Published : 14 Jun 2025, 05:14 PM
১৯৮১ সালের ৭ জুনের বিকালে তখন ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকা সিনাই উপত্যকার এতজিওন বিমানঘাঁটি থেকে ছুটে গিয়েছিল ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর (আইএএফ) ১৪টি যুদ্ধবিমান।
দুই ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে তারা সেখান থেকে প্রায় এক হাজার ১০০ কিলোমিটার দূরে, বাগদাদের কাছে ইরাকের ওসাইরাক পরমাণু চুল্লিতে বিপজ্জনক, দূর পাল্লার এক সফল বিমান হামলা চালিয়ে ঘরে ফিরতে পেরেছিল।
ওই অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন অপেরা’, জানা ইতিহাসে যা প্রতিরোধমূলক সামরিক পদক্ষেপের সবচেয়ে বিতর্কিত উদাহরণগুলির একটি, বলছে এনডিটিভি।
ওই অভিযানের প্রায় সাড়ে চার দশকের মাথায় একই জুনে ইসরায়েল অনেকটা একইরকমভাবে ইরানি ভূখণ্ডের গভীরে দফায় দফায় বিমান হামলা চালালো। লক্ষ্য-তেহরানের পরমাণু স্থাপনা, যেন সেগুলো পারমাণবিক অস্ত্র না বানাতে পারে।
ইরাকের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা
১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে ইরাকের পারমাণবিক কর্মসূচি আকার নিতে শুরু করে। কিন্তু আদতে সাদ্দাম হোসেনের আমলে এসে ১৯৭০ এর দশকে এটি গতি পায়। ১৯৭৬ সালে ইরাক ফ্রান্সের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছায়, যেখানে প্যারিস বাগদাদকে ওসাইরাক নামের একটি ৭০ মেগাওয়াট গবেষণা চুল্লি সরবরাহে সম্মত হয়।
ওসিরাক নামটি এসেছে মিশরীয় পুরানের কিংবদন্তি চরিত্র ‘ওসাইরিস’ ও ‘ইরাক’ এ দুইয়ের সমন্বয়ে। ইরাকে এই চুল্লির নাম ছিল তামুজ-১। তামুজ-২ নামে আরেকটি ছোট প্রশিক্ষণ চুল্লিও বাগদাদের দক্ষিণপূর্বে তুওয়াইথা পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে নির্মিত হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) তথ্য মতে, এ চুল্লিগুলো বানানো হয়েছিল বেসামরিক উদ্দেশ্যে।
কিন্তু ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা এই সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হয় যে, একবার চালু হয়ে গেলে এই ওসাইরাককে দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে ব্যবহৃত মাত্রার প্লুটোনিয়ামও বানানো যাবে। যা তাদের ভাষায়, তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে আবির্ভূত হতে পারে।
১৯৭০ এর দশকের শেষের দিকে এসে ইসরায়েলি নেতৃত্ব মনে করে, একবার চুল্লিটি চালু হয়ে গেলে সেটিকে ধ্বংস করা খুব কঠিন হয়ে যাবে, কেননা তখন তেজস্ক্রিয়তাজনিত মারাত্মক দুর্যোগের ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং, কিছু করতে চাইলে আগেই করতে হবে।
হামলার পরিকল্পনা
পরিকল্পনা শুরু হয় তখনকার ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) চিফ অব স্টাফ লেফটেনেন্ট জেনারেল রাফায়েল এইতানের তত্ত্বাবধানে। কৌশলগত ও রাজনৈতিক কারণে অভিযান পরিচালনায় বারবার দেরি হয়।
শুরুর দিকে পরিকল্পনা ছিল, অভিযানে এফ-৪ ফ্যান্টম যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হবে। কিন্তু পরে ইসরায়েল আমেরিকার বানানো অত্যাধুনিক এফ-সিক্সটিন পেয়ে যায়। তখন পরিকল্পনা বদলানো হয়।
১৯৮০ সালের মাঝামাঝি ৮টি এফ-১৬এ যুদ্ধবিমানকে মূল আক্রমণকারী ধরে ছক সাজানো হয়, ছয়টি এফ-১৫এ থাকবে কভার ও ব্যাকআপ হিসেবে। অভিযানের জন্য এ যুদ্ধ বিমানগুলোকে চুপিসারে বৈরি রাষ্ট্রগুলোর আকাশসীমা পার হতে হবে, এবং সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে চুল্লিতে হামলা চালিয়ে শত্রু বাহিনীকে কোনো ধরনের লড়াইয়ের সুযোগ না দিয়েই ঘাঁটিতে ফিরে আসতে হবে।
যুদ্ধবিমানগুলোতে লাগানো হয় অতিরিক্ত জ্বালানি ট্যাংক। হামলাকারী বিমানগুলোকে এগোতে হবে খুব নিচ দিয়ে, মাটি থেকে বড়জোর ১০০ ফুট উপরে থাকতে পারবে, রাডার থেকে লুকিয়ে, নীরবে এগুতে হবে।
এক বাদশার সতর্কবার্তা
শেষ পর্যন্ত যে রুটটি চূড়ান্ত হয় সেটি হচ্ছে জর্ডান দিয়ে সৌদি আরবে ঢুকে উত্তরপূর্ব দিকে মোড় নিয়ে বাগদাদের দিকে অগ্রসর হওয়া। রুটটি বেছে নেন সেই সময়কার ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল ডেভিড আইভ্রি। রাডার এড়িয়ে যেতে এবং এবং ইরাকি আকাশ প্রতিরক্ষার সঙ্গে সংঘর্ষের ঝুকিঁ কমিয়ে আনতে এই পথই পছন্দ করেছিলেন তিনি।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ইসরায়েলি বিমানগুলো ঠিকই রাডারের চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও এক বাদশার নজর এড়িয়ে যেতে পারেননি।
