Published : 21 Nov 2024, 06:08 PM
২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারনায় মাস্ককে বেশ কিছু রূপে আবির্ভূত হতে দেখা গেছে, যেখানে তার একজন অর্থদাতা হিসেবে তার এ যাত্রা শুরু হলেও শেষমেষ ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় সমর্থক হওয়ার অনানুষ্ঠানিক তকমাও জুটেছে তার কপালে।
নির্বাচনের পরপরই মাস্ককে ট্রাম্প পরিবারের সঙ্গে ‘মার-আ-লাগো’ রিসোর্টে ক্যাম্পিং করতে দেখা গেছে। এমনকি ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কি’র সঙ্গে ট্রাম্পের ফোন কলেও তিনি যুক্ত হয়েছিলেন।
নিউ ইয়র্কে একজন কূটনীতিক হিসেবে জাতিসংঘে ইরানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গেও গোপনে একটি বৈঠক সেরেছেন বলে উঠে এসেছে মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে।
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী ট্রাম্প মাস্ককে এমন এক বিভাগের সহ-প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন, যার ফলে তিনি হয়ে উঠছেন প্রেসিডেন্টের অনানুষ্ঠানিক চিফ অফ স্টাফ।
নতুন পদে মাস্কের মনযোগ থাকবে সরকারের কার্যকারিতার দিকে। এর মানে, ফেডারেল কর্মীদের নিয়োগ ও ছাঁটাই নিয়ে পরামর্শ দেওয়ার এমনকি বিভিন্ন সংস্থার কাঠামোকে খোলনলচে বদলে ফেলার ক্ষমতা পাবেন। তবে, মাস্কের যে এর চেয়েও বড় প্রভাব থাকবে, তা প্রায় নিশ্চিত।
অভিবাসন ও ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার, এমন অনেক বিষয়ে তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে একমত। অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তন ও লোকজনকে ইভি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার মতো কয়েকটি বিষয়ে তারা দ্বিমত পোষণ করলেও বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মাস্ক এখন ট্রাম্পের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এমন রাজনৈতিক বন্ধুত্ব তৈরির সম্ভাবনা দেখাচ্ছেন, যা এর আগে আমেরিকা কখনও দেখেনি।
বড় সরকারি চুক্তি
ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারনার সময় নিজের নতুন দায়িত্ব নিয়ে একটি রূপরেখা দিয়েছিলেন মাস্ক।
তিনি বলেন, ফেডারেল সরকারের ছয় লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলারের বাজেট থেকে অন্তত দুই লাখ কোটি ডলার ছেঁটে ফেলা উচিৎ। তবে, এমনটি করলে যে ‘সাময়িকভাবে কিছু অসুবিধা’ হবে, সে বিষয়টি স্বীকার করেছেন তিনি।
কর্মী ছাঁটাই করা মাস্কের কাছে নতুন কিছু নয়। ২০২২ সালে এক্স (তৎকালীন টুইটার) অধিগ্রহণের পর কোম্পানি থেকে ৮০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করেছিলেন তিনি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে অনেক কিছুই পাওয়ার আছে মাস্কের। তার বিভিন্ন ব্যবসা এরইমধ্যে ফেডারেল সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেখানে গত বছর বিভিন্ন সংস্থা থেকে চুক্তিবাবদ তিনশ কোটি ডলারের আর্থিক অনুদান পেয়েছেন তিনি।
তার রকেট কোম্পানি স্পেসএক্স প্রায়শই আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নভোচারী পাঠায় ও মহাকাশে সামরিক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে থাকে। এমনকি নির্বাচনের আগেও মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ট্রাম্পকে স্পেসএক্স কর্মী নিয়োগ দেওয়ার কথা বলেছিলেন মাস্ক, যা হয়ত তাদের সম্পর্ক আরও টেকসই করতে সাহায্য করবে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে টাইমস।
মাস্কের বিভিন্ন আইডিয়া
মাস্ক শুধু একজন উদ্যোক্তা নন। তিনি এখন নতুন ‘মিডিয়া সম্রাট’, যার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আছে। এ ছাড়া, এ খাতের কয়েকটি নিয়ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও পাচ্ছেন তিনি।
মাস্ক নিজেকে ‘বাক স্বাধীনতার ধারক’ হিসেবে প্রচার করেন। কিন্তু টুইটার কেনার পর এর নাম বদলে ‘এক্স’ রাখার পাশাপাশি নিষিদ্ধঘোষিত শত শত ব্যবহারকারীকে তিনি প্ল্যাটফর্মটিতে ফিরিয়ে এনেছেন, যাদের বিরুদ্ধে ভুল তথ্য ছড়ানো অথবা সহিংসতায় উস্কানি দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে ছিলেন খোদ ট্রাম্পও।
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে তাকে নিষিদ্ধ করেছিল জ্যাক ডরসির টুইটার। তবে, এবারের নির্বাচনী প্রচারনায় মাস্ক নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থেকেই ট্রাম্পের পক্ষে ভোট চেয়েছিলেন, যেটির ফলোয়ার সংখ্যা ২০ কোটিরও বেশি।
এতে করে ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ অর্থাৎ ‘মাগা’ আন্দোলনের নতুন আতুরঘর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে এক্স, যা এরইমধ্যে ট্রাম্প সমর্থকদের একত্রিত হওয়ার জায়গা হিসেবে বিবেচিত।
ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে ফিরে এলে তিনি ও তার কর্মকর্তারা একে জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রাথমিক উপায় হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন, যার ফলে স্বাধীন গণমাধ্যম হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এইসব সংবাদ সংস্থা ট্রাম্পের বিবেচনায় জনগণের শত্রু এবং মাস্কের বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় ও দুর্নীতিগ্রস্থ।
ট্রাম্পের প্রচারণায় কত অর্থ ঢেলেছেন মাস্ক?
এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর প্রচারণায় বিলিয়নেয়ারদের ভূমিকা অন্যান্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ছিল। একদিকে কমলা হ্যারিসের পক্ষে ছিলেন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ও নিউ ইয়র্কের সাবেক মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ। কিন্তু নির্বাচনে সবচেয়ে বড় তফাৎ গড়ে দিয়েছে ট্রাম্পের প্রতি মাস্কের বহুমুখী সমর্থন।
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফেডারেল ইলেকশন কমিশন (এফইসি)’র প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প ও অন্যান্য রিপাবলিকান প্রার্থীকে আনুমানিক ১৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের আর্থিক অনুদান দিয়েছেন মাস্ক।
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি অনুদান ছিল চার কোটি ৩৬ লাখ ডলার ও সাড়ে সাত কোটি ডলার, যা সরাসরি গিয়েছে ট্রাম্পের প্রচারণায়, বিশেষ করে মাস্কের নিজের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক কমিটি ‘আমেরিকা প্যাক’-এ।
এমনকি গুরুত্বপূর্ণ সুইং স্টেটগুলোয় প্রতিদিন ১০ লাখ ডলার নগদ আর্থিক পুরস্কার জেতার ব্যবস্থাও চালু করেছিলেন মাস্ক, যা এমন নিবন্ধিত ভোটারদের জন্য প্রযোজ্য ছিল, যারা মার্কিন সংবিধানের প্রথম ও দ্বিতীয় সংশোধনী সমর্থন করা এক পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন, যেখানে যথাক্রমে বাক স্বাধীনতা ও অস্ত্র রাখা বা বহন করার অধিকার সুরক্ষিত রাখার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
“আমরা এ পিটিশনে স্বাক্ষর করা লোকজন থেকে এলোমেলোভাবে বাছাই করে প্রতিদিন একজনকে ১০ লাখ ডলার করে নগদ অর্থ দেব, যা চলবে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত,” ১৯ অক্টোবর ট্রাম্পের এক প্রচারণা র্যালিতে বলেছেন মাস্ক।
ট্রাম্পকে দ্বিতীয় মেয়াদে জেতাতে ইলন মাস্কের ‘পলিটিকাল অ্যাকশন কমিটি (প্যাক)’ প্রায় ২০ কোটি ডলার খরচ করেছে, ১২ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে লিখেছে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান।
মাস্ক কেন ট্রাম্পের সঙ্গেই সখ্যতা গড়লেন?
