্তিশালী দুটি দেশের সহায়তা পেয়েছে। ১৩ জুনের আকস্মিক ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের মৃত্যুর পর মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইরান পাল্টা মিসাইল ও ড্রোন হামলা চালায়, কিভাবে চালিয়েছে, সেটা রহস্য হয়ে আছে। মজুদকৃত বিপুল সংখ্যক মিসাইল থাকা সত্ত্বেও ইরান প্রথম দফায় অত্যন্ত কৌশলী ও সীমিত প্রতিহিংসামূলক হামলা চালিয়েছে। আসল মিসাইলের সঙ্গে নকল মিসাইলও পাঠানো হয়, যাতে ইসরায়েলের বহুল প্রচারিত আয়রন ডোম, অ্যারো থ্রি ও থাড প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিভ্রান্ত হয় এবং ইরানের প্রকৃত আঘাতগুলো সফল হয়।
ফলে হামাস, হিজবুল্লাহ বা হুতি বিদ্রোহীদের সাধারণ প্রযুক্তির রকেট ঠেকিয়ে আত্মবিশ্বাসী থাকা ইসরায়েল প্রথমবারের মতো ব্যর্থতায় বিপর্যস্ত হয়। এক বিশ্লেষকের মতে, মাত্র ২২ হাজার বর্গকিলোমিটারের ইসরায়েলে যদি প্রতিদিন এই হারে মিসাইল ছোড়া হয়, তবে ইরান তা টানা ছয় মাস এমনকি এক বছরের বেশি সময় চালিয়ে যেতে সক্ষম।
ইরান ইতোমধ্যে ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনাগুলোতে সফল হামলা চালিয়েছে—এর মধ্যে আছে তেল শোধনাগার, স্টক এক্সচেঞ্জ, ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউট, মাইক্রোসফট ইসরায়েল গবেষণা কেন্দ্র এবং মোসাদের সদর দফতর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের ব্যবহার করা খোররামশাহর মাল্টি-ওয়ারহেড ব্যালিস্টিক মিসাইল—যা একসঙ্গে ৮০টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম—এমন প্রযুক্তিতে ইসরায়েল হতবাক। ১০টি এমন মিসাইলের মাধ্যমে ৮০০ স্থানে একযোগে হামলা করা সম্ভব। দীর্ঘকাল একঘরে ইরানের সকল সমরাস্ত্র নিজেদের তৈরি হলেও এরকম কিছু সমরাস্ত্র অন্য কোনো না কোনো পরাশক্তির কাছ থেকে পাওয়া বলেই বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা।
মোসাদ দফতরে হামলার সময় ইসরায়েল এতটাই বিভ্রান্ত হয় যে তারা প্রথমে বুঝতেই পারেনি হামলা কোন দিক থেকে হয়েছে। ইতোমধ্যে তেল-আবিবসহ গোটা ইসরায়েলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইসরায়েলের ছয় বিলিয়ন ডলারের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ইন্টারসেপশন মিসাইল মজুত আর মাত্র ১০–১২ দিনে ফুরিয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে সরকার নাগরিকদের ক্ষয়ক্ষতির ছবি তোলা বা ভিডিও করায় ২০–৩০ মাসের কারাদণ্ডের হুমকি দিচ্ছে। তবুও তথ্য চেপে রাখা যাচ্ছে না।
এর মধ্যে ইসরায়েলি নাগরিকদের অনেকেই দেশ ছাড়ার চেষ্টা করলে, সরকার সে পথও রুদ্ধ করছে। ফলত, গোপনে পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে দেশত্যাগের চেষ্টা করছে সাধারণ মানুষ। গাজার ধ্বংসস্তূপের বিপরীতে এবার ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে ‘অভেদ্য দুর্গ’ হিসেবে পরিচিত ইসরায়েল নিজেই। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, আগামী দুই সপ্তাহে পুরো ইসরায়েল এক ভয়াবহ মানবিক ও কূটনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। বলা চলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে।
এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জি-সেভেন সামিট থেকে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে সামরিক নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করলেও প্রথমে বললেন—তিনি ইরানে হামলা করবেন কি না, তা নিজেও এখনো নিশ্চিত নন। আবার পরে জানিয়েছেন, আলোচনা ও কূটনীতির মাধ্যমেও সমাধানের পথ খোঁজা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, সিদ্ধান্ত নিতে দুই সপ্তাহ সময় নেবেন। শেষ পর্যন্ত দুই সপ্তাহ সময নেননি ট্রাম্প।
