Published : 09 Jun 2025, 09:41 AM
বর্তমানে উপভোগকৃত অপার ক্ষমতার মানদণ্ড, মনন ও আবেগ দিয়ে ইতিহাসের বিচার হয় না। ইতিহাসের বিচার হতে হয় একাডেমিকভাবে নির্মোহ ও সমালোচনামূলক (ক্রিটিক্যাল) পাঠের মাধ্যমে। কিন্তু, বাংলাদেশে সেই আশা সম্ভবত গুড়েবালি!
প্রায় ৫৫ বছরের ইতিহাসে স্বাধীন বাংলাদেশকে নানান উত্থান-পতন, চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিতে হয়েছে, হচ্ছে। এই ইতিহাসের মহিমান্বিত ও মহত্তম ঘটনার নাম ‘মুক্তিযুদ্ধ’। এবং তর্কযোগ্যভাবে, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত কিংবা অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো এই মহৎ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই। যার পালে তুমুল হাওয়া দিয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানোত্তর সময় এবং তা একটার পর একটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে চলছে তো চলছেই।
সর্বশেষ যুক্ত হলো মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায়নের প্রশ্নটি। এ বিষয়ে গত ৩ জুন মধ্যরাতে এক অধ্যাদেশ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার পুরো বাংলাদেশকে বিতর্কের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে আরেকবার। ২০১৮ ও ২০২২ সালের সংজ্ঞায়ন পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল’ (জামুকা) সংক্রান্ত এ অধ্যাদেশ যে বিতর্কের সৃষ্টি করল, তার পানি কোথায় গিয়ে গড়াবে, সেটির বিচারও সম্ভবত ভবিষ্যতের হাতেই তুলে দিল সরকার। তাও কোনো ধরনের জনমত যাচাই না করেই।
অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে অনেক কাজ। সংস্কারগুলো রীতিমতো ঝুলে যাচ্ছে। বিচারও তাই। নির্বাচনের সময় নিয়ে ঐকমত্য নেই। এত কিছু ছাপিয়ে, বলা যেতে পারে, স্বেচ্ছায় অন্তর্বর্তী সরকার আরেকটি বিতর্ককে, তাও আবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, রীতিমতো গাছে তুলে দিল। আমাদের এই বিতর্কের শানে-নজুল বোঝাপড়া করে দেখার তাই ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতার খাতিরেই একান্ত প্রয়োজন আছে।
কে মুক্তিযোদ্ধা? কিংবা কে মুক্তিযোদ্ধা নয়?
মুক্তিযুদ্ধ একটা জনযুদ্ধ। এর চরিত্রও তা-ই। কিন্তু, শাসকেরা বারবার সেই চরিত্রটিকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায়নের প্রকল্পটিও ঠিক তা-ই।
এতদিন আমরা জেনেছি, মুক্তিযুদ্ধের ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’ দাঁড় করাতে না পারায় মুক্তিযুদ্ধ দলীয়করণের খাঁচায় বন্দি ছিল কিংবা ভাইস-ভার্সা এবং তা নিয়ে অনন্ত বিতর্কের জন্ম হওয়ায় আমরা কোনো মীমাংসায় আজও পৌঁছাতে পারিনি।
কিন্তু, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায়ন নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বিতর্ক ছিল না। বিতর্কটা মূলত খেতাব পাওয়া না-পাওয়াদের শ্রেণিকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই শ্রেণিকরণটি যে খোদ মুক্তিযুদ্ধকেও বিভাজিত করেছে, সেটিও অনেকে বলেন। তবে, মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে, কূটনৈতিক পর্যায়ে ও দেশ-বিদেশে যারা ভূমিকা পালন করেছিলেন, তারা সকলেই অলিখিতভাবেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন এতদিন। যদিও পরে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যুক্ত হয়েছেন অনেকেই, কিন্তু অনেকটা নির্বিবাদেই হয়েছেন, কেননা একাত্তরে তাদের বাংলাদেশপন্থী ভূমিকা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ছিল না।
আবার, এ কথাও সত্য, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত বিষয়ে যে পরিমাণ রাজনৈতিক ও ‘আদর্শিক’ বাণিজ্য বাংলাদেশে বিগত সময়ে হয়েছে, তা মুক্তিযুদ্ধের উচ্চতা এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মমর্যাদার জন্য যারপরনাই অপদস্থমূলক ছিল। বিশেষ করে, ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ নামক প্রপঞ্চটি যেভাবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তা রাজনৈতিক সরকারের চরম ব্যর্থতা ও অবাধ দুর্নীতির প্রশ্রয়সহ মুক্তিযুদ্ধের প্রতিও এক অভূতপূর্ব অবমাননা।
যে কারণে, এ বিতর্ক হওয়া আজও স্বাভাবিক যে, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায়নও একাত্তরের আরেকটি অমীমাংসিত প্রশ্ন কি না? নিঃসন্দেহে এই বিতর্ক হওয়া প্রয়োজন এবং এর ফয়সালাও হওয়া প্রয়োজন।
অবশ্য তার মানে এই নয় যে, বর্তমানের জনপ্রিয় রাজনৈতিক বয়ানের জোরজবরদস্তিতে এবং সেই বয়ানদাতাদের প্রতি দুর্বলতা স্বরূপ (বায়াসড হয়ে) রাষ্ট্র ইতিহাসের পুনর্বিচার ও পুনর্নিমাণ করতে আইন করবে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেবে। ইতিহাসের পুনর্পাঠ তো অবশ্যই জরুরি। কিন্তু, সেটা নির্মোহ, বিদ্যায়তনিক (একাডেমিক) ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা আবশ্যক।
সেই চর্চার অংশ হিসেবেই কি অন্তর্বর্তী সরকার মুক্তিযোদ্ধার প্রশ্নবিদ্ধ তালিকাকে ত্রুটিমুক্ত করতে চেয়েছে? করতে চাইলে তা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে এ সরকারের অবস্থান ইতিমধ্যেই প্রচণ্ড নড়বড়ে হয়ে গেছে। ঘটনা পরম্পরায় দক্ষিণপন্থা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির ভক্তিকারক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তারা।
যদিও এই সংশোধিত অধ্যাদেশ এমনভাবে লেখা যেখানে দাবি করা কঠিন যে, সরকার দক্ষিণপন্থীদের খুশি করতে খুব একটা মশগুল হয়েছে। বরং, যাদেরকে মুক্তিযুদ্ধকালীন দানবীয় নৃশংসতার জন্য দায়ী করা উচিত, আগের আইনের ধারাবাহিকতায় এই অধ্যাদেশে সেই প্রতিটি শক্তির নাম পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে, খেলা ড্র! তাই কি?
নিঃসন্দেহে, এরা মুক্তিযোদ্ধা নয়, যুদ্ধাপরাধীই। তাহলে, যারা যুদ্ধাপরাধী নয়, তারা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা? কিন্তু, ঔপনিবেশিকতার ঔরসজাত আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান সে কথা বলবে না। তার চাই সমস্ত আইনি জটিলতা। যেটাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু আগেই (সভ্যতার সংকট, ১৯৪১) বলেছেন, ‘সম্পূর্ণ বাইরের জিনিস, যা দারোয়ানি মাত্র।’ এই দারোয়ানিতে রাষ্ট্র ও সরকার খুব সিদ্ধহস্ত। কিন্তু, প্রত্যন্ত গ্রামের যে মানুষ রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, কেউ কেউ হত্যার শিকার হয়েছিলেন কিংবা জানেনও না রাষ্ট্র কী করছে, তাদের অবদানকে আমরা সংজ্ঞা দিয়ে মাপতে যাই কী করে?
জনযুদ্ধে যোদ্ধা-ভেদ হয়?
