Published : 27 May 2019, 12:20 AM
চিত্রকর্ম: মোহাম্মদ ইকবাল
প্রায়শ্চিত্ত
জল নয়, অন্যের কথায় অম্ল ঢেলে বসে আছি তুলসীর মূলে।
এখন তাহলে!
হতে তো হবেই তবে নিমিত্তের ভাগী।
একে তো পুরনো পাপী, তদুপরি ফেরারি ও দাগি।
কুঁড়ি থেকে প্রস্ফুটন অব্দি
প্রতিটি পর্বের গায়ে কৃত পাপচিহ্নসহ পাতকীর
নাম-দস্তখত করে পাঠিয়ে দিয়েছি প্রায়শ্চিত্তরূপে।
খাম খুলে দেখে নিয়ো প্রকৃতির।
ভাবাধিনায়ক
তোমার উৎফুল্ল হরতনের রাগরক্তিম ব্যঞ্জনা এসে লাগে আমার সাজানো তাসে।
কী ভাব জাগালে ওহে ভাবাধিনায়ক,
আকাশে বাতাসে আর আমাদের প্রথাসিদ্ধ তাসের সংসারে!
ফুটে ওঠে লজ্জারং, জেগে ওঠে রংধনুরূপ, ব্যাকুল তাসের সেটে।
হে ভাবের কম্যান্ডার, বোঝা ভার এ হরতনি লীলাটি তোমার।
রক্ত-প্রভা-ফুটে-ওঠা স্পন্দমান তাসকেই করেছ হে তুরুপের তাস–
অব্যর্থ, মোক্ষম।
পুনরায় টেক্কা মেরে দিয়েছ ঘায়েল করে সব উপশম, একদম।
পূর্বাভাস
যখনই যেখানে দেখা হয়ে যায় অতর্কিতে তোমার-আমার,
তাকাও আড়চোখে– দ্রুত, চোরাগোপ্তা, এবং ধারালো।
আর তাকিয়েছ যতবার,
ততবারই ছুটে গেছে একটি করে স্পন্দন, দুস্থ হৃৎপিণ্ডের আমার।
এভাবেই, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই, কমে আসে হৃৎস্পন্দ
দেখা দেয় নিম্নচাপ, ঘন-ঘন পূর্বাভাস– কুলকীর্তিনাশা জলোচ্ছ্বাস…
ক্রমেই উত্তাল হয় ভূমধ্যসাগর
অচিরেই ভেসে যায় যা-কিছু স্থাবর, অস্থাবর।
প্রশান্তি
যখনই বাসায় আসে মায়ের পুরনো সেই প্রেমিক, শিশুটি বোঝে–
এ নিঃসীম নরকসংসারে
ওই স্নিগ্ধ সম্পর্কটুকুই যেন একপশলা মায়াবী শুশ্রূষা,
তার চিরবিষণ্ন মায়ের।
একখণ্ড নিরিবিলি রঙিন সুগন্ধদ্বীপ
মায়ের এ রং-জ্বলা নিষ্করুণ নিজস্ব ভুবনে।
স্রেফ, স্রেফ কিছুটা সময় হাসিখুশি দেখবে মাকে, শিশু তাই দ্রুত গিয়ে
সিডিতে চালিয়ে দেয় সেই গান,
যে-গান গেয়ে ওঠে চিরন্তন প্রেমিক-প্রেমিকা
চাঁদনি রাতে, প্রশান্ত নদীতে, দু-পা মেলে দিয়ে, ছইয়ের ওপরে।
এইসব ছোট-ছোট প্রসন্ন মুহূর্ত, মধুক্ষণ
ধীরে ধীরে গিয়ে গেঁথে যায় এক বিষণ্নবিপুল মহাকালে।
সার্থক হয় মায়ের প্রণয়, মর্মী সন্তানের সহযোগ পেলে।
জাদু
কে যে কার আগে চলে যাব
তুমিও জানো না, আমিও তো তা-ই।
যদি আমি আগে যাই, থাকবে না কোথাও কোনোই পরিতাপ
আমার তো আজন্ম স্বভাব, শখ, ছড়িয়ে পড়ার!
