Published : 23 Sep 2024, 07:33 PM
শ্রীলংকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট অনুরা কুমার দিশানায়েকে শপথ নিয়েছেন। দেশে পরিবর্তন আনার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ে সোমবার শপথ নেওয়ার সময় উদ্বোধনী ভাষণে দিশানায়েকে বলেন, দেশের একটি চ্যালেঞ্জিং সময়ে তিনি দায়িত্ব নিচ্ছেন।
গণতন্ত্রকে রক্ষা করা এবং সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে নিবেদিতপ্রাণ হিসাবে নিজেকে তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন বলে জানান দিশানায়েকে। তিনি বলেন, “আমাদের রাজনীতি স্বচ্ছ হওয়া দরকার। আর জনগণ একটি ভিন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পক্ষেই ভোট দিয়েছে। আমি এই পরিবর্তনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
শ্রীলঙ্কার বামপন্থি রাজনীতিবিদ অনুড়া কুমারা দিশানায়েকে দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বার ভোট গণনার পর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী নেতা সাজিথ প্রেমাদাসাকে পরাজিত করে জয়ী হন।
২০১৯ সালের নির্বাচনে মাত্র তিন শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন দিশানায়েকে। তিনি বামপন্থি জোট ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ারের (এনপিপি) প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। এবারের নির্বাচনে তার ঘুরে দাঁড়ানোকে বিস্ময়কর বলেই অভিহিত করছেন বিশ্লেষকরা।
সম্প্রতি কয়েকবছরে দুর্নীতিবিরোধী প্ল্যাটফর্ম তৈরির পাশাপাশি দেশের চরম অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে গরিবদের প্রাধান্য দিয়ে নীতিমালা নেওয়ার কারণে দিশানায়েকে অনেক বেশি জনসমর্থন পেতে সক্ষম হয়েছেন।
আর এখন তিনি এমন এক জাতির হাল ধরলেন যে জাতি এখনও ২০২২ সালের নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে সংগ্রাম করছে। এই সময়ে নতুন প্রেসিডেন্টের কাছে জনগণের প্রত্যাশাও অনেক। তারা পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে আছে।
সাবেক মার্কসবাদী নেতা:
১৯৬৮ সালের ২৪ নভেম্বর শ্রীলংকার মধ্যাঞ্চলে নানা সংস্কৃতি-নানা ধর্মের মানুষের শহর গালেওয়েলায় জন্ম দিশানায়েকের। বেড়ে ওঠেন মধ্যবিত্ত পরিবারে। সরকারি স্কুলে পড়া শেষে স্নাতক করেন পদার্থবিদ্যায়।
১৯৮৭ সালে ইন্দো-শ্রীলংকা চুক্তির সময় ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেন দিশানায়েকে। ইন্দো-শ্রীলংকা চুক্তিকে কেন্দ্র করে দেশটিতে অন্যতম এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল।
১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বামপন্থি রাজনৈতিক দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) শ্রীলংকা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ চালায়। দিশানায়েক পরে এই দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হন।
নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির গ্রামীণ তরুণদের মধ্যে অসন্তোষ থেকে ওই বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। বিদ্রোহ পরে সংঘাতে রূপ নেয় এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে অভিযান, হত্যা ও হামলার কারণে হাজারো মানুষের প্রাণহানি হয়।
১৯৯৭ সালে জেভিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন দিশানায়েকে। ২০০৮ সালে দলের প্রধান হন তিনি। তখন থেকেই তিনি বিদ্রোহের ওই দুই বছরে নিজের রাজনৈতিক দলের সহিংস কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমা চেয়ে এসেছেন।
২০১৪ সালে বিবিসি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “সশস্ত্র সংঘাতের সময় এমন অনেক কিছুই ঘটেছে, যা ঘটা উচিত হয়নি। আমরা এখনও মর্মাহত। আমাদের হাতে যেসব কিছু ঘটেছে, তা একদমই ঘটা ঠিক হয়নি। আমরা সবসময়ই সেসব ঘটনার জন্য দুঃখিত, বিস্মিত।”
বর্তমানে শ্রীলংকার পার্লামেন্টে জেভিপির মাত্র তিনটি আসন আছে। এনপিপি জোটের অংশ হিসেবে দলটি পার্লামেন্টে আছে। দিশানায়েকে এখন এ জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
ভিন্নধর্মী নেতা দিশানায়েকে:
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনি প্রচারের পাশাপাশি দিশানায়েকে শ্রীলংকার সাম্প্রতিক ইতিহাসে আরেকটি ভয়াবহ সহিংস ঘটনা নিয়েও কথা বলতেন। আর তা হল, ২০১৯ সালে ইস্টার সানডেতে বোমা হামলার ঘটনা।
ওই বছর ২১ এপ্রিলে রাজধানী কলম্বোর বেশ কয়েকটি গির্জা ও আন্তর্জাতিক মানের হোটেলে ভয়াবহ প্রাণঘাতী বোমা হামলা হয়েছিল। এতে অন্তত ২৯০ জন নিহত ও হাজারো মানুষ আহত হয়।
পাঁচ বছর পরও ওই ঘটনার নেপথ্যে কে বা কারা ছিলেন, সরকারি তদন্তে তা উদ্ঘাটিত হয়নি। কেউ কেউ দাবি করে, গোতাবায়া সরকার ঘটনাটির তদন্ত প্রক্রিয়ায় বাধা দিয়েছে।
নির্বাচনি প্রচারের সময় দিশানায়েকে বিবিসি-কে বলেছিলেন, তিনি নির্বাচিত হলে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে তদন্ত করবেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিজেদের দায় প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত করেনি বলে তিনি ইঙ্গিত দেন।
শ্রীলংকার রাজনৈতিক দলের যে প্রতিশ্রুতিগুলো অপূর্ণ থেকে গেছে, তার একটি এটি বলেই মনে করেন দিশানায়েকে।
তিনি বলেন, “শুধু এ তদন্তই নয়। রাজনীতিবিদরা যারা দুর্নীতি থামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তারা নিজেরাই দুর্নীতিতে ডুবে গেছেন। যারা ঋণমুক্ত শ্রীলংকার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তারা ঋণের বোঝা আরও বাড়িয়েছেন। যারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন, তারা নিজেরাই আইনভঙ্গ করেছেন।”
“এসব কারণেই এ দেশের মানুষ ভিন্ন নেতৃত্ব চাইছে। আমরাই জাতির এ প্রত্যাশা পূরণ করতে পারি।”
পুরোনো রাজনৈতিক ধারার বাইরের নেতা:
দিশানায়েকের আরেক ভিন্নধর্মী বিষয় হচ্ছে- তিনি খুব শক্তিশালী বমপন্থি আদর্শবাদী এক নেতা। বংশ পরম্পরায় রাজনীতি করা কোনও পরিবার থেকে তিনি আসেননি।
দেশের পুরোনো শাসনের ধারার বাইরের এক নেতা তিনি। অন্তত দেশের বেশির ভাগ মানুষ তাকে এভাবেই দেখেছে।
দিশানায়েকে নেতৃত্বে আসার মধ্য দিয়ে রাজাপাকসে পরিবার এবং পুরনো ক্ষমতা বলয়ের টানা দেড় দশকের বেশি সময়ের একক আধিপত্যের চূড়ান্ত অবসান ঘটেছে শ্রীলংকায়।
শ্রীলংকায় স্বাধীনতার পর থেকেই শাসন করে এসেছে দুটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল বা তাদের জোট বা তাদেরই কোনও অংশ। যার একটি হচ্ছে রাজাপাকসে পরিবারের নেতৃত্বাধীন দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি)। মাহিন্দা রাজাপাকসে একাধিকবার প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছাড়ার আগে সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট ছিলেন তার ছোট ভাই গোতাবায়া রাজাপাকসে। গোতাবায়াও গণআন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালান।
এরপর রণিল বিক্রমাসিংহকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে পার্লামেন্ট। তিনি রাজাপাকসের দলের সমর্থন নিয়েই প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। এবারের নির্বাচনে রণিল বিক্রমাসিংহে অংশ নিলেও তিনি বৈতরণি উৎরাতে পারেননি।
পরিবর্তনে বিশ্বাসী নেতা দিশানায়েকে:
দেশব্যাপী গণঅসন্তোষের মধ্যে দিশানায়েকের নির্বাচনী প্রচারণার মূলমন্ত্র ছিল পরিবর্তন। গত শনিবারের নির্বাচনে তিনি শক্তিশালী একজন প্রার্থী হিসাবে উঠে এসেছিলেন।
অর্থনৈতিক দুর্দশার জেরে ২০২২ সালে গণবিক্ষোভের মুখে সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কোভিড মহামারীর পাশাপাশি দুর্বল রপ্তানিসহ নীতিগত ত্রুটির কারণে শ্রীলংকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল।
সরকারি ঋণের পরিমাণ ৮৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ৭০ শতাংশ বেড়েছিল মূল্যস্ফীতি। এ সংকটের জন্য রাজাপাকসে ও তার সরকারকেই দায়ী করা হয়।
রাজাপাকসের উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংহে অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি কমেছে, দেশটির রুপিও শক্তিশালী হয়েছে। তবে মানুষের দুর্দশা এখনও কাটেনি।
