চ্যাম্পিয়ন্স লিগ
Published : 01 Jun 2025, 01:52 AM
স্বপ্নকে সত্যি করতে, অধরা ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরতে কী দুর্দান্তভাবেই না জ্বলে উঠল পিএসজি! তাদের দ্যূতিময় আর দাপুটে পারফরম্যান্সের সামনে একেবারে ফিকে পড়ে গেল ইন্টার মিলান। ন্যূনতম চ্যালেঞ্জও জানাতে পারল না তারা। তিনবারের ইউরোপ চ্যাম্পিয়নদের গোলবন্যায় ভাসিয়ে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের আনন্দে ভাসল লুইস এনরিকের দল।
মিউনিখের আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় শনিবার রাতের শিরোপা লড়াইয়ে ৫-০ গোলে জিতেছে পিএসজি। ৫৪ বছর বয়সী ক্লাবের নতুন এই ইতিহাস লেখার নায়ক ১৯ বছর বয়সী দিজিরে দুয়ে।
আশরাফ হাকিমির গোলে ম্যাচের শুরুতেই এগিয়ে যাওয়ার পর দুই অর্ধে একটি করে গোল করেন তরুণ ফরাসি ফরোয়ার্ড দুয়ে। পরে বাকি দুটি গোল করেন খাভিচা কাভারাৎস্খেলিয়া ও সেনি।
ইউরোপের শীর্ষ প্রতিযোগিতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে ফাইনালে এত বড় জয় আগে কোনো দল পায়নি। এর আগে সর্বোচ্চ ৪ গোলের ব্যবধান দেখা গিয়েছিল চারবার; ১৯৬০ সালে আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্টের বিপক্ষে রেয়াল মাদ্রিদ ৭-৩ গোলে, ১৯৭৪ সালে আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে বায়ার্ন মিউনিখ ৪-০ গোলে, ১৯৮৯ সালে এফসিএসবির বিপক্ষে এসি মিলান ৪-০ গোলে এবং ১৯৯৪ সালে বার্সেলোনার বিপক্ষে এসি মিলান ৪-০ গোলে জিতেছিল।
শিরোপা লড়াইটি কতটা একতরফা হয়েছে, তার যথাযথ প্রমাণ স্কোরলাইনের পাশাপাশি মিলছে অন্যান্য পরিসংখ্যানেও। প্রায় ৬০ শতাংশ সময় বল দখলে রেখে পিএসজি গোলের জন্য ২৩ শট নিয়ে আটটি লক্ষ্যে রাখতে পারে। বিপরীতে ইন্টারের আট শটের দুটি ছিল লক্ষ্যে, অবশ্য সেগুলোও তেমন ভীতি ছড়াতে পারেনি।
এনরিকের এই পিএসজি পজেশন ধরে রেখে খেলতে পছন্দ করে, যা তাদের কৌশলেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফাইনালের মঞ্চে, ইতিহাস গড়ার হাতছানিতেও তেমন কোনো স্নায়ুচাপে ভুগতে দেখা গেল না দলটিকে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, অধিকাংশ সময় বল দখলে রেখে আক্রমণ শানাতে থাকে পিএসজি। সাফল্যও পেয়ে যায় চটজলদি। আট মিনিটের দুই গোলে ম্যাচের শুরুতেই চালকের আসনে উঠে বসে তারা।
গোলের জন্য ১০ মিনিটের মধ্যে তিনটি সাদামাটা প্রচেষ্টার পর, দ্বাদশ মিনিটে একই সঙ্গে সুন্দর ও সহজ গোলে এগিয়ে যায় পিএসজি। ভিতিনিয়ার পাস ডি-বক্সে ধরে সামনে একপলকে দিজিরে দুয়ে দেখলেন গোলরক্ষক তার দিকে এগিয়ে আছে, মুহূর্তেই তিনি পাস বাড়ালেন অন্য পাশে হাকিমিকে। ফাঁকায় বল পেয়ে বিনা বাধায় জালে ঠেলে দিলেন মরক্কোর রাইট-ব্যাক।
এত বড় মঞ্চে দলকে এমন দুর্দান্ত শুরু এনে দিয়েও কোনোরকম উদযাপন করেননি হাকিমি। ২০২০-২১ মৌসুমে যে ইতালিয়ান দলটিতে খেলেছিলেন তিনি, ক্লাবটির সমর্থকদের দিকে তাকে দুই হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে দেখা যায়।