কণা-অনুকণা হয়ে ছড়িয়ে পড়ব ধীরে ধীরে
মনোরম জলবায়ু হয়ে ঘিরে থাকব তোমাকে।
আর যদি তুমি আগে যাও,
প্রকৃতিশাস্ত্রের সব বিধি ব্যর্থ করে দিয়ে
তোমার বেরিয়ে যাওয়া অভিমানী প্রাণবায়ু স্নিগ্ধ পরমায়ু
মুহূর্তের মধ্যে আমি ফিরিয়ে আনব
ঠিকঠিক তনুতে তোমার।
নির্ঘুম নক্ষত্র সাক্ষী, আমি জন্ম-জন্মান্তর সাধনায়
আয়ত্ত করেছি এই প্রাণ-ফেরানোর জাদু, করণকৌশল।
প্রদক্ষিণ
শূন্য আর এক, এক আর শূন্য–
অবিরাম এই একেশ্বর আর নিরীশ্বরে যেন পালাক্রমিক বিশ্বাস,
মাত্র দুই অঙ্কের এই মাধব-মাধবী জলকেলি, বোঝাপড়া, নর্মলীলা…
স্রেফ এই দ্বিবীজ বিশ্বাসে, এই দ্বিরাঙ্কিক বিন্যাসেই
দ্রুত গড়ে উঠেছে সংকেতবদ্ধ এক
পরাক্রমী ডিজিটাল সিস্টেম, প্রবুদ্ধ অঙ্কতন্ত্র।
তামাম দুনিয়া জুড়ে বিছানো এ মহাকায় আন্তর্জাল, এ উপাত্তমণ্ডলের মেঘ
সবকিছু ছিঁড়ে-ফুঁড়ে ঠিকরে পড়ছে আজ
স্পষ্ট, আর কারো নয়, কেবল তোমারই স্মিত মুখের কিরণ।
তোমার পশ্চিমে প্রসন্নতা, উত্তরে প্রতিভাপ্রসাদ, দক্ষিণে লাবণ্যশ্রী,
নৈর্ঋতে স্নেহসংকেত, ঈশানে বাৎসল্যবলয়, পূর্বে মেধাসরোবর…
তোমার হিরণ্যসম কিরণের কসম, তোমাকে কেন্দ্র করে অচিরেই
ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রদক্ষিণ করতে থাকব আমি, আমরা
আর আন্তর্জালের উদ্বেল পুঞ্জমেঘ।
আগুন
জ্বলিনী, জ্বালিনী– দুই রূপ আগুনের।
তা দেখতে ফিরে ফিরে আসে যত চোরাই মোমবাতি
কী-এক নিষিদ্ধ আবগারি উন্মাদনা নিয়ে
মন-নাজুক-করা বাউরি বাতাসের দিনে
অসংখ্য উড়ন্ত চোরপতঙ্গের ভিড় ঠেলে ঠেলে।
চিরকুট
বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েছিলে চিরকুট
না-জানি-সে কতকাল আগে!
কত দেশ, কত ঋতু, কত বিচিত্র বাতাস!
মন্থর, ব্যাকুল, বাউরি, ঝোড়ো, হু-হু, হিমেল, মৌসুমি…
একে একে সব রকম বাতাসে ভর করে,
বহু দেশ ঘুরে-ফিরে শেষে
আমারই সামনে দিয়ে যেই ভেসে যাচ্ছিল তোমার
সেই হস্তলিপি, অমনি ধরে ফেলেছি তা হালকা হস্তক্ষেপে।
দেশ থেকে দেশে অবিরাম ভেসে চলবার কোনো এক ফাঁকে
মিদাসের মৃদু স্পর্শ বোধহয় পেয়েছিল তোমার পাঠানো
সে-চিরকুটের আঁকাবাঁকা অক্ষরস্রোত।
তাই তো সে-স্রোত যেন কীরকম সোনালি-সোনালি!
পশ্চিমের আকাশটা আজ হৈম, সুবর্ণসংকাশ।
যোগিনী ও মাছরাঙা পাখি
যোগিনী, কী যোগ করলে তবে এ-সন্ন্যাসে,
এই অবিবাহে, এই অসংসারে?
নিরঙ্কুশ এ-ঘনসংশয়ে?
আর ওহে রঙ্গনের ঝোপে বসে-থাকা মীনরঙ্গ পাখি, তোকেও তো বলি,
এ ঊর্মিকুমার ঘাটে প্রতিদিন আসে কত
রূপস্বিনী রজকিনী বউমাছ বসন্তকুমারী–
প্রগলভা রঙিলা আর বিলোল ব্যাপিকা কত চঞ্চলা শঙ্খিনী
এতসব ছেড়ে কেন যে জ্বালাস শুধু তাকে,
শান্তশুভ্রা ওই যোগিনীকে!
যোগাযোগ
গোলার্ধ দূরত্বে থাকো তুমি, প্রতিপদ দ্রাঘিমায়।
যখন সেখান থেকে কথা বলো দিনের বেলায়
সে-কথারা আসে মহাসাগরের তলায় বিছিয়ে-রাখা এক
স্ফূর্ত আলোতন্তুর ভেতর দিয়ে।
তাই তো তোমার স্বর কীরকম ভেজা-ভেজা ব্যঞ্জনাবহুল,
উচ্ছল মৎস্যকন্যার লাস্যভরা বুদবুদের সুগন্ধ-জড়ানো!
পক্ষান্তরে রাতের বেলায়
তোমার কথারা আসে উল্কার উষ্ণতা নিয়ে।
সারা গায়ে তারা-জ্বলা উল্কি, কিন্তু নিঝুম নির্জন এক কথার সিরিজ।
সে-কথারা আসে
দূরের আকাশে ছেড়ে-রেখে-আসা বিষণ্ন অনাথ উপগ্রহে প্রতিহত হয়ে
অন্ধকারে, সন্তানসন্ততিসহ, দাঙ্গাবিতাড়িত সারি-সারি শরণার্থীদের মতো
রুক্ষ সান্ত্রিসেপাই ও কাঁটাতার-কবলিত অনেক সীমান্ত পার হয়ে।