Published : 02 Jul 2025, 06:32 AM
২০১৬ সালে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করতাম আমি। অফিস ছিল বারিধারা ডিওএইচএসে, আর বাসা মগবাজারে। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার রুটিন ছিল প্রতিদিন গুলশান ২ পর্যন্ত হেঁটে এসে ‘ঢাকার চাকা’ বাস ধরা। আমাদের অফিস থেকে হেঁটে আসার পথেই পড়ত হোলি আর্টিজান বেকারি।
২০১৬ সালের ১ জুলাই, শুক্রবার। ছুটির দিনে সারাদিন বাসায় থাকলেও সন্ধ্যার পর বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়েছিলাম। তখনই খবর পেলাম—হোলি আর্টিজান অবরোধ করেছে একদল সন্ত্রাসী এবং সেখানে দেশি-বিদেশি বহুজনকে জিম্মি করে রেখেছে তারা এবং তাদের সঙ্গে গোলাগুলিতে পুলিশ আহত হয়েছে।
খবর পেয়ে দ্রুত বাসায় ফিরে টেলিভিশনের সামনে বসলাম। বোধ হয় সেই রাতে বাংলাদেশের লাখো মানুষ টেলিভিশনের সামনে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশিরাও কাটিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। টেলিভিশনে দেখলাম, পুলিশ, র্যাব ও আধা সামরিক বাহিনীর কয়েকশ সদস্য ঘটনাস্থলে পৌঁছে অবস্থান নিয়েছে। গুলিতে বনানী থানার ওসি মোহাম্মদ সালাউদ্দীন আহত হয়েছেন খবরে দেখাচ্ছিল, পরে অবশ্য তিনি মারা যান। সারারাত উৎকণ্ঠায় কাটল, পুরো দেশ প্রার্থনায় মগ্ন। মুহূর্তে মুহূর্তে নতুন খবর আসছিল। অস্ত্রধারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো যোগাযোগ করতে পারছিল না।
নিদ্রাহীন রাত পেরিয়ে ভোর হলো। তখন কমান্ডো বাহিনী সাঁজোয়া অভিযান শুরু করে। অভিযানে পাঁচ জঙ্গির সবাই নিহত হন। জানা গেল, জঙ্গিদের নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞে ১৮ বিদেশি নাগরিকসহ মোট ২২ জন নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। সারা দেশ শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ল।
এর আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক জঙ্গি হামলা ঘটেছিল। হোলি আর্টিজানের হামলা আগের সব জঙ্গি হামলাকে ছাড়িয়ে যায়। বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দীন ছাড়াও ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম —জীবন উৎসর্গ করেন জিম্মিদের রক্ষা করার চেষ্টা করতে গিয়ে। ওই আত্মঘাতী হামলাকারীদের সেই রাতেই আন্তর্জাতিক উগ্রবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) নিজেদের কর্মী বলে দাবি করে এবং হামলার দায় স্বীকার করে নেয়।
এই সব তথ্য কারোর অজানা নেই, তবু ব্যক্তিগত স্মৃতি মনে পড়ল ঢাকার পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর ‘জঙ্গি নাটক’ তত্ত্ব শুনে। হোলি আর্টিজান হত্যাযজ্ঞের সময় ক্ষমতাসীন সরকার এমন অনেক জঙ্গি নাটক সাজিয়েছিল বলে পুলিশ কমিশনারের দাবি পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিগত সরকার নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে রাখতে যে মাঝেমধ্যে নাটক করেনি, তা নয়। তবে হোলি আর্টিজান হত্যাযজ্ঞের মতো ঘটনা বানানো কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয়—সে ওই সরকার হোক আর এই সরকারই হোক।
তবে তৎকালীন সরকার আইএসের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করতে বহু গল্প সাজিয়েছিল। দেশে এমন আন্তর্জাতিক জঙ্গি আছে মেনে নিলে বিদেশের কাছে বিপণ্ন হওয়া লাগত। তাই ওই সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী হোলি আর্টিজানের ঘটনায় দেশীয় জঙ্গি সংগঠন ‘নব্য জেএমবি’ই দায়ী বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেছে। নব্য জেএমবি যে পুলিশের দেওয়া নাম, এ নিয়ে তখনও বিস্তর আলাপ হয়েছে যার যার ব্যক্তিগত পরিসরে।
হোলি আর্টিজানের পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অনেকগুলো জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালায়, অনেক জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করে, শতাধিক জঙ্গিকে হত্যা এবং বন্দি করে। বলা যায়, তখন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একপ্রকার ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি ন্যারেটিভ’ গড়ে তোলা হয়েছিল, যে সবের কিছু কিছু সাধারণ মানুষের কাছেও অতি-নাটকীয় বলে মনে হয়েছে।
১ জুলাই, ছিল হোলি আর্টিজান হত্যাযজ্ঞের ৯ বছর পূর্তি। আর সেদিনই ঢাকার বর্তমান পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী এক প্রশ্নের উত্তরে সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, দেশে নাকি ‘জঙ্গি নাই’। তিনি আশু কর্তব্য হিসেবে ছিনতাই ঠেকানোর ওপর জোর দিয়েছেন। তার ভাষ্য, “জঙ্গি থাকলে না জঙ্গি নিয়ে ভাবব। আওয়ামী লীগের সময় জঙ্গি নাটক সাজিয়ে ছেলেপেলেদের মারছে, কিসের জঙ্গি?”
