Published : 07 May 2025, 09:31 PM
হাসান হাফিজ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষটি দেখতে ছিলেন ঋষিতুল্য। আপাতদৃষ্টে রাশভারী ও গুরুগম্ভীর বলে মনে হয়। তিনি যে সুরসিক, কৌতুকপ্রবণ এক প্রাণোচ্ছ্বল সত্তা--তার প্রমাণ আছে ভূরি ভূরি। রবীন্দ্রনাথের নিকটজন ও সাহচর্যধন্য ছিলেন যাঁরা, তাঁদের স্মৃতিকথায় এসবের সরস, মনোগ্রাহী বর্ণনা উপস্থিত। রবীন্দ্রকৌতুকের বড় একটি বৈশিষ্ট্য হলো-তা কোনোমতেই স্থূল-চটুল নয়। সূক্ষ্ণ, পরিশীলিত এবং শিল্পগুণে ঋদ্ধ। গৌরচন্দ্রিকা থাকুক, মূলে প্রবেশ করি আমরা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সন্দেশের গল্প শোনার চাইতে সন্দেশটি হাতে হাতে পাওয়া ভালো।’
তৎকালে বিখ্যাত পত্রিকা ছিল ‘প্রবাসী’। সেই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রবাসীর জন্যে রবি বাবুর লেখা চাই। চারুচন্দ্র ছুটলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। কবি তখন জমিদারির তদারকি কাজে অবস্থান করছেন সেখানে। না, কুঠিবাড়িতে নয়। কবি ছিলেন পদ্মা নদীর বুকে, বজরায়--যেটির নামও ‘পদ্মা’। বোট থেকে নদীতট পর্যন্ত একটা সাঁকো রয়েছে। অনভ্যস্ত চারুচন্দ্র পা টিপে টিপে সেই সাঁকো পার হচ্ছেন। তার উদ্দেশ্য, সাঁকো পেরিয়ে কবি সান্নিধ্যে যাওয়া। বজরার ছাদ থেকে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চারুচন্দ্রকে বললেন,
চারু সাবধানে পা ফেলো। এ জোড়াসাঁকো নয়।
* * * *
কবি নিজেকে নিয়েও রসিকতা করেছেন। আশি বছরের আয়ু ছিল তাঁর। অন্তিম দিনগুলোতেও সৃষ্টিশীল ছিলেন নিরন্তর। জীবনের শেষ পর্যায়ে সামান্য ঝুঁকে উবু হয়ে লিখতেন। এটা দেখে কবির এক অনুরাগী বললেন, আপনার নিশ্চয় ওভাবে উপুড় হয়ে লিখতে কষ্ট হচ্ছে।
শুনে রবীন্দ্রনাথ তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর উত্তর দিলেন, তা তো হচ্ছেই। তবে কী জানো, এখন উপুড় হয়ে না লিখলে লেখা কী আর বেরোয়? পাত্রের জল তলায় ঠেকলে একটু উপুড় তো করতেই হয়।
* * * *
কত জনাই কত চিঠি যে লিখত কবিকে, তার শুমার করা মুশকিল। খ্যাপাটে এক লোকের চিঠি আসত। বড়সড় চিঠি। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে থাকত অনেক প্রসঙ্গ। আরো থাকত পত্রপ্রেরকের ঘর সংসার, সুখ-দুঃখ, আত্মীয় স্বজনের কথা। অসংলগ্ন, অপ্রাসঙ্গিক কথামালা সব। সেই পাগল তার লম্বা চিঠিতে বারবার কবিকে তার অস্তিত্বহীন বিষয় সম্পত্তি দানপত্র করে দিত।
ওই লোকের চিঠি এলে রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীদের মজা করে বলতেন,
দ্যাখো, এ-ই হচ্ছে আমার একমাত্র ভক্ত। যে তার সমস্ত সম্পত্তি বারবার আমায় দান করছে। তবে সম্পত্তিটা নিরাকার, তাই দানটা এত সহজ।
* * * *
মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একসঙ্গে নাশতা করছেন। প্রাতরাশে লুচি গান্ধীর পছন্দের আইটেম নয়। তাঁকে দেওয়া হয়েছে ওটসের পরিজ। রবীন্দ্রনাথ খাচ্ছিলেন গরম গরম লুচি। দেখে গান্ধী বলে উঠলেন,
গুরুদেব, তুমি জানো না যে তুমি বিষ খাচ্ছো।
রবীন্দ্রনাথ মজার উত্তর দিলেন এ কথার। বললেন,
বিষই হবে। তবে এর এ্যাকশন খুব ধীরে। কারণ আমি গত ৬০ বছর ধরে এই বিষ খেয়ে আসছি।
* * * *
দোল পূর্ণিমার দিনের ঘটনা। কবি নাট্যকার গীতিকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সঙ্গে কবির সাক্ষাৎ হয় সেদিন। নমস্কার বিনিময় হলো। তারপর দ্বিজেন্দ্রলাল পকেট থেকে বের করলেন রঙের কৌটো। আবির দিয়ে রঞ্জিত করে দিলেন কবিগুরুকে। না, তিনি রাগ করলেন না এতে।
হাসিমুখে বললেন,
