Published : 25 Nov 2010, 05:25 PM
'কী খাবেন দরবেশ বাবা?' অতি পুরাতন চায়ের দোকানের দোকানি তাঁর শরীর আমার দাড়িওয়ালা মুখের উপর প্রায় পুরোটা ঝুঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি একটা লুঙ্গি আর কুর্তা ধরনের শার্ট পরে আছেন। তার সাথে গলায় আছে গোলাপি কিসিমের প্রায় বিবর্ণ হয়ে-আসা একটা সুতো, কোনো মাজার থেকে আনা হবে। তাঁর নিশ্বাসে আবছা একটা সিদ্ধির গন্ধ। আমি বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম, কিন্তু মুখের হাসিটা ছাড়লাম না।
'চা! এক কাপ চায়েই আমার চলবে।'
কিন্তু আহসান আমার তরফে একটা প্রতিবাদ করা জরুরি মনে করল।
'দেখেন, উনি কিন্তু আমাদের শিক্ষক।' ও বলল। কিন্তু দোকানির তা নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা হলো বলে মনে হলো না। ক্যাশবাক্সের দিকে হেঁটে গেলেন, একটা ছোট ছেলে ওয়েটার–তাকে হুকুম করলেন আমাদের দু'কাপ চা দিতে, তারপর বিড়বিড় করলেন প্রায় আপনমনেই 'কিন্তু আমার দোকানে এসে কিছু একটা খাওয়া উচিত ছিল আপনার।'
প্ল্যাস্টার চটে গিয়ে দেয়ালের জায়গায় জায়গায় নাঙ্গা হয়ে বেরিয়ে গেছে, মাথার উপরে গোকুলে কৃষ্ণ একটা এক পৃষ্ঠার ক্যালেন্ডার ঝোলানো, আর তার পাশে বাবা লোকনাথ-এর একটা ফ্রেম-বাঁধানো ফোটো। আমরা একটা নিচু বেঞ্চে বসে, আর আমাদের সামনে আঁকাবাঁকা একটা লম্বা উঁচু বেঞ্চ টেবিলের কাজ করছে, হাইস্কুলে যেমনটা হতো। ৬০ ওয়াটের বাতিটা টিমটিমে আলো দিচ্ছে, ধোঁয়ার একটা চক্রাকার জাল, সাথে মাকড়শার জাল আর পিছনে ঘন ভাঙাচোরা দেয়ালের পশ্চাদপট সবকিছু মিলে থিয়েটারের কোনো এক দুর্দান্ত লাইট ডিরেক্টরকে মনে করিয়ে দেয়।
নভেম্বরের শুরুর দিকের সন্ধাকালীন ধোঁয়াশা, ক্রমাগত ঘন হয়ে আসছে। রমজানের প্রথম সপ্তাহ। আমরা যখন চায়ের জন্য অপেক্ষা করছি, আমার মনে হলো, আহসানের কথা বলা দরকার ছিল না। দোকানের ছেলেটা চায়ের কাপে চামচ দিয়ে শব্দ করে ঘুঁটছে আর দোকানি তাঁর সিদ্ধির প্রভাবেই হয়তো ঘুমঘুম চোখে উদাস তাকিয়ে আছেন, আমার মনে হলো দরবেশ কেন নয়? দরবেশ বাবা উপাধি নিলে সমস্যার কী আছে? আমার মাথায় বরাবরের মতো নানান জিজ্ঞাসা ভর করতে লাগল: একজন দরবেশের কী এমন আছে যা আমাদের বাকিদের নেই? অথবা, ধরা যাক একটু এ্যাকাডেমিকভাবে ভাবলে,কী বিশেষ বৈশিষ্ট্য যা দরবেশের রয়েছে বলে লোকজন ভাবেন? অধিকন্তু, এসবের উত্তরই বা কে জানেন? বলাই বাহুল্য, দরবেশরা নিজেরা তো আর এসবের উত্তর আলোচনা করতে বসছেন না! বিষয়টা কেবল আমার মুখের দাড়ি নয়, আমি নিশ্চিত, বরং যে বিশেষ ধরনের দাড়ি আমার, এর বিশৃঙ্খল বিন্যাস। কোনো ধরনের নাগরিক শৈলী বিবর্জিত দশা আমার দাড়ির যা এই দোকানিকে উদ্বুদ্ধ, বা হয়তো প্রলুব্ধ, করেছে আমাকে বিশেষ সম্মানসূচক উপাধি দিয়ে ডাকতে। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়েছিল যে তাঁকে জিজ্ঞেস করি তিনি কোনো স্থানীয় পীরালি পন্থার অনুসারী কিনা, কিংবা অন্য কোনো তরিকার সমর্থক। কিন্তু শেষমেশ আর জিজ্ঞেস করলাম না। আমি নিজেও তো একটা উন্নয়ন তরিকারই লোক। স্থানীয় কোনো দরবেশ সম্বন্ধে জানতে না চেয়ে বিনিময়ে আমি অবশ্যই আশা করলাম যে আমাকেও জিজ্ঞেস করা হবে না যে আমি বিশেষ কোনো এনজিওতে কাজ করি কিনা।