তার এই বক্তব্য, আপাতদৃষ্টে নিরীহ মনে হলেও, গভীরভাবে রাষ্ট্রীয় কৌশল ও অতীতের ভাষ্যকে অস্বীকার করার ইঙ্গিত দেয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বকে নাড়া দেওয়া ঘটনা আজ ‘নাটক’ হয়ে যাচ্ছে! তাহলে তারই যে দুজন সহকর্মী সেদিন প্রাণ দিয়েছেন, তারা কি সাজানো নাটকের বলি হয়েছিলেন? পুলিশ প্রশাসন কি তাহলে রাষ্ট্রের ’মিথ্যা’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যম? যদি তা-ই হয় তাহলে তিনি তার নিজের অবস্থানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করলেন। আর যদি তা না হয়, তাহলে তার আজকের বক্তব্য সেই সত্যকে অস্বীকার করার কৌশল। যে কৌশল অবলম্বন করে তিনি বর্তমান সরকারের সময়টা নির্বিঘ্নে পার করে দিতে চাচ্ছেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন। অথচ বিগত সরকারের আমলে হয়তো তিনিও সেই সময়ের ‘জঙ্গি নাটক’ (তার ভাষ্য মতে) আয়োজনের অংশী হয়েছেন, কিংবা নীরব থেকে সুবিধা নিয়েছেন।
যে রাষ্ট্র এক সময় জঙ্গি দমনে ছিলো ‘জিরো টলারেন্স’ ভূমিকায়, সেই রাষ্ট্র এখন জঙ্গিবাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করছে। এই জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব অস্বীকার আদতে দেশের জন্য আরও বড় ক্ষতি বইয়ে আনবে। কেননা একটি সমাজের সমস্যা অস্বীকার করলে, তার সমাধানেরও কোনো পথ থাকে না। সরকার যদি সত্যিকার অর্থে জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব মুছে দিতে চায়, তাহলে তার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে তার মোকাবিলা করতে হবে।
মালয়েশিয়া সরকার ৩৬ বাংলাদেশিকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে এই সেদিন। আমরা দেখেছি অতীতে দেশে এমন অনেক জঙ্গি ধরা পড়েছে, যারা একসময় মালয়েশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছিলেন। এই বাস্তবতা কিন্তু বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের অস্ত্বিত্বকে আরও স্পষ্ট করে দেয়।
তাই আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র, বিশেষ করে পুলিশ বাহিনী, যারা পতিত সরকারের অধীনে ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে অনুগতভাবে কাজ করেছে, যে সরকার প্রতিনিয়ত গুম-খুনের ঘটনাগুলোকে অস্বীকার করেছে-তারা কি সত্যিই বুঝতে পারছে না যে এই অস্বীকারের রাজনীতি দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে? নাকি তারা ইচ্ছাকৃতভাবে দেশকে সেই পথেই ধাবিত করতে চাইছে?