এতদিন জানতাম দ্বিজেনবাবু হাসির গান ও নাটক লিখে সকলের মনোরঞ্জন করে থাকেন। আজ দেখছি শুধু মনোরঞ্জনই নয়, দেহরঞ্জনেও তিনি একজন ওস্তাদ।
* * * *
শান্তিনিকেতন--রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান। কবি নিজেও এই বিশ্ববিদ্যাপীঠে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রমথনাথ বিশী। একবার বিশী কবির সঙ্গে কোথাও যাচ্ছিলেন। ঘটনাস্থল আশ্রমের একটি ইঁদারা সংলগ্ন স্থান। সেখানে ছিল একটি গাব গাছ।
রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথকে বললেন,
জানিস, একসময়ে এই গাছের চারাটিকে আমি যত্ন করে লাগিয়েছিলাম। আমার তখন ধারণা ছিল এটি অশোক গাছ। কিন্তু গাছটি যখন বড় হলো, দেখি ওটা অশোক নয়, গাব গাছ।
কথাটি বলে তিনি প্রমথের দিকে তাকালেন। স্মিত হেসে আরেকটু যোগ করলেন,
তোকেও অশোক গাছ বলে লাগিয়েছি। বোধ করি তুইও গাব গাছ হবি।
* * * *
একদিন সকালবেলার ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ জলখাবার খাচ্ছেন। এলেন প্রমথনাথ। বসলেন গুরুদেবের পাশে। মনে মনে আশা, গুরুদেবের খাবারে যদি খানিকটা ভাগ বসানো যায়। তার মনোবাসনা পূর্ণ হলো। লুচি, মিষ্টি, ফল সবই জুটলো। বাকি রইলো শরবত। সোনালি রংয়ের শরবতের দিকে তার নজর। অন্য সব ক’টা দেওয়া হলেও এটা তিনি পাননি। গুরুদেব তাঁর শিষ্যের হাবভাব লক্ষ্য করলেন। বললেন,
কি হে, এই শরবত চলবে নাকি?
প্রমথ খুব রাজি। গুরুদেব তাকে বড় একটি গ্লাসে শরবত পরিবেশনের নির্দেশ দিলেন। যথারীতি এসে গেল বড় গ্লাসভর্তি সোনালি রংয়ের সেই পানীয়। প্রমথনাথ এক চুমুক পান করেই বুঝলেন, এটি হচ্ছে চিরতার রস!
* * * *
বাংলা বানান সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই কমিটির প্রস্তাবনায় বাংলা বানানের পুরনো রীতিনীতি পাল্টে নতুন নিয়মরীতি চালু করা হয়। কমিটি কাজ করতে গিয়ে ‘গরু’ বানান নিয়ে একটা সমস্যায় পড়ে। তারা ঠিক করে যে, ‘গরু’ না লিখে ‘গোরু’ লেখা উচিত। কারণ হচ্ছে এই শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত ‘গো’ শব্দ থেকে। আদিতে ‘ও’ কার, সে কারণে এখানেও ‘ও’ কার থাকা বাঞ্ছনীয়। বেশ ভালো কথা। কিন্তু গোল বেঁধেছে সব্বাই ‘ও’কার ছাড়া ‘গরু’ বানান লেখেন। বাংলাভাষী সব লেখক, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক--সকলেই।
কী করা যায়? এ সমস্যা কীভাবে দূর করা সম্ভব? কমিটি সিদ্ধান্ত নিল, এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত নেওয়া প্রয়োজন। দেখাই যাক, উনি কী বলেন। বহু ভাষায় পারদর্শী পণ্ডিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এই কমিটির প্রধান। তাঁর নেতৃত্বে কমিটির সবাই সদলবলে ছুটলেন শান্তিনিকেতনে। পৌঁছে সাক্ষাৎপ্রার্থী হলেন কবির।
রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল। তিনি জানতে চাইলেন আগমনের হেতু। সবিস্তারে বলা হলো তাঁকে। কমিটি তাঁর অভিমত জানতে চায়, জানানো হলো সেটাও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃদু হেসে বললেন,
তা, তোমাদের ও-কার দিয়ে গরু লেখার ব্যাপারে একটা সুবিধা হবে যে, আমাদের দেশের জীর্ণকায় হাড় জিরজিরে গরুগুলোকে অন্তত একটু মোটা ও তাজা দেখাবে।
* * * *
ভাণ্ডারে নামে একটি ছেলে সদ্য ভর্তি হয়েছে শান্তিনিকেতনে। কবিগুরুর সঙ্গে তখনও পরিচয় হয়নি ওর। একদিন রবীন্দ্রনাথ হেঁটে হেঁটে কোথাও যাচ্ছিলেন। তাঁর পরনে লম্বা আলখাল্লা। মাথায় টুপি। ভাণ্ডারে তাঁকে দেখে ছুটে গেল। কবির হাতে একটা আধুলি (আট আনা পয়সা) গুঁজে দিল সে।
অন্য ছেলেরা জিগ্যেস করল,
গুরুদেবকে তুই কী দিয়ে এলি?