২০২২ সালে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি লাগাতার দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক দায়মুক্তির বিষয়গুলোর প্রেক্ষাপটে দেশটির জনগণ এখন ভিন্নধারার রাজনৈতিক নেতৃত্ব চায়।
জনগণের সে চাওয়াকেই সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন দিশানায়েকে। সমালোচকরা বলছেন, রাজনৈতিক নেতারা যেসব দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি করে এসেছেন, সেখান থেকে মানুষকে পরিত্রাণ দেওয়ার পথে দিশানায়েক নিজেকে একজন ত্রাতা হিসাবে তুলে ধরতে পেরেছেন।
তিনি আগে থেকে বারবারই বলে এসেছেন, ক্ষমতায় গেলে পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করার পরিকল্পনা আছে তার। বিবিসি সিংহলী-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, নির্বাচিত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই এ উদ্যোগ নেবেন।
তার কথায়, “যে পার্লামেন্টে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন নেই, সে পার্লামেন্ট রাখারও কোনও মানে নেই।”
গরিবদের জন্য সোচ্চার এক নেতা:
দিশানায়েক যে নীতিমালার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার মধ্যে আছে- কঠোর দুর্নীতিবিরোধী আইন প্রণয়, এ সংক্রান্ত উদ্যোগ বাস্তবায়ন, বড় ধরনের কল্যাণ প্রকল্প নেওয়া এবং করের বোঝা কমানো।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বর্তমান সরকার কৃচ্ছ্র পদক্ষেপ নিয়েছে। এর আওতায় কর বাড়ানো এবং কল্যাণ ব্যয় কমানোর মতো কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এতে অনেক মানুষই তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে।
দিশানায়েকে এ সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। ফলে ভোটারদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। বিশ্লেষকরাও বলেছিছিলেন, এবারের নির্বাচনে দেশের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগের বিষয়গুলোই মুখ্য হয়ে উঠবে।
নির্বাচনের আগে ভারতভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ এর অ্যাসোসিয়েট ফেলো সৌম্য ভৌমিক বিবিসি-কে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন।
তিনি তখন বলেছিলেন, “শ্রীলংকার ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার আকাশচুম্বী ব্যয় ও দারিদ্র্য ভোটারদের মরিয়া করে তুলেছে। তারা দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল করতে এবং জীবনযাত্রা মান বাড়াতে পদক্ষেপ চায়।”
“দেশটি অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গতিপথ ঠিক করা এবং শাসনব্যবস্থার প্রতি ঘরে-বাইরে আস্থা ফেরানোর জন্য এ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে কাজ করছে।”
বিশ্লেষকরা মনে করেন, শ্রীলংকার নতুন প্রেসিডেন্টের প্রধান কাজ হবে একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করা।
চমকপ্রদ জয়:
নির্বাচন কর্মকর্তাদের হিসাবমতে, শ্রীলংকার ১ কোটি ৭১ লাখ ভোটারের মধ্যে প্রায় ৭৬ শতাংশ ভোটে শনিবারের নির্বাচনে জয় পেয়েছেন দিশানায়েকে।
রোববার সকাল সকালই দুই প্রধান প্রতিপক্ষ রনিল বিক্রমসিংহে এবং সাজিথ প্রেমদাসার কাছ থেকে অভিনন্দন বার্তা পেয়েছেন তিনি।
শ্রীলংকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলি সাবরি এক্স লিখেছিলেন যে, নির্বাচনের প্রাথমিক ফলেই দিশানায়েকের জয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
তিনি লেখেন, “আমি যদিও প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংহের জন্য জোর প্রচার চালিয়েছি, কিন্তু শ্রীলংকার জনগণ তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। আর আমি দিশানায়েককে জয়যুক্ত করার তাদের সেই সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি সম্মান করি।”
ওদিকে, প্রেমাদাসার এক সমর্থকও বলেন, তিনি দিশানায়েকে কে ফোন করে জয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। প্রেমাদাসার আরেক সমর্থক বলেন, দিশানায়েকে জাতিগত এবং ধর্মীয় সংকীর্ণতার ওপর নির্ভর না করে এক ‘চমকপ্রদ’ জয় পেয়েছেন।