‘কপটতা’ একটি সমাজের নৈতিক কাঠামোকে ভেতর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত যখন কথার সঙ্গে কাজের মিল থাকে না, তখন মানুষের বিশ্বাসও ভেঙে পড়ে। ন্যায়ের মুখোশ পরে অন্যায় করা খোলাখুলি অন্যায় করার চেয়েও বিপজ্জনক। কারণ অকপট অসাধুদের চেনা যায়, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়—কিন্তু কপট সাধুদের চিনতে ভুল হলে সমাজ ধ্বংস হয় নিঃশব্দে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “সংসারে সাধু-অসাধুর মধ্যে প্রভেদ এই যে, সাধুরা কপট আর অসাধুরা অকপট।” আজকের বাংলাদেশে রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি—প্রতিটি অঙ্গনেই এই কপটতা একটি কৌশলে পরিণত হয়েছে। এখানে অতীতের ভয়াবহ সত্য অস্বীকার করা হয়, আর ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা মানুষরা ক্ষমতা পেলে হয়ে ওঠে বিপরীত সুবিধাভোগী।
অতিসম্প্রতি প্রকাশিত আরো একটি সংবাদ রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি অঙ্গনে কপটতা ও স্ববিরোধিতার এমন এক বাস্তবতার উন্মোচন করেছে। সংবাদটি হলো চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমা মুক্তির প্রসঙ্গে। ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমাটি হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার অনুপ্রেরণাতেই নির্মিত। সিনেমাটি একাধিক আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে, পুরস্কার জিতেছে। এমনকি মুক্তি পেয়েছে ভারতের ওটিটি প্লাটফর্মেও। কিন্তু বিগত ৬ বছরেও বাংলাদেশে মুক্তি পায়নি। নানা টালবাহানার পরে বিগত সরকারের আমলে সেন্সর বোর্ড ও আপিল কমিটি ছাড়পত্র দিলেও, রহস্যজনক কারণে তার মুক্তি আটকে ছিল। আটকে আছে এখনও যখন সিনেমাটির নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী স্বয়ং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা।
সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পাওয়ার, অর্থাৎ বিগত সরকারের শাসনামণে সেন্সরবোর্ডে আটকে থাকা অবস্থায় সিনেমাটির মুক্তি নিয়ে তিনি যেভাবে সরব ছিলেন সেন্সর পাওয়া এবং নিজে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরও এখন অবিশ্বাস্য রকম নীরব। এমনকি সিনেমাটির মুক্তি প্রসঙ্গে তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্যও দিচ্ছেন না। কোনো এক রজস্যজনক কারণে এসব নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে তিনি কথা বলেন না। মর্জি হলে বিভিন্ন প্রসঙ্গে তিনি কখনও-সখনও সংবাদ সম্মেলন ডাকেন বটে, তবে সাংবাদিকের উপস্থিতি আশাব্যঞ্জক না হলে নিজের ডাকা সংবাদ সম্মেলনে নিজেই আসেন না। কিছুদিন আগে ফেইসবুকে এটা-ওটা লিখতেন, আজকাল তাও লিখেন না বলে মনে হচ্ছে।
’শনিবার বিকেল’ নিয়ে ফারুকী এক সময় ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠ। তার সঙ্গে প্রতিবাদে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের আরো অনেকেই। তখন সংবাদ সম্মেলনে ফারুকী উচ্চকণ্ঠে বলেছিলেন, ’’শিল্পকর্ম হল হেডলাইটের মত। হেডলাইট বন্ধ করে যদি ভেবে নেন সামনে কোনো বিপদ নাই, তাহলে ভুল করবেন। বরং হেডলাইট জ্বেলে দেখুন, ঠিক পথে আছেন কি না?” আর এখন নিজে চালকের আসনে বসে থাকা সত্ত্বেও তিনি সেই হেডলাইট জ্বালাচ্ছেন না। এতে কি তিনি সংস্কৃতি অঙ্গনকেই ভুল পথে পরিচালিত করছেন না?
এই যে দ্বিচারিতা, এটি শুধু কোনো একজন ব্যক্তিকে নয়, বরং বৃহৎ প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতিজীবিদের নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
হোলি আর্টিজান হামলা কি তাহলে সাজানো ঘটনা ছিল? এমন প্রশ্নের উত্তরে সাজ্জাত আলী যখন বলেন, “ওটা সম্পর্কে আমি জানি না; তবে বাংলাদেশে কোনো জঙ্গি নাই। বাংলাদেশে পেটের দায়ে লোকে ছিনতাই করে।” আর ‘শনিবার বিকেল’ মুক্তি নিয়ে খোদ নির্মাতা কিছু বলতে চান না, তখন এই দুটি বিষয়ের মধ্যে সমাপাতন পাওয়া যায়। দুটি ক্ষেত্রেই অতীতের বাস্তবতাকে অস্বীকার ও এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে এবং একই সঙ্গে যারা একসময় প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিলেন, তারাও এখন ক্ষমতায় এসে নীরব থাকছেন বা বিপরীত ব্যখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। তাদের ভাষা ও কৌশলের এই যে কপটতা, তার প্রভাব কি তারা অনুধাবন করতে পারছেন না? তারা কি বুঝতে পারছেন না যে, এই কপটতা শুধু নৈতিক বা রাজনৈতিক প্রশ্নই তোলে না, বরং আমাদের সম্মিলিত স্মৃতি, আত্মত্যাগ ও শিল্পের স্বাধীনতার বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ছাপ পড়েছে দেশের প্রতিটি স্তরেই। তাই প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক—উভয় স্তরেই এখন সত্য বলা ও সত্যকে মেনে নেওয়ার সাহস থাকা অত্যন্ত জরুরি। নয়তো, এই কপটতা শুধু অতীত নয়, আমাদের ভবিষ্যৎকেও গিলে খাবে।