Published : 04 May 2024, 12:42 AM
ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে শুরু হল বর্ণমালা ও মুদ্রণ প্রযুক্তি নিয়ে সব্যসাচী হাজরার প্রদর্শনী 'প্রাইমার টু প্রেস'।
শুক্রবার বিকেলে এর উদ্বোধন করা হয়; সেই সঙ্গে প্রদর্শিত হয় তার নতুন বই ‘বর্ণমালা: বাংলা বর্ণ পরিচয় সংকলন’।
কবি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘বর্ণমালা: বাংলা বর্ণ পরিচয় সংকলন' মূলত বাংলা প্রাইমার নিয়ে বিস্তৃত অন্বেষণের ফলাফল, যেখানে ১৮৪৯ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত প্রণীত নির্বাচিত আটটি বর্ণমালার বই সংকলিত হয়েছে।
বর্ণমালা বইয়ের ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তের গবেষণা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে লেটারিং, সম্পাদনা এবং মুদ্রণ কৌশলের বিবর্তনের উন্মোচন করেছেন সব্যসাচী হাজরা, যা দেখানো হচ্ছে এ প্রদর্শনীতে।
সব্যসাচী হাজরা বলেন, “বাংলা বর্ণমালা সেই আদিকাল থেকে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের রূপে এসেছে। এক সময় আমাদের হরফ কীভাবে তৈরি হত এবং তা কীভাবে ছাপা হত; তার একটা ধারণা মিলবে এ প্রদর্শনীতে।
"আমাদের বর্ণমালা নিয়ে বিভিন্ন সময় 'বর্ণমালা পরিচয়'-এর বই বেরিয়েছে। সেগুলো একসঙ্গে করে সংকলটি প্রকাশ করা হয়েছে। এ প্রদর্শনী ও বই আমাদের অতীতে ফিরিয়ে নেবে এবং আমাদের বর্ণমালার ইতিহাস স্মরণ করাবে।”
রোববার বাদে ১৮ মে পর্যন্ত সোমবার থেকে শনিবার বিকেল ৩টা-রাত ৯টা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে প্রদর্শনী।
আয়োজকরা জানান, প্রদর্শনীর সময় একটি পোস্টারসহ বইটি সংগ্রহ করা যাবে। সীমিত সংখ্যক বিশেষ পোস্টারসহ বইটির একটি বিশেষ প্যাকেজও সংগ্রহ করা যাবে।
গ্যালারিতে উপচে পড়া ভিড়
নতুন ভাবনার এই আয়োজনকে ঘিরে রাজধানীর শিল্পপ্রেমীদের মিলনমেলা বসেছিল শুক্রবার। নানা বয়সী মানুষের ভিড়ে অন্য রূপ পায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারি।
যমজ সন্তান লাল পরী আর নীল পরীকে নিয়ে গ্যালারিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন মা জেসমিন পাপিয়া। প্রাক-প্রাথমিকে পড়া এই শিশুদের কাছে প্রদর্শনীটি কেবলই ছবি দেখার বিষয় হলেও শিল্পরসিকদের কাছে এ যেন ‘অভূতপূর্ব’ এক আয়োজন।
পাপিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের বাচ্চারা তো স্কুলে ভর্তির আগেই মোবাইল ফোন চালাতে শেখে। তাদের কাছে, এ প্রদর্শনী হয়ত নতুন ভাবনা সঞ্চার করবে। কীভাবে আমাদের বর্ণমালা আজকের রূপে এসেছে; এক সময় কীভাবে বই ছাপা হতো, তা তারা জানতে পারবে। এজন্যই সন্তানদের নিয়ে এসেছি।”
প্রদর্শনীতে এসে কেমন লাগছে? লাল পরী বললো, তার ‘ভালো লাগছে’। কীসের প্রদর্শনীতে এসেছে জানতে চাইলে সে বলে, “ছবির।”
তবে সংগীত শিল্পী রাহুল আনন্দের কাছে এ প্রদর্শনী ‘অভূতপূর্ব’ আয়োজন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সব্যসাচী হাজরাকে সবাই শিল্পী হিসেবেই জানে। তবে এ প্রদর্শনী আমাদের সামনে একজন গবেষককে সামনে এনেছে। খুবই পরিশ্রমী একটা কাজ করেছেন হাজরা।