এক শাহ মখদুমের নাম জানা ছাড়া আমি উত্তর বঙ্গের দরবেশ-সন্ন্যাসীদের সম্পর্কে কিছুই প্রায় জানি না। কিন্তু এই নীলফামারীতে বসে, রংপুরের কোল ঘেঁষে, তেমন কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার না যে বহু দরবেশ-আউলিয়া এখানে আছেন (ছিলেন), এবং একেক তরিকার বিশাল ভক্তকুলও থাকবেন। একভাবে চিন্তা করলে, সাধু-সন্ন্যাসী-পীর-দরবেশ বাংলাদেশের প্রাণ। যে মুহূর্তে আপনি ঢাকা থেকে বের হলেন, আপনি নানাবিধ আধ্যাত্মিক আর মরমী চিন্তাধারার এক জটিল মোজাইকের মধ্যে প্রোথিত। এর বাইরে আর কিছুই প্রায় জানি না। এমনকি এই অনুমানও কি আমার ঠিক? বাংলাদেশের এই দিকটি সম্পর্কে আমি কতটুকুই বা জানি? আসলে আমি জানি না, এবং এই অজ্ঞতা আমাকে সন্ত্রস্ত করে তুলল, যেন আমি আমার এ্যাকাডেমিক সজাগতা হারাতে বসেছি, কিংবা নৃবিজ্ঞানে আমার প্রশিক্ষণ।
চায়ের কাপ বেশ ছোটই ছিল, শেষ করতে বিশেষ সময় লাগল না। এর মানে দাঁড়াল বেশিক্ষণ চায়ে চুমুক দিয়ে আর এসব সাত-সতের ভেবে সময় কাটানো আমার সম্ভব হলো না। কী করা উচিৎ, আরেক কাপ চা চাইব কি? নাকি আদি নিমন্ত্রণ অনুযায়ী সিদ্ধিই চেয়ে বসব? বেশ দ্বিধাগ্রস্তভাবেই আমি ভাবলাম। পাশে-বসা আহসানের মুখের দিকে চাইলাম, আমার দিকে প্রায় সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে।
সৌভাগ্যক্রমে, দোকানি তাঁর সংশয় কাটাতে পারলেন এবং আমাকে একটা সন্দেশ খেতে বললেন। আমি আসলে আরেক কাপ চা খেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু বিনিময়ে এই প্রস্তাবে খুশিই হলাম। খানিক পর চায়ের দোকান থেকে বেরোলাম মুখে একটা মিষ্টির স্বাদ নিয়ে। আঁধার-মাখা আলোতে, ধোঁয়া আর মাকড়শার জাল আমার পিছনে তখনো বোনা হয়ে চলেছে, আর তাতে দোকানটাকে একটা রহস্যকুঠুরি বানিয়ে রেখেছে। আমার মনে হলো, গোটা শহরটাই বুঝি এরকম, রহস্যময় প্রায়, অবোধগম্য এক অচিনপুর, যেন এটা আরেকটা মফস্বল শহরই, যেন এটা আরেক মেহেরপুর, যেখানে আমি বড় হয়েছি, যেন বা এটা নীলফামারী নয় কিছুতেই। দুটো ছোট শব্দ, দরবেশ আর বাবা, মনে হয় আমার ভিতর গভীর এক মেটামরফসিসের কারণ হয়েছে। আমার এও মনে হলো, যে উন্নয়ন দলের সঙ্গে কাজ করতে আমি এসেছি তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ মোটেই সহজ হবে না এখন। খানিক বিষাদ লাগল, যদিও জানি না কেন।
