Published : 24 Jan 2022, 10:25 PM
চিত্রকর্ম: ম্যাক্স এর্নস্ট
কবিতার কোনো পাঠশালা নেই, গুরুগৃহ নেই। কবিতার সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞাও নেই। যেখানে মনোজাগতিক কারবার আছে– সেখানে সংজ্ঞা নিরূপণ করা কঠিন ব্যাপার। চেয়ার-টেবিলের সংজ্ঞা দেওয়া সহজ– কারণ এগুলো দৃশ্যমান। যদিও এর আপেক্ষিকতা নিয়েও বিতর্ক করা যায়। কিন্তু যেখানে মনের সংযোগ আছে, হৃদয়বৃত্তি যেখানে মস্তিষ্কে আলোড়ন তোলে– যা সৃজন ও মননচর্চার সমাহার, সেখানে মন বহুধাবিভক্ত– মুনির সংখ্যা বেশি, নানা ব্যাখ্যা, নানা উপাচার। আবার যুগে যুগে মানুষের মন বদলায়– প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় পুরোনো মীমাংসা নতুন সমস্যা হয়ে ওঠে – সেখানে এক সংজ্ঞায় স্থির থাকা যায় না। কবিতার ক্ষেত্রেও এটা সত্য।
কবিতার সংজ্ঞা নিরূপণের চেষ্টা হয়েছে বহুবার। এরিস্টটল থেকে শুরু করে আজ অবধি– কিন্তু কোনোটাই মীমাংসিত নয়। কবিতা যেমন বহু রকম– সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতোই– তেমনি কবিতার সংজ্ঞাও বহুরকম। কবিতা ব্যক্তিগত সৃজনশক্তির প্রতিফলন। তবে অভিমুখ সমষ্টির দিকে। কবিতা লেখা একান্ত ব্যক্তিগত তাড়না, কিন্তু তারপরও কবি একা নন। কবিতা যখন পাঠকের কাছে পৌঁছোয়, আমেরিকান কবি বিলি কলিন্সের ভাষায়, তখন, "একজন পাঠক, একজন অপরিচিত ব্যক্তি কবির সচেতনতার ভেতর প্রবেশ করে– তার মানসিক ও আবেগের জগতে ভ্রমণ করতে পারে।"
এখানেও বক্তব্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা করা যায়। এই যে প্রবেশপথ, এটা কাছের না দূরের তাও বিবেচ্য। সমকালের পাঠক ও মহাকালের পাঠক একই ঐতিহাসিক, স্থানিক বা আবেগের জগতে পরিভ্রমণ করতে পারেন না। কবিতার জন্য সময় একটা বড় বিষয়। সময় কবির শ্রেষ্ঠ অনুষঙ্গ, সময় থেকেই কবিকে জীবন অভিজ্ঞতা নিতে হয়। এই অভিজ্ঞতা– প্রজন্মের পর্যবেক্ষণেও এর ছাপ পড়ে। স্থান, কাল ও প্রজন্মের বোধ এবং অভিজ্ঞতায় দূরত্ব থাকে, ফলে দুই প্রজন্মের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি করা দুরূহ। সকল পাঠকই কবিতার প্রথম পাঠক– শুধু সময়, বোধ ও অভিজ্ঞতা তাদের আলাদা করে দেয়। ১৮৬২ সালে আটলান্টিক মান্থলি (বর্তমানে দি আটলান্টিক) ম্যাগাজিনে টি ডব্লিউ হিগিনসনের Letter to a Young Contributor পড়ে এমিলি ডিকিনসন চারটি কবিতাসহ তাঁকে চিঠি লিখে তাঁর কবিতা সম্পর্কে মতামত জানতে চেয়েছিলেন, "বলুন আমার কবিতা কি জীবন্ত ?" চিঠিতে তিনি আরও লিখেছেন যে "মন নিজেই এত কাছে যে সে নিজে স্পষ্ট দেখতে পায় না।" এমিলির এ প্রশ্ন ও উপলব্ধি কবিতার শাশ্বত জিজ্ঞাসা।
পাঠকের কাছে কবিতা কীভাবে জীবন্ত থাকবে– কী রূপে? এই শাশ্বত প্রশ্নের সুরাহা হয়নি– হবেও না। ড্যানিশ দার্শনিক সোরেন কিয়ার্কেগার্ড কবি ও কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন, কবির হৃদয় ক্ষোভে পরিপূর্ণ– কবি তার ক্ষোভ, যন্ত্রণা, দীর্ঘশ্বাসকে চমৎকার সঙ্গীতে রূপান্তরিত করেন। আমরা দেখি, এখানে দুটো বিষয়ের মিলন ঘটে। একটি কবির জীবন অভিজ্ঞতা, যার সঙ্গে যুক্ত হয় কল্পনাশক্তি। এখানে এসে কবিতা বাঁক নেয়, নবরূপ নেয়– অনেক ছন্দ, অনেক স্বর, অনেক কোলাহল ও নির্জনতাকে ধারণ করে– অনেক বেদনা, আর্তি ও উল্লাসকে পেছনে ফেলে কিংবা আত্মস্থ করে প্রবাহিত হয় নদীর মতো। এ প্রবাহ কখনো থামে না– এ এক অন্তহীন অভিযাত্রা।
তাহলে কবিতা কী? আমি বলি, কবিতা এক অন্তহীন অন্বেষণের নাম। স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের প্রাচীন নাবিকের মতো কবি খুঁজে ফিরছে সুপেয় জল "Water, water everywhere nor any drop to drink."; কিন্তু সুপেয় জলের কাছে কবি যখন পৌঁছে যাবেন তখন কি তার অন্বেষণ শেষ হবে? ২০০০ সালে আমার একবার কেনিয়া ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল। মে মাসে। এক ফাঁকে কেনিয়ার বিখ্যাত মাছাইমারা গেইম রিজার্ভ দেখতে যাই। অসাধারণ সাফারি– হাজার হাজার পশুপাখির এক উৎফুল্ল সমাবেশ সেখানে। জিরাফ, হরিণ, জেব্রা, বাফেলো, রাইনো– কত রকম পশুর চারণভূমি। আমাদের গাড়ির চালক পিটার, মাছাইমারাতে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি হয়েছে তার প্রবল ঘ্রাণশক্তি– অনেক দূর থেকেও সে টের পায়, বুঝতে পারে পশুদের অবস্থান। সে জানাল এ সাফারিতে সিংহও আছে। শুনে আমরা শিহরিত, রোমাঞ্চিত । আমরা সিংহ দেখার জন্য মাটাটো (এক ধরনের মাইক্রোবাস) গাড়িতে মাছাইমারার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ালাম কিন্তু একটা সিংহও দেখতে পেলাম না। রাত কাটালাম মাছাইমারার মারা সেরেনা হোটেলে। মাছাই কেনিয়ার ক্ষুদ্র এক নৃগোষ্ঠীর নাম । তাদের বাড়ি-ঘরের আদলে হোটেলটি নির্মিত। রাতে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ও সিংহ না দেখার অতৃপ্তি নিয়ে কবিতা লিখলাম– 'মাছাইমারা' নামে। এর কয়েকটি পংক্তি নিচে দেওয়া হলো :
কিন্তু পিটার, হে মাটাটো চালক কখনো কখনো
অভিযান খুব রোমাঞ্চকর হয়
প্রথম দিন আমরা সিংহ দেখিনি, কিন্তু সিংহের খোঁজে
পার করে দিয়েছি দুপুর থেকে বিকেল অবধি
দুঃখিত পিটার– তোমার অভিজ্ঞ ও অনুসন্ধিৎসু চোখকেও
ফাঁকি দিয়েছে তারা
তার বদলে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল জিরাফ
চিড়িয়াখানা নয়, মানুষের বন্দীশালা নয়
আদিগন্ত উন্মুক্ত ভূমিতে মুক্ত পশুদের অভিনন্দনই আলাদা
তোমাকে ধন্যবাদ পিটার
কাল ভোরে আমরা সিংহ দেখতে বেরুব।
পরদিন খুব ভোরে বের হলাম। পিটার তার ঘ্রাণশক্তি দিয়ে বুঝে গেছে আজ কাছে কোথাও সিংহ আছে। কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ল ঘুমন্ত তিনটি সিংহ। আরাম করে ঘুমাচ্ছিল । পিটার গাড়ির হর্ন বাজিয়ে জাগিয়ে দিল তাদের। সাহস করে খুব কাছ থেকে ছবি তুললাম! তবে কি আমাদের অন্বেষণ শেষ? আমরা জানতাম সিংহ আছে মাছাইমারাতে। খুঁজলে পাওয়া যাবে। ভোরবেলা সিংহের কাছে যখন পৌঁছলাম– সেটি বাস্তব। এটি যদিও স্বাভাবিক অন্বেষণ তবুও কবিতার অন্বেষণ "কাল ভোরে সিংহ দেখতে বেরুব" পর্যন্ত। সিংহদর্শনের সঙ্গে এ অন্বেষণের সমাপ্তি ঘটেছে। কবির অন্বেষণের শেষ নেই। স্বপ্ন, কল্পনা, বাস্তবতা পেরিয়ে কবিকে ছুটতে হয়। কবির এ অন্বেষণ জীবন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশে গেলেও তা অদৃশ্যের অন্বেষণ। ফলে দেখা যাচ্ছে যা আছে, যা পেয়েছি তা-ই শেষ কথা নয়, যা নেই তাকে খুঁজে বের করাই কবির কাজ।
কথিত আছে, মৃত্যুর কিছুদিন আগে ডব্লিউ বি ইয়েটস বলেছিলেন, কবিতা কী করে লিখতে হয় তিনি জেনে গেছেন। কিন্তু কবির কাজ কোনো কিছু জানা নয়– আবিস্কারও নয়। কবির কাজ কবিতাকে খুঁজে ফেরা, তিনি কবিতাকে খুঁজবেন জীবনের ভেতর, অসীম প্রকৃতি, স্বপ্ন ও কল্পনার ভেতর। এক দিগন্ত খুঁজে পেলে অন্য দিগন্তের খোঁজে বেরিয়ে পড়বেন।'পরশপাথর' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন "খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।" কবিকেও বেরিয়ে পড়তে হয় পরশপাথরের খোঁজে। এ অন্বেষণই কবিতার প্রাণ– যা কবিকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে। তাকে কবি হিসাবে জীবিত রাখে। সিকদার আমিনুল হকের কবিতার উদ্ধৃতি এখানে প্রাসঙ্গিক মনে হয় :
বিষয়বস্তুর জন্যে আমার কবিতা অস্তিত্বের
শঙ্কা নিয়ে নৈশ জাগে। ম্রিয়মাণ আমি ও কবিতা
দীঘিতে সাঁতার কাটি বাঁচার ইচ্ছায়
যাই পর্বতের শীর্ষে, লোকে বলে দুর্ধর্ষ ট্রেকার
অথবা মরুতে জেদী যাযাবর, ছুটি তেপান্তরে;
রাখালের সঙ্গে ঘুরি ক্লান্ত পালকের বেশে।
[আমি ও আমার কবিতা/ আমি সেই ইলেক্ট্রা]
দেখা যাচ্ছে, কবিতা নির্মাণের বিষয় নয়, আবিস্কারের বিষয়ও নয়। কবিতা লেখা শেখানো যায় না। কবির জন্ম হয়। একথা যে কোনো শিল্পীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তা না হলে আর্তুর রেবো কীভাবে বিশ বছর বয়সের মধ্যে লিখে ফেলেন তাঁর ভয়ঙ্কর সুন্দর সব কবিতা, হুইটম্যান কেন ভবঘুরে জীবন যাপন করেও হয়ে ওঠেন মার্কিন কবিতার জনক, লেটোর দলের অন্যদের মতো হারিয়ে না গিয়ে নজরুল কীভাবে নাড়িয়ে দেন বাংলা কবিতার ভুবন। আর অসম্ভব প্রতিভাধর রবীন্দ্রনাথ যেখানে হতে পারতেন ভাইয়ের মতো আই সি এস অফিসার, তা না হয়ে, হয়ে উঠলেন বিশ্বকবি! কবির জন্ম না হলে এসব অসম্ভব, অকল্পনীয় ঘটনা ঘটত না। এঁরা কেউ পাঠশালায় কবিতা শেখেননি। কিন্তু পড়েছেন প্রচুর– হৃদয়ে ও মননে ধারণ করেছেন কবিতা। পৃথিবীর ইতিহাসে সব কবি তাই জৈব-কবি। কবি বাল্মিকী থেকে শুরু করে আজকের তরুণতম কবি পর্যন্ত। কবিতা শেখানো যায় না । তবে যা শেখানো যায় না সেটি শিখে নিতে হয়।
২.পদ্য ও কবিতা
হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ কবিতা অর্থে পদ্য ও শ্লোক দুটোকেই বলা হয়েছে। বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধান (২০১৬)-এ পদ্যের অর্থ করা হয়েছে ছন্দোবদ্ধ রচনা, কবিতা, শ্লোক ইত্যাদি। এসব আভিধানিক অর্থে কবিতা ও পদ্যের পার্থক্য সুষ্পষ্টভাবে নির্দেশ করা হয়নি। কবিতা কাকে বলে, কবিতার সঙ্গে পদ্যের কী পার্থক্য– এটি বুঝতে হলে শুধু কবিতার কাঠামো বা ছন্দ সম্পর্কে ধারণা থাকলে হবে না– কবিতার অন্তর্নিহিত রস ও সৌন্দর্য অনুভব করতে হবে।
পদ্যকে সাধারণত বাংলায় ইংরেজি ভার্স শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে ভাবা হয়। verse শব্দটি এসেছে ল্যাটিন vertere থেকে যার অর্থ 'বাঁক নেওয়া' বিকল্পে ল্যাটিন versus থেকেও এর উৎপত্তির ধারনা করা হয়– এর অর্থ লাইন, সারি বা হালকা দাগ (line, row or furrow)। বাংলার মতো ইংরেজিতেও ভার্স বলতে ছন্দোবদ্ধ পদ বোঝায়। Cambridge English Dictionaryতে ছন্দোবদ্ধ রীতিতে লেখাকে ভার্স বলা হয়েছে। আবার লাইনকেও ভার্স বলা হয়। অর্থাৎ একটা কবিতায় অনেক ভার্স থাকতে পারে– এখানে ভার্সকে সমগ্র ও অংশ দুটোই ধরা হয়েছে। বাংলায় পদ্য ও কবিতা দুটো শব্দই সমগ্রকে ধারণ করে। এক পংক্তিতে কবিতা বা পদ্য হতে পারে কিন্তু একটি কবিতার প্রতিটি লাইনই পদ্য বা কবিতা এমত ধারণা বাংলা সাহিত্যে নেই।
শুরুতে একদেহে লীন হলেও পদ্য ও কবিতা এখন যমজ ভাই– দুটোই একে অন্যের সহায়ক, পরিপূরক। চেহারাগত সাদৃশ্যের কারণে যমজ ভাইকে চিনতে অপরিচিতদের সমস্যা হয়। এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। তাই দুটোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার।
পদ্য ও কবিতার মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে অনেক পরে। অনক্ষর কালেও পদ্য ছিল চারণকবিদের মুখে মুখে। চারণ কবিদের কণ্ঠে যখন গান বা শ্লোক গীত হতো তখন কবিতা বা পদ্য এ দুটো শব্দের আবির্ভাব হয়নি। কিন্তু পদ্যের শুরু গদ্যের বহু আগে। মধ্যযুগে পদ্য ও কবিতার কোনো পার্থক্য ছিল না। পদ্য যেমন ছিল ছন্দোবদ্ধ রচনা– কবিতাও তাই। দুটিই ছিল সমার্থক। পদ্য রচয়িতাকে কবিতা রচয়িতা বলে বিবেচনা করা হতো। কবিতা বা পদ্য ছাড়া পৃথিবীতে কোনো জাতি বা সংস্কৃতির অস্তিত্ব নেই– কখনো ছিল না। চতুর্দশ শতকে Poesie শব্দটি ইংরেজি ভাষায় প্রবেশ করে। ল্যাটিন Poetrica থেকে ইংরেজিতে Poetry শব্দটির আবির্ভাব ঘটে। গ্রীক শব্দ হচ্ছে poiesis যার ইংরেজি 'making' সে অর্থে কবিতাকে নির্মাণ হিসাবেও কেউ কেউ মনে করেন। কিন্তু এ নির্মাণ ভিন্ন অর্থবহ যা নিয়ে পরে আলোচনা করা হবে।
পদ্যকে ছন্দোবদ্ধ লেখা বলা হয়, কবিতাও বেশিরভাগ প্রথাগত ছন্দে লেখা । কিন্তু কোনটি কবিতা ও কোনটি পদ্য বোঝা কিছুটা জটিল। কারণ এর সীমারেখা বলে কিছু নেই। হোর্হে লুইস বোর্হেস বলেছেন, কবিতার সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। এটা অনেকটা রঙ, ভালোবাসা, হেমন্তে পাতা ঝরার সংজ্ঞা দেওয়ার মতো।
ছন্দোবদ্ধ পদ্যেও কবিতা থাকতে পারে– আবার নাও থাকতে পারে। ছন্দের নিয়ম-রীতি অনুযায়ী পদ্য কাঠামোতে সাজানো হলেও কবিতা হয়ে উঠতে হলে অব্যাখ্যাত নানা উপাদানের সমন্বয় প্রয়োজন হয়। যতীন্দ্রমোহন বাগচীর 'কাজলা দিদি' কবিতায় "বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই" পংক্তিকে যদি পদ্য ধরি তব "ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই"– এটি কবিতা। একই লেখায় পদ্য ও কবিতার মিশেল থাকতে পারে। কবিতার ক্ষেত্রে পদ্যরীতির নিয়ম মানা জরুরি নয়। কবিতা এখন ছন্দোবদ্ধ, মুক্ত, মিশ্র, গদ্য এরূপ নানা আঙ্গিকে লেখা হয়– বহু বিখ্যাত কবিতা আছে যেখানে পদ্যের প্রথাগত রীতি অনুসরণ করা হয়নি। আবার অনেক পদ্যকার আছেন যারা কবি হিসাবে সমাদৃত নন। কালক্রমে পদ্য ও কবিতার ভেতর একটা পার্থক্য রচিত হয়েছে। তবে কোনো কোনো কবি এ পার্থক্য মানতে চান না– নিজেদের সবিনয়ে পদ্যকার বলেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তারঁ কবিতা সমগ্রের নাম রেখেছেন পদ্য সমগ্র।
মানব ইতিহাসে পদ্যকারদের ভুমিকাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই । প্রাচীনকালের চারণ কবি, লোককবিদের কণ্ঠে উঠে এসেছে স্থানিক ও কালিক ইতিহাস। প্রকৃত প্রস্তাবে তারাই প্রথম ঐতিহাসিক। যুদ্ধবিগ্রহ ও ঘটনার বিবরণ উঠেছে তাদের কণ্ঠে– এমনকি বাংলার পুঁথিকাররা এই আঠারো-উনিশ শতকেও গ্রামীণ জনপদ ও জীবনযাপনের যে চিত্র বর্ণনা করেছেন আজকের দিনে তা ইতিহাস ও নৃবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত।
তুচ্ছার্থেও পদ্য শব্দটি ব্যবহৃত হয়। রবীন্দ্রনাথ 'বাংলা ছন্দের প্রকৃতি' প্রবন্ধে লিখেছেন "কাব্য পড়তে গিয়ে যদি অনুভব করি যে ছন্দ পড়ছি তাহলে সেই প্রগলভ ছন্দকে ধিক্কার দেব।" জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী পদ্য পাঠে পাঠক নিম্নস্তরের তৃপ্তি বোধ করে । তিনি লিখেছেন, কবিতার জন্য একটি পৃথিবীর অন্ধকার ও স্তব্ধতায় হৃদয়কে মোমের মতো জ্বলে উঠতে হয়– এই চমৎকার অভিজ্ঞতা যখন হৃদয়কে ছেড়ে যায় তখন যা রচিত হয় তা পদ্য। পদ্যের প্রভাব ক্ষণস্থায়ী। পাঠক নিম্নস্তরের তৃপ্তি বোধ করে। তিনি এক্ষেত্রে সৌন্দর্য সৃষ্টির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন– "কবিতার ভিতর আনন্দ পাওয়া যায়; জীবনের সমস্যা ঘোলা জলের মুষিকাঞ্জলির ভিতর শালিকের মতো স্নান না করে বরং যেন করে আসন্ন নদীর ভিতর বিকেলের শাদা রৌদ্রের মতো,—সৌন্দর্য ও নিরাকরণের স্বাদ পায়।"
এ আলোচনার প্রেক্ষিতে পদ্যের কিছু বৈশিষ্ট্য নিরুপণ করা যাক :
১. পদ্য ছন্দোবদ্ধ রচনা।
২. শ্লোক, স্তোত্র এসব পদ্যের অন্তর্ভুক্ত।
৩. সাধারণত পদ্যে স্মৃতিকথা, ঘটনার বা দৃশ্যের বর্ণনা প্রাধান্য পায়।
৪. যাকে বলে কবিতার ভাব সমুন্নতি, পদ্যে তা অনুপস্থিত থাকে।
৫. কবির কল্পনাশক্তি, দৃশ্যের সঙ্গে দৃশ্য যোগ, শব্দের কারুকাজ–এসব থাকে না ।
৬. পদ্যে উপমা, চিত্রকল্প, রূপক ইত্যাদি অলঙ্কারের ব্যবহার গতানুগতিক।
৭. শব্দ নির্বাচন করা হয় আভিধানিক অর্থ, ছন্দের মাত্রার হিসাবে, ধ্বনি বা নিহিতার্থ কম গুরুত্ব পায়।
৮. পদ্যের প্রভাব ক্ষণস্থায়ী ও পাঠের আনন্দ তাৎক্ষণিক।
৯. সৌন্দর্য সৃষ্টির চেয়ে নিছক আনন্দ দেওয়া এখানে মুখ্য।
১০.একই লেখায় কবিতা ও পদ্যের সহঅবস্থান হতে পারে।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছন্দের জাদুকর হিসাবে বাঙালির কাছে পরিচিত। পাঠকের সুবিধার্থে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার বই থেকে পদ্য ও কবিতার উদাহরণ দিচ্ছি :
গ্রীষ্ম-চিত্র
বৈশাখের খরতাপে মূর্চ্ছাগত গ্রাম,
ফিরিছে মন্থর বায়ু পাতায়-পাতায়;
মেতেছে আমের মাছি, পেকে ওঠে আম,
মেতেছে ছেলের দল পাড়ায়-পাড়ায়।
চম্পা
আমারে ফুটিতে হল
বসন্তের অন্তিম নিশ্বাসে,
বিষণ্ন যখন বিশ্ব
নির্মম গ্রীষ্মের পদানত;
রুদ্র তপস্যার বনে
আধ ত্রাসে আধেক উল্লাসে,
একাকী আসিতে হল
সাহসিকা অপ্সরার মতো।
প্রথমটি যে পদ্য এ নিয়ে মনে হয় কারো সংশয় হবেনা। এখানে সুন্দরভাবে গ্রীষ্মকীলের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আমের মাছি, বৈশাখের খরতাপ, এসব ক্লিশে বা বহু ব্যবহৃত শব্দ ও বাক্য এখানে আমরা পাই। এটি আমাদের পাঠে তাৎক্ষণিক আনন্দ দিতে পারে– কিন্তু ভাবায় না । কারণ এ পদ্যে যা আছে তা আমাদের অতি পরিচিত।
দ্বিতীয়টি কবিতার উদাহরণ । এটিও ছন্দোবদ্ধ, কিন্তু এখানে কল্পনা অনেক প্রসারিত । এখানেও গ্রীষ্মকালের ছবি আছে কিন্তু ভিন্ন রূপে। "বসন্তের অন্তিম নিশ্বাসে'', "আধ ত্রাসে আধেক উল্লাসে", "সাহসিকা অপ্সরার মতো"– এ ধরনের রূপক ও উপমার ব্যবহার পাঠকের কাছে আলাদা দ্যোতনা তৈরি করে।
৩.ভাল কবিতা বাজে কবিতা
উপরের আলোচনায় দেখলাম পদ্য ছন্দোবদ্ধ রচনা। অর্থাৎ ছন্দ-মাত্রায় বিন্যস্ত না হলে তাকে পদ্য গোত্রে ফেলা যাবেনা। পদ্য লেখা সবসময় যে বাজে হবে তা কিন্তু নয়। পদ্য পদ্য হিসাবে উর্ত্তীণ হলে ঠিক আছে, কিন্তু বাজে পদ্যেও আছে । পদ্য ছন্দোবদ্ধ রচনা বিধায় পদ্যের বহু যুগ লালিত বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় মুক্তছন্দে বা গদ্য ছন্দে পদ্য লেখা সম্ভব নয়। কবিতারও শুরু ছন্দোবদ্ধ পদ দিয়ে, এখন ভিন্ন আঙ্গিকেও লেখা হচ্ছে কবিতা। কিন্তু ছন্দোবদ্ধ রীতিতে যা লেখা হচ্ছে তাকে যেহেতু পদ্য বলতে পারব না, কী বলব ? সেটি কি শুধু কবিতা? এ ধরনের লেখার সবগুলোই যে কবিতার বিচারে উত্তীর্ণ তা নয়। বাজে লেখার উদাহরণই বেশি। বাজে কবিতাকে তাহলে আমরা কি পদ্য না বলে বাজে কবিতা বলতে পারি?
সব ভাষায় বাজে লেখা আছে । জর্জ অরওয়লে ইংরেজি ভাষায় বাজে লেখার অনেক উদাহরণ দিয়েছেন। ভালো লেখার আনন্দ তাৎক্ষণিক নয়, চিরকালীন। হেরমেন হেস লিখেছেন স্কুলে যে লেখাকে প্রথম কবিতা মনে হয়েছে কালের বিচার সেটি মন্দ লেখা। বর্তমানে কবিতা লেখা হচ্ছে নানা ভাবে– প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে কবিতা প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি, ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন ইত্যাদিতে ছড়িয়ে পড়েছে। আগে পত্রিকার সাহিত্য পাতায় কবিতা ছাপা হতো, না হয় প্রথাবিরুদ্ধ রাগী তরুণরা ছোট কাগজ বের করতেন কষ্ট করে। এখন এসব লাগেনা। কবিতা এখন তিন জগতের বাসিন্দা। একটি প্রিন্ট মিডিয়া, অন্যটি ফেসবুক অথবা অনলাইন পত্রিকা, আর পারফমিং কবিতা । ফেসবুকে হাজার হাজার পাঠক, শ্রোতা, এক পোস্টে কবিতা চলে যাচ্ছে বহুজনের কাছে। পড়ুক বা না পড়ুক লাইক দিচ্ছে সবাই। আবার আবৃত্তিও প্রচুর শ্রোতার কাছে পৌঁছোচ্ছে। কিন্তু এর প্রায় ৯৫% বাজে কবিতা কিংবা অকবিতা। আগে কবিতা প্রকাশ ছাড়া কবি হাওয়া কঠিন ছিল। ভালো পত্রিকায় ছাপা না হলে কেউ কবি বলতেন না । এখন এসবের বালাই নেই। ছোটকাগজ বের করা যেমন সহজ, তেমনি প্রতিদিন ফেসবুকে কবিতা পোস্ট দেওয়াও সহজ। এতে চাল আর কাঁকরে সাধারণ পাঠক পার্থক্য করতে পারছেন না। তাহলে এসব বাজে কবিতা, বা অ-কবিতাকে কী বলব?
আমার মনে হয় পদ্য বেচারাকে আর কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। পদ্য যেহেতু ছন্দোবদ্ধ রচনা তাই বর্তমান সময়ে প্রথাগত ছন্দের বাইরে লেখা মুক্ত বা গদ্য ছন্দের কবিতাকে পদ্য বলার সুযোগ নেই। বরং সাধারণ মানের, বিরক্তিকর, একঘেয়ে, পুরোনো ও বহুব্যবহৃত অলঙ্কার সংবলিত এসব কবিতাকে বাজে কবিতা বলি– আর যা হয়না, যাকে কোনো হিসাবে কবিতা বলা যায়না, সেগুলোকে অ-কবিতা বলি।