"আমাদের বর্ণমালা, মুদ্রণশিল্পের বিবর্তনের তথ্য-উপাত্ত এখানে দেখতে পাওয়া যাবে। এখন তো নতুন প্রজন্ম 'এ আই' নিয়ে ভাবছে। প্রযুক্তিতে অগ্রসরমান প্রজন্মকে তাদের অতীতকেও মনে করিয়ে দেবে।”
আয়োজন-সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলা বর্ণমালা বইয়ের আলোকিত ইতিহাস তুলে ধরে সেকালের মুদ্রণশিল্পের আকর্ষণীয় বিভিন্ন নিদর্শনের পাশাপাশি নির্বাচিত মূল বর্ণমালা বইগুলোও এখানে দেখানো হচ্ছে।
দর্শকরা মুদ্রণ কৌশলের বিবর্তন সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জনের পাশাপাশি কাঠের ব্লক প্রিন্টিং এবং মুভেবল টাইপ সেটের মত ঐতিহাসিক সরঞ্জাম দেখতে পাবেন।
নকশা এবং চিত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন বাংলা বর্ণমালার শৈল্পিক যাত্রাকেও উপস্থাপন করা হচ্ছে প্রদর্শনীতে। সামগ্রিকভাবে, ‘বর্ণমালা: বাংলা বর্ণ পরিচয় সংকলন’ বইটির পাশাপাশি এর ভিজ্যুয়াল সঙ্গী হিসেবে বাংলা বর্ণমালা শিল্পের শৈল্পিক বিবর্তন দেখার সুযোগ রয়েছে।
প্রদর্শনীতে বাংলা প্রাইমারের জন্য ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী লেটার প্রেস মুদ্রণযন্ত্রের মাধ্যমে মুদ্রণ পদ্ধতিও প্রদর্শন করা হচ্ছে।
প্রকাশনা সংস্থা বাতিঘর-এর স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশকেও পাওয়া গেল গ্যালারিতে। ভীষণ কৌতূহল নিয়ে তিনি দেখছিলেন লেটার প্রেস যন্ত্রটি।
দীপঙ্কর দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ প্রদর্শনী আমাদের অতীতকে মনে করিয়ে দেবে। বাংলা বর্ণমালার ইতিহাস, সেই আদিকালে কীভাবে ছাপা হত, আর প্রযুক্তির বিবর্তনে এখন আমরা কোথায় এসেছি।”
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন, শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্য, ডিজাইনার ও শিল্পী চন্দ্র শখের সাহা, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার পরিচালক ফ্রঁসোয়া ঘ্রোজঁ এবং সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও বাদ্যযন্ত্রী রাহুল আনন্দ।
এক নজরে সব্যসাচী হাজরা
সব্যসাচী হাজরা একজন শিল্পী এবং লেখক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কন ও চিত্রকলায় প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেন।
প্রচ্ছদ ডিজাইন, ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন এবং ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি ডিজাইন থেকে শুরু করে প্রকাশনা শিল্পে লেআউট এবং ইলাস্ট্রেশন পর্যন্ত তার কর্মপরিধি, যা বিভিন্ন সময়ের অসংখ্য বই, দৈনিক পত্রিকা এবং সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
দীর্ঘদিন মুদ্রণ এবং প্রকাশনার তাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক অনুশীলনে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন হাজরা।
‘বর্ণমালা: বাংলা বর্ণ পরিচয় সংকলন’ ছাড়াও তিনি এর আগে তিনটি বই লিখেছেন: ‘ইন দ্য কোয়েস্ট অব বাংলা টাইপোগ্রাফি’ (২০২১), ‘রং তুলিতে ছোপছাপ’ (২০১৮) এবং ‘চিত্রলিপি’ (২০১৫)। তিনি ‘বাংলা নামের দেশের গল্প’ (২০২৩) গ্রন্থের একজন সম্পাদক।