Published : 24 Aug 2024, 07:05 PM
ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে কুমিল্লায় গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে তলিয়ে বুড়িচং উপজেলা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট না থাকায় পরিবারের সদস্যদের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না স্বজনরা। রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে ও ভেঙে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠেছে।
এ অবস্থায় পানিবন্দিদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মীসহ সমাজিক সংগঠনগুলো কাজ করছেন। শনিবার বুড়িচংয়ের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এ দৃশ্য দেখা গেছে।
বিকাল পৌনে ৪টায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জমান বলেন, “বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে গোমতী বাঁধের বুড়বুড়িয়া এলাকায় ৩০ ফুট ভেঙে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। এখন সেই ভাঙন দেড়শ মিটারের (প্রায় ৫০০ ফুট) বেশি। এতে তীব্র স্রোতে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। নদীর পানি না কমলে এই বাঁধ মেরামত করা সম্ভব না। নদীর পানি যতদিন না কমবে ততদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতে থাকবে।”
প্রকৌশলী বলেন, “শনিবার বিকাল পর্যন্ত গোমতীর পানি বিপৎসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর শুক্রবার ১০৯ সেন্টিমিটার এবং বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ বিপৎসীমার ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। সে হিসাবে পানি কিছুটা কমেছে। আমরা চেষ্টা করছি, অন্য কোথাও যেন বাঁধ না ভাঙে সেদিকে লক্ষ্য রাখার।”
স্থানীয়রা জানান, বুড়িচংয়ের বন্যার পানিতে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার একাংশ, ব্রাহ্মণপাড়া ও দেবিদ্বার উপজেলাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বুড়বুড়িয়া এলাকার গোমতী বাঁধ ধসে পড়ার পর থেকে বুড়িচংয়ের পাশাপাশি ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায়ও প্রতিনিয়ত প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। দিশেহারা হয়ে পড়েছে দুই উপজেলার মানুষ।
দুপুরে বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার বলেন, “পুরো উপজেলায় এখনো পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ৪৩ হাজার ৭৫০। এ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার।
“এরই মধ্যে শনিবার সকাল পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন তিন হাজার পুরুষ, সাড়ে তিন হাজার নারী, চার হাজার শিশু, প্রতিবন্ধী মানুষ ৪৫ এবং ৬০০ গবাদিপশু। প্রতিনিয়ত মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটে যাচ্ছেন। আমরাও বিভিন্নভাবে আটকেপড়া মানুষদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার চেষ্টা করছি।”
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে অধিকাংশ এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সড়ক তলিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বলা চলে, সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে বুড়িচংয়ে।
মাঝে মাঝে তলিয়ে যাওয়া সড়কে ত্রাণ এবং নৌকাবাহী দুই-একটি ট্রাক চলতে দেখা গেছে। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক সমস্যা পরিস্থিতিকে আরো তীব্র করে তুলেছে।
কারণ সঠিক তথ্য না জানায় উদ্ধার তৎপরতায় এবং ত্রাণ বিতরণে সমস্যা হচ্ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ না পেয়ে হাহাকার করছে বানভাসী মানুষ। নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের অসুস্থ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
কুমিল্লা পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি-২ এর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “পুরো বুড়িচং পানির নিচে। বিদ্যুতের বেশিরভাগ মিটার পানিতে ভাসছে। এই মুহূর্তে বিদ্যুৎসংযোগ সচল করলেই দুর্ঘটনা ঘটবে।
“কয়েকটা মোবাইল অপারেটর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আমরা বলেছি, পানি কমা ছাড়া বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব নয়। ত্রাণের নৌকাগুলো বিদ্যুতের তারের ওপর দিয়ে যায়। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।”
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “আমরা সাহায্যকারীদের এমন বিপদে ফেলতে পারি না। পানি কমলেই আমরা সংযোগ দিয়ে দেব।”
এদিকে, জেলার চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, লাকসাম, মনোহরগঞ্জসহ অন্তত ১২টি উপজেলায় বন্যার পানি কিছুটা কমলেও শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে মানুষ।
আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মিলছে না পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তা। প্রতিটি এলাকাকে গুরুত্ব দিয়ে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান বলেন, “জেলার বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোর দুর্গত এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষের জন্য শুকনা খাবার, স্যালাইন ও ওষুধ মজুত আছে। ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত আছে। আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রাখছি। যারা আটকে পড়েছেন তাদেরকে উদ্ধারে কাজ চলছে।”
জেলার ত্রাণ কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, জেলার ১৭ উপজেলার মধ্যে ১৪ উপজেলা বন্যা দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় সাত লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। যদিও স্থানীয় তথ্যে এ সংখ্যা ১১ লাখের বেশি।