গতকালই নীলফামারী এসেছি, গবেষণা দলের অন্য আট জনের সঙ্গে যুক্ত হতে। সূর্য ওঠার অনেক আগে, তখনও গভীর অন্ধকার চারদিকে। উন্নয়ন সংস্থার জেলা অফিসটি দারুণ জায়গায় বানানো। সত্যি কথা বলতে কি, যে কারোর পক্ষেই বোঝা বেশ কঠিন এটা কোনো শহুরে নাকি গ্রামীণ এলাকা, যেটা অবশ্য ঢাকার বাইরে অধিকাংশ এনজিও অফিসের ক্ষেত্রেই হবে। মেহমানখানা অফিস বিল্ডিংয়ের মধ্যেই। দলটা এখানে এক মাস থাকবে, আমারটা মাত্র দু'দিনের সফর। এটাও এনজিও'র সামাজিক গবেষণার সাধারণ রেওয়াজ যে দলপ্রধান অল্প সময়ই মাঠে থাকবেন। আমাদের দলটা কাজ নিয়ে খুব উত্তেজিত। এটা বুঝতে কষ্ট করতে হলো না। সেহরির পর দু'ঘণ্টাও ঘুমিয়েছে কিনা সন্দেহ, অথচ ওই শেষরাতে আমার পৌঁছানোর পর ওদের অন্তত দু'জন তখনই একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য আড্ডাতে বসে গেল। কারোরই মাথায় এল না যে আমার ঘর দেখিয়ে দেবে, যেটা ঘটনাচক্রে—ভিআইপি–র হবার কথা, এবং একমাত্র খালি ঘর তখন। এই অফিসের মানুষজন, যাদের সঙ্গে পরে আমার দেখা হয়েছে, আমার এই অদ্ভুত ধরনের নেতৃত্বপ্রদান নিয়ে বিস্মিত। আমি নিজেও খানিক বিস্মিত হলাম, তবে একদম ভিন্ন কারণে। রমজান মাস, সহকর্মীদের কেউ কেউ রোজা রাখছেনও বটে, এবং আমি হিন্দু হওয়াতে আমার কাছে যদিও রোজা-রাখা কেউ আশা করছেন না, তারপরও আমার মনে হচ্ছিল খাবার চাওয়া বা খাওয়া বোধহয় একটু দুর্বিনীত হবে। এদিকে খিদেয় আমার জান যাবার যোগাড়। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি যে টেবিলে–পরাটা, ভাজি, মিষ্টি–স্থায়ী এক রাধুঁনি দিয়ে সবকিছু রান্না করানো। আমার চোখমুখের খুশি চেপে রাখা গেল না।
শেষমেশ, যখন আমি বললাম যে ভিআইপি ঘরটা নিয়ে আমি কিছুতেই স্বস্তি পাব না, আমাদের একমাত্র নারী সহকর্মী ঘরটা পেলেন যেহেতু এতে সংলগ্ন বাথরুম রয়েছে। আমি অন্যান্যদের সঙ্গে একটা ঘর ভাগাভাগি করে থাকার ব্যবস্থা করলাম। সবাই যখন 'মাঠে' যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল, আমি জানালার পাশে গিয়ে বসলাম। কূয়াশার কারণে সূর্য দেখার কোনোই বন্দোবস্ত ছিল না, হলুদ একটা আলো বিবর্ণ গাছগুলোর মাথায়–কয়েকটা শিমুল, কয়েকটা নিম, আরও কিছু গাছ যেগুলো আমি চিনলাম না একদম। দৃশ্যাবলী কিছু দূরবর্তী স্মৃতি উস্কে দিল আমার মাথায়, কিছু স্মৃতি ধুলিধূসরিত, অথবা এমন কিছু স্মৃতি যা অবাস্তব, কেবলই আমার কল্পস্মৃতি। আমি সেই স্মৃতিমালাকে চমৎকার একটা কালকাঠামোতে ভরতে চাইছিলাম, একটা দৃশ্য যা আমার ভীষণ সম্মুখ, একেবারে চোখের কাছাকাছি। একটু একটু ভাপতে শুরু করলো সেটা।
'স্যার, আপনার গোসল করে একটু বিশ্রাম নেয়া উচিৎ।'– কেউ একজন জানালার পাশে চুপচাপ আমাকে বসে থাকতে দেখে বলল। আমার বেশ রাগ হলো যে আমার কোনো সহকর্মী ভাবতে পারে একটা রাতের বাসযাত্রাতে আমি ক্লান্ত বোধ করতে পারি। কিছু বললাম না যদিও।
'আমাদের সাথে যাচ্ছেন তো?'