ট্রাম্প ও মাস্কের মেলবন্ধনে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পেয়েছেন তাদের ভক্তরা।
তবে, তাদের মধ্যে সবসময় এমন মধুর সম্পর্ক ছিল, বিষয়টি এমন নয়। ২০২২ সালে মাস্ককে একজন ‘মিথ্যুক ভণ্ড’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এমনকি ২০১৬ সালের নির্বাচনে মাস্ক তাকে সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে সত্য বলেননি, এমন অভিযোগও তুলেছিলেন তিনি।
এর জবাবে মাস্ক তখন টুইটারে (বর্তমানে ‘এক্স’) লিখেছিলেন, “এখন সময় এসেছে, ট্রাম্পের নিজের তিল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিৎ।”
কিন্তু এর দুই বছর পরই দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। পেনসিলভানিয়ার বাটলার শহরে আয়োজিত র্যালিতে ট্রাম্পের কাধে কাধ মিলিয়ে দাঁড়ালেন এ প্রযুক্তি টাইকুন। এমনকি তখন একটি কালো রঙের ‘মাগা’ হ্যাটও পরেছিলেন তিনি।
মাস্কের অধিকার চাওয়ার বিষয়টি আসলে কখনও কখনও, কোভিড মহামারির সময় সরকার যে টেসলার কারখানা বন্ধ করে দিয়েছিল, এর ভিত্তিতে হয়ে থাকে।
এমনকি ২০২০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ফ্রেমন্ট শহরে একটি কারখানা পুনরায় চালু করেন তিনি, যেখানে ‘আমলাতান্ত্রিক বাধার’ বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অভিযোগ তুলে এর জন্য গ্রেপ্তার হতেও প্রস্তুত বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন মাস্ক।
ডানপন্থী মনোভাবের দিকে মাস্কের এমন মোড় নেওয়ার পর থেকেই তার সঙ্গে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেই’র মতো কিছু নিয়ন্ত্রণবিরোধী নেতার সখ্যতা বাড়তে দেখা গেছে। এমনকি ইতালির জর্জিয়া মেলোনি, ভারতের নরেন্দ্র মোদী এবং ইসরায়েলের বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মতো আন্তর্জাতিক ডানপন্থী নেতাদের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে।
কিন্তু ভ্যানিটি ফেয়ার এবং ওয়াশিংটন পোস্টের মতো মার্কিন গণমাধ্যম এর পেছনে আরও গভীর কারণ থাকার বিষয়টি চিহ্নিত করেছে, যেখানে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছে ২০২২ সালে তার একজন সন্তানের ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার বিষয়টি। এ ছাড়া, মাস্কের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি নিজের ডাকনাম বদলে ‘উইলসন’ রেখেছেন ওই সন্তান।
কানাডীয় মনোবিদ জর্ডান পিটারসনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাস্ক দাবি করেছেন, তার সঙ্গে ‘প্রতারণা করে’ তার সন্তানের মেডিকাল চিকিৎসার নথিতে স্বাক্ষর করানো হয়েছে। এমনকি ‘য়োক মাইন্ড ভাইরাস’-এর বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধও ঘোষণা করেছেন তিনি।
২০২১ সালে টেসলার সদর দপ্তরের ঠিকানা ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আল্টো শহর থেকে বদলে টেক্সাসের অস্টিন শহরে অবস্থিত সিলিকন ভ্যালি’তে নিয়ে গেছেন মাস্ক। একইভাবে নিজের বাসভবনও বদলেছেন তিনি।
এ বছরের জুলাই মাসে মাস্ক বলেছেন, তিনি স্পেসএক্স ও এক্স-এর সদর দপ্তরও ক্যালিফোর্নিয়া থেকে টেক্সাসে নিয়ে আসবেন। আর এর কারণ হিসেবে একটি আইনের কথা উল্লেখ করেন তিনি, যেখানে স্কুলে শিশুর লিঙ্গ পরিচয় বদলানোর বিষয়ে শিক্ষকদের কাছে অভিভাবকদের অবহিত করা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
এক্স ও ট্রুথ সোশাল কি মিলবে?
ট্রাম্প ও মাস্কের মধ্যে চলমান ‘ব্রোমান্স’ দেখে কেউ কেউ এখন ধারণা প্রকাশ করছেন, তাদের মালিকানাধিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো হয়ত সমন্বিত করার কাজ চলছে।
“আমার সন্দেহ বলছে, মাস্ক ট্রুথ সোশালের সঙ্গে এক্স’কে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করবেন,” গত সপ্তাহে সিএনএন’কে বলেছেন ‘অল থিংস ডিজিটাল’খ্যাত মার্কিন প্রযুক্তি সাংবাদিক কারা সুইশার।
“তারা হয়ত সমন্বিত হয়ে নিজেদের জন্য বিশাল অর্থ উপার্জনের লক্ষ্য নিয়েছে। এটা খুবই রোমাঞ্চকর ও ব্যপক দুর্নীতিগ্রস্থ কিছু হবে।”
শুক্রবার ‘পিভট’ নামের পডকাস্টে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি’র অধ্যাপক স্কট গ্যালোওয়ে বলেছেন, “আমি এতটুকুই বলতে পারি যে, আইনিভাবে মাস্ক ও ট্রাম্প একজোট হলে তারা শত শত কোটি ডলার উপার্জন করবেন।”
ট্রুথ সোশালের মালিক কোম্পানি ‘ট্রাম্প মিডিয়া অ্যান্ড টেকনোলজি গ্রুপ’-এর সিংহভাগ শেয়ার ট্রাম্পের দখলে। অন্যদিকে, মাস্কের মালিকানায় রয়েছে ‘এক্স’, যা এর আগে ‘টুইটার’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল।
নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি’র ‘সেন্টার ফর কমিউনিকেশন অ্যান্ড পাবলিক পলিসি’ বিভাগের পরিচালক এরিক নিসবেট মার্কিন সাময়িকী ফরচুনকে বলেছেন, “মাস্কের অধিগ্রহণের পর থেকেই এক্স’র বিভিন্ন কনটেন্ট ট্রুথ সোশালের কাছাকাছি পর্যায়ে চলে গেছে।”
“বাক স্বাধীনতা নিয়ে তার যে দর্শন, তা ট্রুথ সোশালের অনেক কাছাকাছি।”