ভাণ্ডারে অবাক হয়ে বলল,
গুরুদেব কোথায়? ও তো একজন ফকির। মা বলেছে, ফকিরকে কিছু দান করলে পুণ্যি হয়।
ভর্তি হওয়ার অল্পদিন পরেই স্পষ্ট হয়ে উঠল যে ভাণ্ডারে ভীষণ ডানপিটে একটা ছেলে। তার চোটপাট দৌরাত্ম্যে সবাই অস্থির। অতএব, নালিশ। খোদ গুরুদেবের কাছে। গুরুদেব ‘আসামি’কে ডেকে পাঠালেন। সে এসে হাজির হলে তাকে বললেন,
ভাণ্ডারে, তুই কত ভালো ছেলে। তুই একবার আমাকে একটা আধুলি দিয়েছিলি। কেউ তো আমাকে একটা পয়সাও কখনো দেয় না। তুই যদি দুরন্তপনা করিস, তাহলে কি চলে?
গুরুদেবের এ কথার পর ভাণ্ডারের দুরন্তপনা কিছুটা কমেছিল।
* * * *
শান্তিনিকেতনের ছেলেদের সঙ্গে অন্য এক প্রতিষ্ঠানের ছেলেদের ফুটবল খেলা। প্রতিযোগিতায় জিতেছে শান্তিনিকেতন। প্রতিপক্ষকে তারা আট গোল দিয়ে পরাস্ত করেছে। বিজয়ে সবাই আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত।
কবিগুরুও জানলেন বিজয়ের সংবাদ। মন্তব্য করলেন,
জিতেছ ভালো। তা বলে আট গোল দিতে হবে? ভদ্রতা বলেও তো একটা কথা আছে!
* * * *
একবার এক সাহিত্য সভা চলছে। রবীন্দ্রনাথ সেখানে উপস্থিত। ওই সভায় ছিলেন সাহিত্যিক বনফুল। তাঁর আসল নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। বনফুল সেখানে চমৎকার বক্তৃতা দিলেন। সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করলেন,
বলাই তো ভালো বক্তৃতা দেবেই।
কারণ বলা-ই তো ওর কাজ।
বনফুলের এক ছোট ভাই শান্তিনিকেতনে এসেছেন। উদ্দেশ্য, বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা করা। শান্তিনিকেতনের কারো কাছ থেকে তিনি শুনেছেন যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজকাল কানে একটু কম শোনেন।
তো, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেছেন নবাগত এই ছাত্রটি। কবিগুরু তাকে শুধালেন,
কী হে, তুমি কী বলাইয়ের ভাই কানাই নাকি?
ছাত্রটি চেঁচিয়ে জবাব দিলেন,
আজ্ঞে না, আমি অরবিন্দ।
রবীন্দ্রনাথ তখন হেসে উঠে বললেন,
না, কানাই নয়। এ যে দেখছি একেবারে সানাই।
* * * *
একবার কবির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে এক বৈজ্ঞানিকের পুত্র। ছেলেটি স্বাভাবিক নয়, মাথায় গোলমাল আছে। কবির কাছে তার আবদার, কবিকে সে ‘হাপু’ গান শোনাবে।
আচ্ছা। সম্মতি দিলেন কবি। ধৈর্য ধরে মনোযোগ দিয়ে ছেলেটির গান শুনলেন তিনি। ছেলেটি বিদায় নেওয়ার পর বললেন কবি,
গানই বটে, একেবারে মেশিন গান।
০৬ মে ২০২৫