আমি ঠিক বলতে পারলাম না যে তখন আমার একটুও বেরোতে ইচ্ছে করছিল না। ক্লান্তির কারণে নয়, কিন্তু জানালাটার পাশেই আমি বসে থাকতে চাইছিলাম আসলে। আহসান কৌতূহলী চোখে তাকাল: 'কেমন লাগছে স্যার,আপনার? ঠিকঠাক আছেন তো?'
'অবশ্যই। কী হবে আমার? আমি তো ইউরোপ থেকে আসা সাহেব না।'
'কিন্তু আপনি অনেক বছর ধরে ঢাকা আছেন।'
'আমি সারাক্ষণ ঢাকার বাইরে যাই। গ্রাম আমার কাছে উপন্যাস মাত্র নয়। আর এটা বিশেষ কোনো গ্রামও নয়। একটা জেলা শহর।'
'কিন্তু নীলফামারী ঢাকার থেকে খুব ভিন্ন।'
'সেটা তো আরেক প্রসঙ্গ। তবে আমি কিন্তু আপনাদের মতো ঢাকা শহরে বড়-হওয়া না, আমি মফস্বলের।'
'সেটা একদম ঠিক। কিন্তু উন্নয়ন মিশন নিয়ে একটা ট্রিপ, এনজিও'র একটা লোক হিসেবে… একটু আলাদা লাগে না? এর কি আলাদা একটা মানে আছে না?'
আমি ওর দিকে তাকালাম। আহসান বরাবরের মতো তীক্ষ্ম। এই সফরে আমার সংশয়ী অবস্থান ও খুব স্পষ্টভাবে বুঝেছে।
'হ্যাঁ। আলাদা মানে আছে। ব্যাপারটা এমন যেন প্রতিটা পদক্ষেপ আমার জাস্টিফাই করতে হবে এখানে। খুবই ক্লান্তিকর আহসান।'
'তাহলে আপনার কি মনে হয় যে আপনি সামাল দিতে পারবেন?'
'সম্ভবত আমার উচিৎ দুই টুকরা হয়ে যাওয়া।' আমি হেসে উত্তর করলাম। 'একটা যাবে মাঠ গবেষণায়। এবং অন্যটা এই ভ্রমণ উপভোগ করবে।'
পরে আমি গ্রামে গেছিলাম, যাতে করে সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের যা কিনা অবধারিত উপাচার তা পালন করা হয়: মাঠ কর্ম। সাথে আরও তিনজন সমেত একটা ভ্যান-রিকশা করে। ফিরবার পথে লিলি ওর ডিজিটাল ক্যামেরায় আমাদের ছবি তুলল। মারহাবা, একদম পারফেক্ট পিকচার, গ্রামবাংলার একটা পটভূমিকে পিছনে রেখে রিকশা ভ্যানের উপর গবেষণা দলের কর্মীরা বসা! লিলি এই ছবিগুলো ইতালিতে নিয়ে যাবে। নাকি ইউকে-তে, কি জানি? ক্যামেরার ছোট্ট এক বর্গইঞ্চি রূপালি পর্দাতে ও আমাদের ছবিগুলো দেখালো। এই যে আমি, সিগ্রেট খাচ্ছি, ভ্যানগাড়ির একপাশে আমার দু'পা দুলিয়ে দুলিয়ে, পশ্চাদপটে একটা বিরাট সবুজ সার দেয়া জমি। মথুরাতে কৃষ্ণ যেন মথুরাবাসীদের মুক্তি দিতে এসেছেন! এই ইমেজের চেয়ে আমার দ্বিতীয় সত্তার বড় প্রমাণ আর কী হতে পারত! একজন আন্ধা ঢাকাবাসী মুক্তিদাতা হয়ে গেলেন। এত রকম হাস্য-মস্করার মধ্যেও নিজেকে নিয়ে খুব আরাম বোধ করতে পারলাম না।
ফলে পরে বিকেলে যখন আমি শহরের এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি তখন রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম। 'তো আপনার এখানে হিরো কে ভাই?'
'এখানে?'
'হ্যাঁ, এখানে। ধরেন নীলফামারী। বা ধরেন উত্তরবঙ্গ।'
'আপনি হিরোর কথা জিগেস করলেন?' প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে আমাকেই জিজ্ঞেস করলেন।
'হ্যাঁ, মানে ওস্তাদ। গুরু। মানে আপনি কার সাকরেদ? আচ্ছা ধরেন কার কাছ থেকে আপনি বুদ্ধি-পরামর্শ নেন?'