ইরান এর আগেই ইসরায়েলের বেশ কয়েকটি মূল্যবান মার্কিন যুদ্ধবিমান—এমনকি অত্যাধুনিক এফ-৩৫ পর্যন্ত ভূপাতিত করেছে। তবু ব্যাপারটা এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে যে, ইসরায়েল যদি জিততে চায়, তাহলে তাকে পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করতে হবে। অন্যথায়, ইরানের বাকি পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানতে হবে অথবা সেগুলোর সুরক্ষায় থাকা আয়াতুল্লাহদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে এই যুদ্ধে জয়ের পথ খুঁজতে হবে। আর সেটি করতে হলে ব্যবহার করতে হবে মার্কিন বি-২ বোমারু বিমান থেকে ফেলা জিবিইউ-৫৭ বাঙ্কার ব্লাস্টার বোমা—যা ইসরায়েলের কাছে নেই। ফলে এমন পরিস্থিতিতেই যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে হলো। তাও আবার ফোর্দোর মতো ভূগর্ভস্থ, সুরক্ষিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করতে একই স্থানে অন্তত দু’বার বাঙ্কার ব্লাস্টার ফেলতে হবে—তবেই তা কার্যকর হবে। যুক্তরাষ্ট্র যে সেই পথেই এগোচ্ছে তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।
রাশিয়া ও চীন বারবার সতর্ক করে দিচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্র যেন এই যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত না হয়। রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইরানে ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা শাসন পরিবর্তনের মতো স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা করা অনুচিত। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে প্রায় পুরো অঞ্চল কব্জায় রাখা দেশটিও বলছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি দেবে না।
এর মধ্যেই জি-৭ সামিট থেকে ফিরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলে ৩০টি জেট পাঠিয়েছে এবং ভারতের অনেক দক্ষিণে, ইরান থেকে ৫,২৬৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটি দিয়েগো গার্সিয়ায় পাঠিয়েছে ৬টি বাঙ্কার ব্লাস্টার বহনকারী বি-২ বোমারু বিমান। যদিও বি-২ একবার জ্বালানি নিয়ে প্রায় ১১,৫০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে, তবুও বিমান থেকে বিমানে জ্বালানি সরবরাহকারী রিফুয়েলিং এয়ারক্রাফটও পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
একইসঙ্গে, মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে সেনাসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার বাড়ালেও সেখান থেকে অন্তত ২৯টি যুদ্ধবিমান ইউরোপে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিপরীতে, ইউক্রেইনকে ঘিরে সাম্প্রতিক হামলা ও জরুরি পরিস্থিতিতে রাশিয়া আপাতত সতর্কবাণী দিয়েই সীমাবদ্ধ রয়েছে, তবে পরিস্থিতি ঘনীভূত হলে তারা সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে। পাশাপাশি অন্যান্য পারমাণবিক শক্তিগুলোর প্রতিক্রিয়া সামাল দেওয়ার প্রস্তুতিও তারা নিচ্ছে।
ইতিপূর্বে অকেজো করে দেওয়া কারিশ ও লাটভিয়ান গ্যাসফিল্ড এবং হাইফায় হামলার পর ইরান এবার দুই টন বোমা ফেলেছে হাইফায় ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয়ের দফতরে। হাইফার তেল শোধনাগার সম্পূর্ণভাবে অকেজো করে দেওয়ার ফলে ইসরায়েলকে এখন বিদ্যুৎ ও সামরিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখতে সমস্ত জ্বালানি আমদানি করতে হচ্ছে। শুধু ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স ধ্বংসে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৭২ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ প্রায় ৮২০০ কোটি টাকা।
একদিকে যখন ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক—যেখানে প্রশ্ন উঠছে, ইরানের মতো দীর্ঘদিন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা একটি দেশের নিজস্ব সমরাস্ত্র কীভাবে মার্কিন উন্নত প্রযুক্তি ও সামরিক সক্ষমতাকে মোকাবেলা করে ইসরায়েলকে এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে ফেলে দিল।
এছাড়া, মার্কিন হুমকিকে ভয় না পেয়ে ইরান যে আরও তীব্র আক্রমণে এগিয়েছে, তা এক গুরুতর কূটনৈতিক ও সামরিক পটপরিবর্তন—যা গভীর চিন্তার বিষয়। দিন শেষে জানা গেছে, ইরানের শাসনব্যবস্থাকে অচল করে রেজা শাহ পাহলভীর পুত্রকে ক্ষমতায় বসানোর যে পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্র করছিল, সেই প্রেক্ষাপটে খামেনি নিজেই তার সমস্ত ক্ষমতা বিপ্লবী গার্ডের সুপ্রিম হাউসের কাছে হস্তান্তর করেছেন।
এর মানে, সামরিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে পরিস্থিতি এখন আরও নাজুক ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে—মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ছায়ারাষ্ট্র ইসরায়েল এবং স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও। এই পরিবর্তনের ফলে সমঝোতা ও আলোচনার পথ হয়েছে আরও কণ্টকিত। একইসঙ্গে ইরান তার রাষ্ট্রীয় কাঠামো সচল রাখার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নিয়েছে, ফলে পূর্বের রাজতন্ত্র ফিরে আসার সম্ভাবনাও অনেকটাই কঠিন হয়ে গেল।
আট দিনের এই যুদ্ধে যদি ইসরায়েলের পক্ষের ২০০ জন মারা গিয়ে থাকে, তবে ইরানের মৃত্যুসংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। একইভাবে স্থাপনা ও অর্থনৈতিক ক্ষতির দিক থেকেও ইরান হয়তো পাঁচগুণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে—ভৌগোলিক ও জনসংখ্যাগত দিক থেকে ইসরায়েলের তুলনায় ইরান প্রায় ৭৪ হাজার গুণ বড়। ফলে ইরান যদি এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ১০ থেকে ১২ বছর সময় নেয়, তার আগেই ইরানে মজুদ থাকা বিপুল সমরাস্ত্রের আঘাতে ইসরায়েল সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে।
এমন বাস্তবতায় পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়া ইসরায়েলের উদ্ধারের কোনো বাস্তবসম্মত পথ নেই—আবার সেই অস্ত্র ব্যবহারেরও সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। কারণ, একবার তা ব্যবহৃত হলে, নিঃসন্দেহে এই মধ্যপ্রাচ্য সংকট রূপ নেবে ভয়াবহ এক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে—যার পরিণতি হবে বৈশ্বিক ধ্বংসযজ্ঞ।
এই প্রেক্ষাপটে যেকোনো মুহূর্তে দুটি বড় প্রশ্ন সামনে আসতে পারে: ১. অন্যের ভাণ্ডার লুটে গড়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কি তবে তার অন্তিম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে? ২. ব্রিটিশ চক্রান্ত ও জাতিপুঞ্জের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা দখলদার রাষ্ট্র ইসরায়েল যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তাহলে বাস্তুচ্যুত ইহুদিদের আশ্রয় দেবে কি সেই পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো, যারা এতদিন ধরে তাদের জন্য মায়াকান্না করেছিল?
ধর্মভিত্তিক শাসনব্যবস্থার মোড়কে পশ্চাৎপদ নারী নিগ্রহের নিরন্তর নজির রাখা ইরানকে আলোর পথে—সভ্যতার উত্তরণে এগিয়ে দেবার কোনো মহৎ উদ্দেশ্য না থাকলেও আমেরিকা ও ইসরায়েলের ধারণা ছিল এসব কারণে ফুসতে থাকা ইরানের জনগণ এই হামলায় আরও বিভক্ত হবে, ইরানের শাসনব্যবস্থা পাল্টাতে চাওয়ার মার্কিন খায়েশ মিটাতে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে ঠিক উল্টোটা। ট্রাম্প হয়তো যুদ্ধবাজ নয় বলে এমন পরিস্থিতিতে সময় নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারছেন না। কিংবা কোনো সুনির্দিষ্ট হামলা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য সময় নিচ্ছেন। প্রশ্ন সবার, সেক্ষেত্রে এই সময়টা কি আসলেই দুই সপ্তাহ নাকি আরো কম বা বেশি? ততদিনে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এই যুদ্ধের পরিণতি?
এতসব ধ্বংসাত্মক ঘটনাবলির পরও আশার আলো দেখা যাচ্ছে দুটি প্রসঙ্গে।
১. চীনের জাতিসংঘ প্রতিনিধি মন্তব্য করেছেন—ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলি হামলা একটি নজিরবিহীন ঘটনা, যা ভয়াবহ পরিণতির আশঙ্কা তৈরি করেছে। এই হামলা বিশ্বের সামনে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর জন্যও নিজেদের পারমাণবিক মজুদ থেকে সম্ভাব্য বিপর্যয়ের এক নতুন আঙ্গিক জোরালোভাবে দৃশ্যমান করে তুলেছে, যা গোটা মানবজাতিকে নতুন করে উদ্বিগ্ন করছে।
২. ইরান পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনায় বসার প্রস্তাব পুরোপুরি বাতিল করেনি—যদি ইসরায়েল তাদের আগ্রাসী যুদ্ধনীতিকে থামিয়ে শান্তিপূর্ণ আলোচনার টেবিলে ফিরতে রাজি হয়, তাহলে ইরান আলোচনায় বসবে বলে জানিয়ে রেখেছিল।
অবশ্য যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় ইরান আপাত আলোচনার পথ পরিহার করতে পারে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, ‘কূটনীতির দরজা সবসময় খোলা থাকা উচিত, কিন্তু এখন তা সম্ভব নয়।’ ওআইসির এক সভায় যোগ দিতে তুরস্কের ইস্তানবুলে অবস্থান করছেন তিনি। সেখান থেকেই ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমার দেশ এখন আক্রমণ, আগ্রাসনের মুখে রয়েছে এবং আত্মরক্ষার বৈধ অধিকার অনুযায়ী জবাব দিতে হবে।’ আব্বাস আরাগচি ইস্তানবুল থেকে মস্কো যাচ্ছেন।