জর্ডানের বাদশা হুসেন সেসময় ছুটি কাটাচ্ছিলেন তার রাজকীয় ইয়টে, তিনিই মাথার ওপরে ওই জেটগুলো দেখেই চিনে ফেলেন সেগুলোর উৎস, পথ বিবেচনায় বুঝে নেন যুদ্ধবিমানগুলো ছুটছে কোথায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার সরকারকে নির্দেশ দেন ইরাককে সতর্ক করতে।
কিন্তু তাতে হয় দেরি হয়ে যায়, কিংবা ওই যোগাযোগ শেষ পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি, যা-ই হোক বাদশার সেই সতর্কবার্তা আর বাগদাদ পৌঁছায়নি।
নিখুঁত হামলা
স্থানীয় সময় আনুমানিক বিকাল ৫টা ৩৫ মিনিটের দিকে ওই এফ-১৬ বিমানগুলো তুওয়াইথা কেন্দ্রের ওপর পৌঁছায়। প্রতিটি যুদ্ধবিমান ৫ সেকেন্ড বিরতিতে তাদের কাছে থাকা বোমাগুলো নিচে ফেলতে থাকে। হামলা চলে মাত্র ২ মিনিট। তাতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ওসাইরাক চুল্লিটি। ১৪টি যুদ্ধবিমান অক্ষত ইসরায়েলি আকাশসীমায় ফিরে আসে।
কৌশলগত দৃষ্টিতে দেখলে, এই অভিযান ছিল একেবারেই নিখুঁত।
আন্তর্জাতিক নিন্দামন্দ হয়েছে বিস্তর। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে প্রস্তাব ৪৮৭ পাস হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এটি ‘জাতিসংঘ সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’। এমনকি ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও এ ঘটনার প্রতিবাদে ইসরায়েলে সামরিক সরবরাহ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রেখেছিল।
ইরাক তখন বারবার বলেছিল, তাদের পরমাণু স্থাপনাটির উদ্দেশ্য ছিল একেবারেই শান্তিপূর্ণ। চুল্লিটি সরবরাহ করা ফ্রান্স ইসরায়েলি হামলার নিন্দাও জানিয়েছিল। সেসময় ওই স্থাপনায় ফ্রান্সের কিছু কর্মীও ছিল, কিন্তু অদ্ভূত ব্যাপার হচ্ছে, ইসরায়েলি হামলায় তাদের একজনও হতাহত হয়নি।
ইসরায়েলের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের যুক্তি ছিল, কোনো আরব দেশকেই কখনো পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর সুযোগ দেওয়া হবে না। যে নীতি পরে ‘বেগিন ডকট্রিন’ নামে বেশ পরিচিতি পায়।
কৌশলগত পরিণতি
১৯৮১ সালের ওই হামলার পর তার পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ না করে দ্বিগুণ করেছিলেন বলে ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় পাওয়া মার্কিন-ইসরায়েলি গোয়েন্দা তথ্যে দাবি করা হয়েছে।
আলোর মুখ দেখা সিআইএ প্রতিবেদন বলছে, পুরো ১৯৮০-র দশকজুড়ে ইরাক গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল।
এরপর ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকের পারমাণবিক অবকাঠামোর ওপর আরেকটি বড় আঘাত আসে।
প্রেক্ষাপট ইরান
২০০৫ সাল থেকেই ইসরায়েলের নেতারা ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে তার ‘অস্তিত্বের জন্য হুমকি’ হিসেবে দেখা শুরু করে। এর মধ্যে নেতানিয়াহুই অন্য যে কোনো নেতার চেয়ে ইরানি পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি প্রকাশ্যেই ‘অপারেশন অপেরার’ মতো অভিযান চালিয়ে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের আকাঙ্ক্ষা ভণ্ডুল করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল গোপনেও ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী এবং এর স্থাপনাগুলোতে নানান অভিযান চালিয়েছে; এসবের মধ্যে গুপ্তহত্যা তো ছিলই, ছিল স্টাক্সনেট ওয়ার্ম (ম্যালওয়্যার) দিয়ে সাইবার হামলাও।
তবে এতকিছুর পরও ইরানের পরমাণু কর্মসূচি অব্যাহত ছিল। তেহরান তাদের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মাত্রা অস্ত্র বানানোর মাত্রার কাছাকাছি নিয়ে গেছে বলে গত কিছুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলো নিয়মিত প্রতিবেদনও প্রকাশ করে গেছে।
তার মধ্যে টুকটাক অপ্রত্যক্ষ আলোচনা যে হয়নি, তা নয়। সর্বশেষ ওমানও মধ্যস্থতা করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান বের করার চেষ্টা করেছিল। যদিও এ নিয়ে উত্তেজনা সবসময় বজায় ছিল। যার ধারাবাহিকতাতেই ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় ব্যাপক হামলা চালাল ইসরায়েল। এখন এখানকার পানি গড়িয়ে কোথায় যায়, তাই দেখার বিষয়।