যদি আইনের জোরে সংজ্ঞা বদলে না ফেলা হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ একটা স্বীকৃত জনযুদ্ধ। বিশ্বযুদ্ধদ্বয়ের মতো এর বৈশিষ্ট্য নয়, যেখানে শুধু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তাদের সশস্ত্র বাহিনীর দ্বারা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধে পুরো জনপদ রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছিল এবং সমস্ত জনগণ নানা প্রক্রিয়ায় এতে সম্পৃক্ত হয়েছিল। এমনকি যুদ্ধ বিধ্বস্তরাও মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠেন এসব ক্ষেত্রে। ফলে, মুক্তিযুদ্ধকে যদি আমরা জনযুদ্ধ বলি, তাহলে সেই যুদ্ধকে শুধু চিহ্নিত রণাঙ্গনে সীমাবদ্ধ করার সুযোগ থাকে না।
জনযুদ্ধের জন্য একটা রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও প্রয়োজন হয়। আমাদের সেটাও ছিল। এছাড়া, যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই কূটনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে ও সাংস্কৃতিকভাবেও লড়তে হয়— বাংলাদেশ সেটা পেরেছিল সেই সময়ে বিভিন্ন ফ্রন্টে সংগ্রামরত মানুষদের অসীম অবদানের কারণেই। একটা ঝঞ্ঝাহীন সময়ে বসে আমরা সেই স্ট্রাগলকে শুধু কল্পনাই করতে পারি। কিন্তু, কলমের খোঁচায় সেই অগ্নিগর্ভ সময়ের স্ট্রাগলের সংজ্ঞাকে পরিবর্তন করাটা খুব কাণ্ডজ্ঞান প্রসূত হয় না।
আদতে এমন একটা জনযুদ্ধকে আমরা জটিল আমলাতান্ত্রিকতার যূপকাষ্ঠে ঢুকিয়ে দিয়েছি বলেই, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভও দাঁড়ায় না, আমাদের মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায়নও ঠিকঠাক হয় না। যে কারণে আমরা যোদ্ধায়-যোদ্ধায় শ্রেণিভেদ করে ফেলেছি, কে রণাঙ্গনে ছিলেন, কে ছিলেন না, সেই ভেদ করে খোদ মুক্তিযুদ্ধকেই জটিল বানিয়ে ফেলেছি।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই জটিলতা সেই ১৯৭২ সাল থেকেই চলে আসছে! ২০২৫ সালের জামুকা অধ্যাদেশ বরং জটিলতা আরও বাড়াল, এবং সেটাও বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যেই। মুক্তিযুদ্ধকে (অপ্রাতিষ্ঠানিক) জনযুদ্ধ হিসেবে মান্য করেই আমরা এই প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতার কলাকৌশল সন্ধানের চেষ্টা করব।
এই অধ্যাদেশও কি সংস্কারেরই অংশ?
গণঅভ্যুত্থানের পর নানারকম সংস্কার নিয়ে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। বলা বাহুল্য, সংস্কার ও আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে একটা দোটানাও শুরু হয়েছে বিগত কয়েক মাসে। অল্প সংস্কার চাইলে ডিসেম্বরে নির্বাচন এবং পূর্ণ সংস্কার চাইলে আগামী বছরের জুনে নির্বাচন—এমন একটি মত আগেই দিয়ে রেখেছিলেন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং সেই মত তিনি শুধু দেশই না, বিশ্ববাজারেও ফেরি করেছেন।
গত ৬ জুন, ঈদের আগের দিন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে অবশ্য তিনি বলেছেন, এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন হবে। বোঝা যাচ্ছে, ‘পূর্ণ সংস্কার’ বিষয়ে সরকার এখনও আশাবাদী। সেই সংস্কারের সবচেয়ে বড় প্রাণভোমরা হলো মুক্তিযুদ্ধ ও বাহাত্তরের সংবিধান। এই প্রকল্পের সংস্কারটি শেষতক কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটি দেখার জন্য মানুষ উদগ্রীব হয়ে আছে।
সর্বশেষ জামুকা সংক্রান্ত অধ্যাদেশের মাধ্যমে সরকার মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণের যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সেটিকে কি এই সংস্কারেরই একটি খণ্ডচিত্র বলা যেতে পারে? কিছু ক্ষেত্রে বলা তো যায়ই।
মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, সেখানে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’কে মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। সংবিধান সংস্কার কমিশন স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রকে সূত্ররূপে ব্যবহার করে বাহাত্তরের সংবিধানের ‘গণতন্ত্র’ বাদে বাকি তিনটি মূলনীতি ‘সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ’কে বাতিল করার প্রস্তাব দিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য হিসেবে এই ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ প্রপঞ্চ তিনটিকে সামনে রেখে প্রস্তাব হাজির করেছে।
বিতর্ক উসকে দেওয়া এই অধ্যাদেশেও সংবিধান সংস্কার কমিশনের বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটেছে, যেখানে ‘মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য’ শীর্ষক উপধারা ২(১৪)-তে এই তিনটি প্রপঞ্চকে যুক্ত করা হয়েছে। ২০২২ সালের জামুকা আইনে (১৫ নং আইন) ‘মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য’ শিরোনামে কোনো উপধারা ছিল না, এবার তা প্রথমবারের মতো যুক্ত হয়েছে। আরও উল্লেখ্য যে, আগের আইনের প্রস্তাবনায় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে’র কথা উল্লেখ থাকলেও, সেটি উঠিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়ন’ আর্টিকুলেট করা হয়েছে।
উদ্দেশ্য যাই হোক, এ পর্যায়ে আপাতত এটুকু উপসংহার টানা যায় যে, সংবিধান সংস্কার কমিশনের চিন্তাভাবনার প্রতিফলন এই অধ্যাদেশের কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই আছে, যা উপর্যুক্ত উদাহরণ থেকে পরিষ্কার। কিন্তু এছাড়া আর কী আছে? যা আছে সেটাই সমস্যাকে ঘনীভূত করেছে।
প্রবাসী সরকারের ভূমিকা লঘু করতে হবে?
মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের আদর্শের বহিঃপ্রকাশ যে সংবিধান, সেটিকে সংবিধান সংস্কার কমিশন খারিজ করতে চেয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে শেখ মুজিব-সৈয়দ নজরুল ইসলাম-তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন মুক্তযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রথম সরকারকে ‘রাজনৈতিক মতাদর্শিক’ অবস্থান থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা সমানুপাতিক ধরে নিতে চেয়েছে। যা প্রবাসী সরকারের মহাকায় ভূমিকাকে লঘু করার সামিল।
বস্তুত, প্রবাসী সরকার তথা মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ও অবদানের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসের আর কোনো সরকারেরই তুলনা করা চলে না, তা তাদের মধ্যে যত মতাদর্শিক নৈকট্যই থাকুক না কেন। এবং অতি অনিবার্যভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান কোনোভাবেই তার কন্যার ভূমিকা দ্বারা বিচার্য হতে পারে না।
স্বাধীনতা-উত্তর শেখ মুজিবকে তার ভূমিকার জন্য অবশ্যই সমালোচনা করতে হবে, কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের ২৪ বছরে যে শেখ মুজিব লড়েছেন, তিনি অবশ্যই অতিকায় ও হিমালয়সম। তার তুল্য কেউই হবেন না বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে।
সরকার কী চায়?
আমাদের সামগ্রিক স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং তাতে শেখ মুজিবের অবদান বিচারের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার, তার সংস্কার কমিশন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো নির্মোহ ও ক্রিটিক্যাল থাকতে না পারার কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও জনগণের ‘পারসেপশন বা বিমূর্ত কল্পনা’ এবং ‘এন্টিসিপেশন বা পূর্বানুমান’ এমন জায়গায় চলে গেছে যে, মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে এই সরকারের যে কোনো উদ্যোগকে সন্দেহ করার যুক্তিসঙ্গত কারণ অনিবার্যভাবেই তৈরি হয়েছে।
‘গিলতেও পারছি না, ফেলতেও পারছি না’—এমন দ্ব্যর্থবোধক রাজনৈতিক অবস্থান অন্তত মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে কাম্য না হলেও, এই সরকারের নানা অংশীজনের ভূমিকায় সেটি বিভিন্ন সময়েই প্রতীয়মান হয়েছে। গণমাধ্যমও সম্ভবত সেই পূর্বানুমানের ধারায় চালিত হয়েছে!
প্রশ্ন হতে পারে, আওয়ামী লীগ যে সংজ্ঞায়নের এত পরিবর্তন করল, তখন এসব আলোচনা হয়নি কেন? এর চেয়ে সহজ উত্তর হয় না। মুক্তিযুদ্ধকে বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে বাণিজ্যিকীকরণ, দলীয়করণ ও চর্বিতচর্বণের পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তাতে তারা মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে কী করল না করল, তা দেখার আগ্রহই তো মানুষের ছিল না।
এখন দেখার প্রয়োজন হচ্ছে দুটি কারণে, এক. আওয়ামী লীগ ভালো-মন্দ কী করেছিল, তা বোঝা। আর দুই, সেই ভালো-মন্দের পিঠে বর্তমান সরকার কী নতুনত্ব আনতে চাইছে, তা বোঝা। মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে সরকারের অবস্থান আসলেই কেমন? কী চায় তারা? এর উত্তর আমরা খুঁজব পরবর্তী পর্বে। (চলবে)