কিছুটা সৌভাগ্যের ছোঁয়ায় ২০তম মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করে পিএসজি। প্রতিপক্ষের একটি আক্রমণ রুখে দিয়ে, তড়িৎ পাল্টা আক্রমণে ওঠে তারা। সতীর্থের পা থেকে ডি-বক্সে বল পেয়ে শট নেন ১৯ বছর বয়সী দুয়ে, সামনে ডিফেন্ডার ফেদেরিকো দিমার্কোর পায়ে লেগে একটু দিক পাল্টে বল যায় জালে।
একই সঙ্গে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেন দুয়ে। ১৯ বছর ৩৬২ দিন বয়সে তৃতীয় টিনএজার হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে গোল করলেন তিনি; আগের দুজন হলেন পাত্রিক ক্লুইভার্ট ও কার্লোস আলবের্তো।
বিরতির পরও একইরকম দাপুটে শুরু করে পিএসজি। এই অর্ধের প্রথম সাত মিনিটে আরও তিনটি শট নেয় তারা, যদিও একটিও লক্ষ্যে ছিল না।
সেমি-ফাইনালের দুই লেগে বার্সেলোনার বিপক্ষে দুই মহাকাব্যিক লড়াইয়ের জন্ম দেওয়া ইন্টার মিলান এবার আর পারল না তেমন কিছু করতে।
৬৩তম মিনিটে আরেকটি দুর্দান্ত গোলে তাদের সব আশা প্রায় শেষ করে দেয় পিএসজি। গতিময় আক্রমণে ভিতিনিয়ার থ্রু পাস ডি-বক্সে পেয়ে নিখুঁত শটে নিজের দ্বিতীয় গোলটি করেন ম্যাচ সেরা দুয়ে।
এরপরও বাকি যা একটু অনিশ্চয়তা ছিল, বলা যায় তা শেষ হয়ে যায় ১০ মিনিট পর। মাঝমাঠ থেকে উসমান দেম্বেলের থ্রু পাস ধরে ক্ষিপ্রতায় ডি-বক্সে ঢুকে নিচু শটে গোলরক্ষককে পরাস্ত করেন জর্জিয়ার ফরোয়ার্ড কাভারাৎস্খেলিয়া।
ওই গোলের পর কোচ এনরিকের উচ্ছ্বাস, সাইডলাইন ধরে ছুটে যাওয়া ছিল দেখার মতো। বার্সেলোনার হয়ে ২০১৪-১৫ মৌসুমেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছিলেন তিনি। কিন্তু প্রতিযোগিতাটির ফাইনালের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বকনিষ্ট দল নিয়ে এমন সাফল্য অবিশ্বাস্যই বটে।
তাদের গোল উৎসবের তখনও অবশ্য বাকি। ৮৪তম মিনিটে ফাবিয়ান রুইসের বদলি নামার দুই মিনিট পরই জালের দেখা পেয়ে যান আরেক ১৯ বছর বয়সী সেনি। দুরূহ কোণ থেকে জোরাল শটে ইয়ান সমেরকে পরাস্ত করেন ফরাসি মিডফিল্ডার।
প্রাথমিক পর্বের প্রথম পাঁচ রাউন্ডে মাত্র একটিতে জিতে (বাকি চার ম্যাচের তিনটিতে হার ও একটি ড্র) এই পিএসজিই চলে গিয়েছিল বিদায়ের দুয়ারে। সেখান থেকে টানা তিন ম্যাচ জিতে প্লে-অফে জায়গা করে নেয় তারা। এরপর কেবলই এগিয়ে চলা।
ওই প্লে-অফে ব্রেস্তকে দুই লেগ মিলিয়ে ১০-০ গোলে বিধ্বস্ত করে তারা। এরপর একে একে লিভারপুল, অ্যাস্টন ভিলা ও আর্সেনালকে হারিয়ে ফাইনালের মঞ্চে জায়গা নেওয়া এবং শিরোপা লড়াইয়ে এমন দাপুটে পারফরম্যান্সে নতুন এক ইতিহাসের জন্ম দিল লুইস এনরিকের দল পিএসজি।
সাফল্যে ভরা মৌসুমে ফরাসি সুপার কাপ, ফরাসি কাপ, লিগ আঁয়ের পর তারা উঁচিয়ে ধরল স্বপ্নের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি।