Published : 04 Jul 2025, 05:34 PM
ইসরায়েল ও ইরান গত মাসে একে অপরের ওপর হামলা চালানোর পর থেকে আফগান নাগরিক এনায়েতুল্লাহ আজগারি হতাশার সঙ্গে তাকে আশ্রয় দেওয়া উপসাগরীয় দেশটির আরও বৈরি হয়ে ওঠা দেখেছেন।
তিনি তেহরানে ভবন নির্মাণ সাইটে কাজ করতেন, সেই কাজ বন্ধ হয়ে গেছে এবং তার মতো আফগানদের গুপ্তচর হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে।
৩৫ বছর বয়সী আজগারি সেই লাখো আফগানদের একজন, গত কয়েক সপ্তাহে ইরান যাদের আফগানিস্তানে ফেরত পাঠিয়েছে।
তেহরানের এমন পদক্ষেপ এখনি তীব্র মানবিক সঙ্কটের সঙ্গে লড়া আফগানিস্তানকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে বলে জাতিসংঘ আশঙ্কাও করছে, জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
“জায়গা ভাড়া পাওয়াই কঠিন। আর যদি পানও, তার দাম নাগালের বাইরে, আর কোথাও কোনো কাজ নেই,” পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে ফিরে আসার পর বলেন আজগারি।
তিনি জানান, নিজ দেশে ফিরে আসার পর এখন কী হবে, সে বিষয়ে তার কোনো ধারণাই নেই। ২০২১ সালে তালেবানরা ক্ষমতায় ফেরার পর আন্তর্জাতিকভাবে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন দেশটি এমনিতেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। তার মধ্যেই ইরান লাখ লাখ লোককে ফেরত পাঠাচ্ছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার অনুমান, যুদ্ধ চলাকালে ইরান প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজারের বেশি আফগানকে ফেরত পাঠিয়েছে, যা যুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি। সেসময় ফেরত পাঠানো হতো গড়ে ২ হাজার করে।
“আমরা সবসময় ভালো আতিথেয়তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি, তবে এখন জাতীয় নিরাপত্তাই অগ্রাধিকার। আর স্বাভাবিকভাবে অবৈধ অভিবাসীদের তো ফিরে যেতেই হবে,” মঙ্গলবার এমনটাই বলেছেন ইরান সরকারের মুখপাত্র ফাতেমা মোহাজেরানি।
এটা তাড়িয়ে দেওয়া নয়, বরং নিজ দেশে ফেরত পাঠানো, বলেছেন তিনি। ফাতেমা গুপ্তচর ধরতে চলা অভিযান নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
ইরান থেকে আফগানদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আফগানিস্তানের সরকারেরও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
জাতীয় নিরাপত্তা বিবেচনায় যুদ্ধের আগেই ইরান সরকারকে আফগানসহ অনেক বিদেশি নাগরিকের ওপর খড়্গহস্ত হতে দেখা গেছে। যুদ্ধের সময় এর তীব্রতা বেড়ে যায় বলে মানবিক সঙ্কট মোকাবেলায় কাজ করা কর্মকর্তা ও দেশে ফিরে আসা আফগানরা জানিয়েছেন।
২০২২ সালে ইরানে কাগজপত্রহীন প্রায় ২৬ লাখ আফগান ছিল বলে সেসময় অনুমান করেছিল শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির সরকার।
“তারা আমাদের সন্দেহের চোখে দেখতো, অপমান করতো। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পুলিশ, সরকার সবাই সবসময় বলতো, তোমরা আফগানরা আমাদের প্রথম শত্রু, তোমরাই আমাদের ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছো,” বলেন আজগারি।
আফগানিস্তানে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রতিনিধি আরাফাত জামাল বলেন, তিনি ‘পুশব্যাক’ নিয়ে উদ্বিগ্ন। কেননা, ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের হামলার রেশ ধরে ইরান আফগানদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়তে পারে।
“তারা খুব ভয়ঙ্কর যুদ্ধের ভেতর দিয়ে গেছে, আমরা তা বুঝি। কিন্তু আমাদের মনে হচ্ছে, আফগানদের বলির পাঁঠা বানানো হচ্ছে এবং তাদের ওপর সেই ক্ষোভের কিছুটা উগরে দেওয়া হচ্ছে,” বলেছেন তিনি।
আরাফাত বলেন, পাকিস্তানও ২০২৩ সাল থেকে আফগানদের দেশে ফেরত পাঠানোর অভিযান চালাচ্ছে, ফলে পুরো অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়ছে।
তালেবানরা ক্ষমতা নেওয়ার পর ব্যাংকিং খাতে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটির অর্থনীতি এমনিতেই সঙ্কটকাল কাটাচ্ছিল, সম্প্রতি বিভিন্ন পশ্চিমা দেশও সেখানে সাহায্যের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার আফগানিস্তান মিশনও এই বছর প্রয়োজনের তুলনায় এক চতুর্থাংশেরও কম অর্থ পেয়েছে।
আফগানিস্তান সহায়তা তহবিল তিন বছর আগের ৩২০ কোটি ডলার থেকে কমে ৫৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। অথচ কেবল এ বছরই ইরান ও পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে ফেরত এসেছে ১২ লাখ মানুষ, যাদের বেশিরভাগই এসেছেন বহন করা যায় এমন যৎসামান্য কিছু জিনিস ও অল্প কয়েকটি পোশাক নিয়ে।
ইরান বলছে, তারা অবৈধ অভিবাসীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অব্যাহত রাখবে।
“আমাদের বৈধ অনেক অভিবাসী আছে। তাদের অনেকেই কবি, লেখক, চিকিৎসক, দক্ষ কর্মী, তাদেরকে ফেরত পাঠাতে চাই না। কিন্তু যখন অবৈধদের কথা আসে, জাতীয় যে নীতিমালা রয়েছে তা তো কার্যকর করতেই হবে,” বলেছেন ইরান সরকারের মুখপাত্র।
আফগানদের মধ্যে কারও কারও বৈধ ভিসা থাকা সত্ত্বেও গ্রেপ্তার ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
২৬ বছর বয়সী আহমাদ ফাওয়াদ রাহিমি জানান, যুদ্ধের কারণে পরিবারের লোকজন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ায় গত মাসে আফগানিস্তানে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
ফেরার পথে তাকে তুলে নিয়ে একটি বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়।
ওই বন্দিশিবিরে কয়েদিদের দেওয়া হতো খুবই সামান্য পরিমাণ খাবার ও পানি; শিবিরে থাকাকালীন তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোনও কেড়ে নেওয়া হয় এবং পরে সীমান্ত পার করে দেওয়ার জন্য উচ্চহারে ভাড়া নেওয়া হয়, বলেছেন তিনি।
“আগে অন্তত প্রথমবার সতর্ক করে ছেড়ে দেওয়া হতো, দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার হলে ফেরত পাঠিয়ে দিতো। এখন সবাইকে গুপ্তচর হিসেবে দেখা হচ্ছে। তারা বলছে, আফগানরা শত্রুর পক্ষ নিয়েছে, তাই তাদের চলে যেতেই হবে,” বলেন রাহিমি।