'বুদ্ধি-পরামর্শ নেবার দরকার কী আমার?'
'হ্যাঁ, তাও তো কথা!' আমার একমত হতেই হলো। মাথা নাড়ালাম। রিকশাওয়ালাকে ঘণ্টা মেপে ভাড়া করেছি। আমাকে বলল যদিও সে আসলে দিনাজপুর জেলার, কিন্তু বাস্তবে তার গ্রাম নীলফামারী শহরেরই বেশি কাছে। এখানে সে তাঁর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে থাকে। বউ আর মেয়ে তখনো গ্রামের বাড়িতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'কেন?' সে ব্যাখ্যা করল। কারণ পুরো পরিবার নিয়ে সে এই শহরে থাকতে পারত না। যেহেতু ছেলেটা ভালো ছাত্র সেহেতু ছেলেটাকে লেখাপড়া করাতে এই শহরে তার থাকা লাগবে। ফলে বউয়ের সঙ্গে পরিকল্পনা করে এই ব্যবস্থা করেছে সে।
'তো আপনার ছেলে কই?'
এখন তাকে একটু শারমিন্দা মনে হলো। কিন্তু পরে বলল, 'এখন সে ঘরে পড়ালেখা করছে। একটা ঘর ভাড়া নিয়েছি আমি। গত মাসে ঘরে কারেন্ট নিয়েছি।'
'তাহলে সে এখানে পড়ালেখা করছে।'
'হ্যাঁ স্যার। সে তো এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। পরের বছর বৃত্তি দেবে আপনাদের দোয়ায়।'
আমি একটু চুপ মেরে থাকলাম। পরের প্রশ্নটা তাঁর কী হতে পারে আমি বুঝে গেছিলাম। অবশেষে, আরও কয়েক প্যাডেল চালাবার পর, সে জিজ্ঞেস করল। 'আপনি কি এনজিওতে চাকরি করেন?'
'হ্যাঁ।' আমার উত্তর ছোট।
'ঠিকই ধরেছি। আপনি তো ভাল বেতন পান, তাই না স্যার?'
'হ্যাঁ।'
'পড়ালেখা করলে আমার ছেলে কি আপনাদের এনজিওতে চাকরি পাবে একটা?'
রিকশাওয়ালার প্রশ্নের উত্তর এড়াতে পারলাম রাস্তার পাশে একটা মিষ্টির দোকান দেখে, এবং তাকে থাকতে বলে। আমি ভিতরে গেলাম। ফিরে যখন আবার রিকশায় এসে বসলাম, তাঁর আরেকবার প্রশ্নটা করতে ইচ্ছে হয়নি। এগুলো সব গতকালের ঘটনা।
এই সন্ধ্যায় ধোঁয়াশা-মাখা ওই চায়ের দোকান থেকে যখন বের হলাম, আহসান আর আমি গেইস্টহাউজের দিকে হাঁটা ধরলাম। ঢাকা যাবার বাস আমার আর ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে ছাড়বে। আহসানকে জানালাম রিকশাওয়ালার সঙ্গে আমার কথোপকথন, তার ছেলেকে এনজিও চাকরিতে ঢোকানোর ইচ্ছা। আহসান কোনো উত্তর করল না, অন্ধকারে আমিও বুঝলাম না যে ওর মুখে কী ভাবান্তর। ওকে এও বললাম যে নীলফামারী থেকে কিছুমিছু একটা নেব বলে সারাবেলা অনেক ঘুরলাম একটা বাঁশি কেনার জন্য, কিন্তু পাইনি।
'এখানে পাওয়া যাবে মনে করেছিলেন?' এই প্রথম সে কথা বলল।
'আসলে আমি ঠিক জানি না। ভাবলাম নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে, কিন্তু বাজারে কোনো দোকানে নেই। এখানে যদি কেউ বাঁশি বাজায় সে নিশ্চয় আরেক জেলা থেকে কিনে আনে না। যাকগে, বাঁশি দিয়ে কী হবে! বাঁশি তো আর খাওয়া যাবে না।' একটা বাঁশি খুঁজে না পাওয়াতে আমি আসলেই হতাশ ছিলাম।
হঠাৎ আচমকা আহসান আমাকে জিজ্ঞেস করল, 'দোকানদার যখন আপনাকে দরবেশ বাবা বলল, আপনি কিছু বললেন না কেন?'
'কেন? না বলাতে কী এমন ফারাক পড়ল?'
'আপনি তো আর দরবেশ নন। তো চুপ থাকাটা ঠিক হলো?'
'তো আমি তো মুক্তিদাতাও নই। এখানে তো এনজিওতে ঢাকা থেকে লোক আসলে সেভাবেই দেখা হয়।'
'কিন্তু দরবেশ ভাবলে তো মানুষের মধ্যে আশা তৈরি হয়। আপনার কাছ থেকে কিছু না কিছু পাবার আশা করে।'
'আমাদের এখানকার কাজটাই বা ভিন্ন কীভাবে? একই হলো না? সীমানাটা খুব সূক্ষ্ম আহসান। একটা মুহূর্তের জন্য আমি দরবেশই থাকতে চেয়েছি। তাতে কী এমন হলো?'
এবং আমরা দু'জন অনেক অনেকটা সময় চুপচাপ হাঁটলাম।
ঢাকা যাবার বাস যথেষ্ট দেরিতে ছাড়ল সেই রাতে। একটা কারণ হলো এক তরুণ নেতা, যাঁকে বিদায় জানাতে একদল ভক্ত এসেছেন। সবাই তাঁকে ডাকছেন। মনে হলো নেতা কোনো না কোনো জাতীয় রাজনৈতিক দলের অঙ্গ ছাত্র সংগঠনের বড়সড় কেউকেটা। কিংবা হয়তো একজন প্রাক্তন ছাত্রনেতা, ঢাকায় বসদের কারো সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন। আমার পাশের সীটখানা খালি, আসলে ওই একটা সীটই খালি। মানেটা আমি বুঝলাম। একটু পর তিনি এসে ওখানটাতেই বসলেন। মুখে তাঁর তখনো 'নেতাসুলভ' আড়ম্বর হাসিখানা লেগে। বাস ছাড়ল। জানালায় ঝুঁকে বেশ খানিকক্ষণ তিনি হাত নাড়তে লাগলেন, একটা সময়ে থামালেন, বসলেন, এবং আমার দিকে মনোযোগ দিলেন।
'আপনি নিশ্চয়ই আর্ট কলেজে পড়েন। তাই না?'
'জ্বি না, আমি পড়ি না।' যথাসম্ভব নিচু নরম গলায় আমি বললাম, পরের অবধারিত প্রশ্নটার জন্য তখন অপেক্ষা করে আছি। তিনি খানিকটা বিরতি দিলেন, চোখ বেশ বড় করে রেখেছেন, ভাবছেন কীভাবে পরের প্রশ্নটা করবেন, এবং শেষে ভণিতা না করে সরাসরি হলেন। 'আপনার দেশ কই?'
'আমার মনে হয় না তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার দেশ কুষ্টিয়া।' আমি চিরাচরিত অসরল উত্তর দিলাম, কিন্তু এখনো নরম গলায়। মেহেরপুর বললে এই নেতার জন্য বেশি দূরের হয়ে যেত।
'কুষ্টিয়া! লালনের জায়গা। দেখেন, আমি ঠিক বুঝেছিলাম!' একগাল হেসে নেতা বলতে থাকলেন: 'নিশ্চয়ই আপনি সেই তরিকার লোক, ঠিক না? জানেন, আমাদের পার্টি (তিনি নিজের রাজনৈতিক দলের নাম বললেন) এখন আপনাদের এই সাংস্কৃতিক লাইনের লোকদের সিরিয়াসলি নিচ্ছে… আগে আমাদের এসব নিয়ে ভুলভাল ছিল, আপনাদের মতো লোকজনকে আন্ডারেস্টিমেট করে আমরা ভুল করেছিলাম। এখন আপনারাও আমাদের ইতিহাসের অংশ। তাইলে, বলেন তো… হা হা হা… আপনি কোন লাইনের লোক বললেন না তো?'
এখন আমার পালা আসল লম্বা একটা স্মিতহাস্য দেবার। যে হাসিটা তিনি বিদায়-দিতে-আসা তাঁর ভক্তদের দিচ্ছিলেন কিছুক্ষণ আগে, প্রায় অবিকল সেরকম একটা হাসি আমি কপি করে ফেললাম। হাসিটা অনেকক্ষণ ধরেও রাখলাম মুখে, কোনো কথা না বলে।
আমার লাইন যেটাই হোক না কেন, এই নেতা তার কিছুই বুঝবেন না।
——
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts