Published : 26 Jun 2023, 03:45 PM
জার্মানরা দার্শনিক জাতি, এরকম বলা হয়ে থাকে। সে দেশের পণ্ডিত সমাজের বিশ্বজোড়া খ্যাতি আছে। খ্যাতি উচ্চতর জ্ঞানের অনুশীলন এবং বিষয়ভাবনার মর্ম-গভীরতার জন্য। কথাশিল্পী ও প্রাবন্ধিক টমাস মান (১৮৭৫-১৯৫৫) সেই ঐতিহ্যের সফল অনুসারী। বুদ্ধিজীবীর সব বৈশিষ্ট্যই ছিল তার মধ্যে। পার্থক্য হচ্ছে, তিনি ছিলেন একই সঙ্গে সৃজনশীল মানুষ যা তাকে সাহায্য করেছিল নিজের জন্য আলাদা একটি জগৎ তৈরি করতে। সেই জগৎ রাজনীতি-সমাজনীতি আর শিল্প-সংস্কৃতির অভিজ্ঞতায় ভরপুর এক বিশ্বনাগরিকের একান্ত আপন পৃথিবী।
ঔচিত্যবোধ দ্বারা তাড়িত প্রকৃত সজ্জন টমাস মান সত্য ভাষণের কারণেই জার্মান নাগরিকত্ব হারান এবং বিতাড়িত হন দেশ থেকে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, মানসিক টানাপড়েন ও সভ্যতার সঙ্কট মানের শিল্পীমন গড়ে তোলার পেছনে কাজ করেছে নিরন্তর। মান জার্মান বৈদগ্ধ ও পাণ্ডিত্যের অতি উজ্জ্বল এক প্রতিনিধি। তার সব ধরনের লেখাতেই এই পরিচয় সুস্পষ্ট। হৃদয় ও বুদ্ধির টানাপড়েন এবং সেখান থেকে উদ্ভূত জটিলতা মানের কথাসাহিত্যের একটি লক্ষ্যনীয় দিক। এর পেছনে আছে বিশ শতকের নানামাত্রিক সঙ্কটের অভিজ্ঞতা ও অনুভব।
যদিও The Magic Mountain(১৯২৪) টমাস মানের সর্বাধিক বিখ্যাত এবং সবচেয়ে শিল্পসমৃদ্ধ উপন্যাস, তবু ছোট উপন্যাস Death in Venice(১৯১৩) এবং Mario and the Magician (১৯৩০) সাহিত্যকর্ম হিসেবে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। শিল্পনৈপুণ্য ও বক্তব্যমূল্য উভয় দিক থেকেই The Magic Mountain এর পরেই Death in Venice এর স্থান, আমার এমনই মনে হয়। প্রথম উপন্যাস Buddenbrooks রচিত হয়েছিল লেখকের পুনরাবৃত্ত বক্তব্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। এক বছর পর প্রকাশক উপন্যাসটি ছাপেন। তারপর অভাবনীয় ঘটনা ঘটে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রচুর বিক্রি হতে থাকে বইটি। ছাব্বিশ বছরের তরুণ লেখক রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান। শুধু জার্মানিতেই এই উপন্যাসের দশ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল। ৮-১০টি ভাষায় এর অনুবাদ হয়েছে। পরে হিটলার কর্তৃক এই বই নিষিদ্ধ হয়।
১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয় টমাস মানের প্রথম গল্পের বই Tristan। একটা ব্যাপারে Death in Venice এর সঙ্গে এর খুব সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তা হচ্ছে, Tristan-এর গল্পগুলোতে প্রতিভাবান ব্যক্তিবর্গের চরিত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে মন-সমীক্ষণের আলোয়। Buddenbrooks-এর চেয়ে এই গ্রন্থ অনেক পরিণত। Death in Venice-এর উচ্চতা ও শিল্পসিদ্ধির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে হেমিংওয়ের The old man and the sea, স্টেইনবেকের The Pearl এরকম দু’চারটি মহাগ্রন্থের। Death in Venice-এর বিষয়বস্তু কী? এক কথায় এর থিম হচ্ছে সৌন্দর্যপূজা ও নান্দনিকতা। এর নায়ক ওস্তাভ আশেনবাখ প্রতিষ্ঠিত একজন সাহিত্যিক। গ্রিক দেবতার মতো সুদর্শন ও স্মার্ট কিশোর টাভজিও আকর্ষণ করে আশেনবাখকে। অপ্রতিরোধ্য সেই টান। টাভজিওর চোখ বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক twilight-grey ফ্রেজটি ব্যবহার করেছেন। যাহোক, মানবিক রূপের বয়ান এবং নন্দনতত্ত্বের গূঢ় আলোচনা এই উপন্যাসকে ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। জীবনের সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক বিচার এবং সেখান থেকে জাত টানাপড়েন Death in Venice-এর সার কথা।
Death in Venice বেরিয়েছিল ১৯১৩ সালে। তার প্রায় এক যুগ পর ১৯২৪ এর শেষ দিকে, প্রকাশিত হয় মানের সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস The Magic Mountain। এপিক মাত্রার এই উপন্যাসে মান ইউরোপের সভ্যতার ক্ষয়িষ্ণু চেহারা এঁকেছেন। সেই সঙ্গে সমকাল এবং নিজের শিল্পমণ্ডিত জগতের বিশ্বাসযোগ্য চিত্রও অঙ্কিত হয়েছে এখানে। জার্মান লিবারেলিজম (উদারনীতি) এর চেহারা এবং তার পরিণতির চিত্র দক্ষ হাতে আঁকতে পেরেছেন। লেখক The Magic Mountain-এ’র অন্যতম প্রধান থিম, আগেই বলেছি, সঙ্কটগ্রস্ত ইউরোপের সংস্কৃতির স্বরূপ তুলে ধরা। লেখক এ কাজটি করেছেন চমকপ্রদ প্রতীকের ব্যবহারের ভেতর দিয়ে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য থিম হচ্ছে, মৃত্যুর মতো কঠিন সত্যকে রঙ-তামাশার ভেতর দিয়ে উপেক্ষা করা। The Magic Mountain যদিও আকৃতিতে ঢাউস, কিন্তু বিষয়বস্তুর বিচারে এটা ‘বড়’ বই। সেদিক থেকে টলস্টয়ের War and Peace বা আলব্যেয়র, কামুর The Plague বা জর্জ অয়ওয়েলের 1984 বরঞ্চ ‘বড়’ উপন্যাস। বলছি এ জন্য যে, টলস্টয় কিংবা কামুর মতো জমজমাট কোনো ঘটনা নেই মানের হাতে। আর সে জন্যই হয়তো যক্ষা হাসপাতালের সংক্ষিপ্ত পরিসরের আশ্রয় নিতে হয়েছে তাকে। অবশ্য আমার এও মনে হয়েছে যে, হান্স ফাস্টর্প (প্রধান চরিত্রগুলোর একটি) এর বহুমুখী জীবনান্বেষা উপন্যাসটির বিষয়বস্তুগত দুর্বলতার সিংহভাগই পুষিয়ে দিয়েছে। অতএব হান্স ফাস্টর্পের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে সম্মিলিত জীবনের (যার মধ্যে যক্ষা রোগীরাও আছে) বহুবিস্তৃত অভিজ্ঞতার মূল্য বিচার সমীচীন বলে মনে হয়।
The Magic Mountain-এর Carnival অধ্যায়ে Walpurgis Night নামে একটি রাতের বর্ণনা আছে। সেই রাতে যক্ষা হাসপাতালের রোগীরা কেউ থার্মোমিটার, কেউ বা রেখাচিহ্নিত ঔষধের শিশি সেজে অদ্ভুত রঙ-তামাশায় মেতে ওঠে। এভাবে তারা অনিবার্য মৃত্যুকে উপেক্ষা করতে চায়। বিষয়টিকে আমরা রোগ-বিস্মৃতির বিলাস হিসেবেও দেখতে পারি। বক্তব্যকে সুদৃঢ় করার গরজে এই যে অভিনব পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন টমাস মান, এটা তার গভীর শিল্পবোধেরই প্রকাশ। উপন্যাসে বর্ণিত হাসপাতালটি যেন দুর্দশাগ্রস্ত ইউরোপীয় সংস্কৃতির আধার। নানা দেশ থেকে আগত রোগীদের নিয়ে তৈরি পরিবেশে, সে জন্যই, আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি গোটা ইউরোপের অবক্ষয়ী ভাববিশ্বটি। যারা উপন্যাসটি পড়েননি তাদের অনেকেরই এই আলোচনা এ পর্যন্ত পড়ার পর মনে হতে পারে, The Magic Mountain আগাগোড়া মন-খারাপ করে দেয়া একটি মর্বিড গ্রন্থ। আসলে তা নয়। কৌতূক বা মজা পাওয়ার মতো অনেক বিষয়ও এতে আছে। আছে প্রেম-ভালোবাসাসহ নর-নারীর বা শুধু পুরুষে-পুরুষে বিচিত্র সম্পর্কের টানাপড়েন। পাঠক এখানে দেখতে পাবেন নিকোলাস ও সোনিয়ার প্রেম। এটা মোটামুটি স্বাভাবিক প্রণয়। কিন্তু ফাস্টর্প এবং ক্লাভদিয়ার সম্পর্ককে আমরা সাধারণ ও স্বাভাবিক বলতে পারি না। তার কারণ প্রেমিক-প্রেমিকা উভয়েই যক্ষায় আক্রান্ত। এবং তারা একই হাসপাতালের অধিবাসী। অজেয় অসুস্থতার কারণে ভালোবাসার পাত্র-পাত্রী দু’জনের মনে যে দুর্মর বিষণ্নতা জন্ম নিয়েছে তা অবশ্যই মানবিক সম্পর্কের এক ভিন্ন মাত্রায় উত্তীর্ণ। হাসপাতালের রোগীদের জীবনযুদ্ধের ভেতর দিয়ে পশ্চিমা সভ্যতার ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার প্রতিফলন ঘটেছে যেভাবে, তাতে উপন্যাসকারের শিল্পচেতনার সুশৃঙ্খল রূপই প্রতিভাত হয়েছে। নিকোলাস-সোনিয়ার এবং ফাস্টর্প-ক্লাদভিয়ার প্রেমাখ্যান দু’টি ওই সমগ্র বিষয়ের এক একটি অংশ The Magic Mountain এর গল্প শুধুই রোগ এবং রোগীর বৃত্তান্তের ভেতর সীমিত হয়ে পড়তো, যদি-না লেখক পরোক্ষ ভঙ্গিতে পটভূমি বিস্তৃত করতে পারতেন। কেন্দ্রীয় চরিত্র হান্স ফাস্টর্পের বহুমুখী জীবন জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে ফিরেছে প্রাগুক্ত ওই স্বাস্থ্যনিবাসের পটভূমিতে। প্রাকৃতিকতা অথবা প্রাণরহস্য, সেটিমব্রিনির বিতর্ক, Walpurgis Night-এর অদ্ভুত ছদ্মবেশের আড়ালের উল্লাস-- এই সমস্ত কিছু গল্পের নায়কের সামনে উন্মোচিত করেছে জীবনের বিশালতাকে। উৎসবের রাতের চপলতা ও প্রগলভতার নেপথ্যে থাকা করুণ রসের ভেতর দিয়েই তার (হান্স ফাস্টর্পের) জীবনদর্শনকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। Peeper corn অধ্যায়েও জীবনের বহুরূপী জটিলতার এবং তার বেদনার শিল্পসম্মত প্রকাশ লক্ষ করা যায়। নায়ক ফাস্টর্প মানুষের ইতিহাস সম্বন্ধে অবগত। তার বহুমুখী বিচিত্র অভিজ্ঞতা The Magic Mountain-এর বিষয়বস্তু। উপন্যাসে বর্ণিত প্রেমের আখ্যানও সেই বিষয়ের প্রয়োগগুণে ঋদ্ধ এবং অনন্য হয়ে উঠেছে।
১৯৩৬ সালের গোড়ার দিকে জার্মান শরণার্থীদের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে টমাস মান খ্রিস্টান ধর্মের পশ্চিমি নৈতিকতার এবং সভ্যতাপরিপন্থী কর্মকাণ্ডের জন্য নাৎসিদের নিন্দা করেন। এর ফলে তার নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়। ক্ষুব্ধ, ব্যথিত মান তার জবাব দেন কলমে, ‘An exchange of Letters’ (১৯৩৭) রচনার মাধ্যমে। এই লেখায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মানের অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে জ্বালাময় ভাষায়। রচনাটি বিশ্বের অনেকগুলো দেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তারপর জার্মানিতে মানের সব ধরনের লেখা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। লেখক দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
১৯৩৮ সালে তিনি আমেরিকায় চলে আসেন। তারপর থেকে ফ্যাসিবিরোধী কর্মকাণ্ডে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় তিনি বহু জায়গায় ঘুরে বক্তৃতা দিয়েছেন। সর্বত্রই বিপুল সংখ্যক শ্রোতা আকৃষ্ট হয়েছে তার ভাষণে। পরের বছর ওই সব বক্তৃতা একত্রিত করে, The Coming Victory of Democracy নামে একটি বই প্রকাশ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মান সংস্কৃতির একটি আলোকিত অনন্য রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এবং তিনি এ-ও মনে করতেন যে, শিল্প ও রাজনীতি একটির থেকে অন্যটি আলাদা নয়। সুতরাং নীতিবোধকে সমুন্নত ও সম্মানিত রাখার গরজে প্রত্যেক লেখকেরই উচিত অন্তত বুদ্ধিবৃত্তির জায়গা থেকে প্রতিবাদী অবস্থান নেওয়া।
টমাস মান কিন্তু এইসব রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মানস বিক্ষিপ্তির মধ্যেও যথাসম্ভব নিজের মাথা শান্ত রেখে সৃজনশীল কাজ করে গেছেন। আমেরিকার নানা জায়গায় ঘুরে ফিরে অবশেষে ১৯৪১ সালে মান ক্যালিফোর্নিয়ায় স্থায়ী আবাস গাড়েন। ১৯৪৪ সালে পান মার্কিন নাগরিকত্ব। টানা চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় যাবৎ অত্যন্ত রুটিন মাফিক কাজ করেছেন এই বিশ্ববরেণ্য লেখক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি যেমন বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ফ্যাসিবিরোধী বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন, তেমনি সাহিত্যিক হিসেবেও নিজের লেখাজোখার কাজকে এগিয়ে নিয়েছেন।
উত্তরকালে মান আরও জটিল ও দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি গ্যেটে, এজরা পাউন্ড, জয়েস, এলিয়ট প্রমুখ মহারথী লেখকদের সঙ্গে তুলনীয়। পাউন্ডের মহা কবিতা Cantos, জয়েসের Finngan’s Wake এবং টি এস এলিয়টের Four Quartets এর মতো টমাস মানের Dr. Faustus ও একটি সত্যিকার কঠিন ও দুর্ভেদ্য গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সত্য যে কঠিন। কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।’ Dr. Faustus লেখার কাজে হাত দেওয়ার আগে মানও বোধ হয় ওরকম বলতেন মনে-মনে। আমার জীবনে যে তিনটি বিদেশি বই পড়তে গিয়ে সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয়েছে আমাকে তার একটি হচ্ছে এই Dr. Faustus। অপর দু’টি হলো Finnegan’s Wake এবং হার্ট ক্রেনের কাব্যগ্রন্থ The Bridge। এইসব গ্রন্থ পড়া এবং অনুধাবন করাও একটা সাধনার ব্যাপার।
উপন্যাসটির কেন্দ্রে আছেন নায়ক ফাউস্ট। এই ব্যক্তি রাজনৈতিক-সামাজিক নানান ঝঞ্ঝায় বিক্ষুব্ধ বিংশ শতাব্দীর বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিনিধি। কাহিনীর পটভূমি বিশ্বযুদ্ধপূর্ব (কিছুটা সমরকালীনও) জার্মানি। নানান ঘটনা এবং বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে ঔপন্যাসিক তার এই নায়কের মানস বিপর্যয় এবং অধঃপতন তুলে ধরেছেন। জার্মানি এবং ফাউস্টের নিয়তি এক সুতায় গাঁথা হয়েছে এখানে, অত্যন্ত কুশলী হাতে। কিন্তু লেখকের জ্ঞানের প্রাখর্য, জীবনভাবনার গভীরতা, উন্মার্গচারিতা, অতীন্দ্রিয়তা প্রীতি এবং এই সমস্ত কিছুর প্রয়োগ Dr. Faustus কে পরিণত করেছে তার সবচেয়ে কঠিন ও দুর্বোধ্য উপন্যাসে। আর সে কারণেই বিশ্বসাহিত্যের গড়পড়তা পাঠকের কাছে এই বই আদৃত হয়নি।
মানের সর্বশেষ কথাসাহিত্যের বই The Black Swan(১৯৫৪)। এটি একটি একশ আটাশ পৃষ্ঠার নভেলেট। জীবদ্দশায় এক প্রৌঢ়ার ফুরিয়ে যাওয়ার বেদনা এবং এক যুবকের প্রতি ওই মধ্যবয়স্কা নারীর প্রবল প্রবৃত্তিগত আকর্ষণ, এক কথায় এই রচনাটির উপজীব্য বিষয়। অল্প কথায় উপন্যাসের গল্পটি এরকম। পঞ্চাশ বছর বয়সের নারী রোজালি। এ বয়সেও তার কেবল দেহের গাঁথুনিই নয়, জীবন উপভোগের আকাঙ্ক্ষাও অটুট। এখনও সে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু যতো গভীরভাবেই সে জীবনের রস নিংড়ে নিতে চেষ্টা করুক, প্রকৃতির নিয়মের বাইরে তো যেতে পারে না। কাজেই রোজালি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করে, সে ফুরিয়ে যাচ্ছে। কেননা তার শরীরে পরিবর্তন আরম্ভ হয়েছে। রোজালির মন এখনো সজীব কিন্তু দেহের ভেতরটা শুকিয়ে আসছে। এ অবস্থায় সে মনকে সপ্রাণ রাখবে কিভাবে? তাই অন্তঃর্দ্বদ্ব তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। বিষয়টি রোজালি তার বন্ধুর মতো মেয়ে অ্যানার সঙ্গে শেয়ার করে। বুদ্ধিমতী অ্যানা দেহের এই প্রাকৃতিক পরিবর্তনকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে মাকে পরামর্শ দেয়। সে এও বলে যে, শরীরের পরিবর্তনের পাশাপাশি একটু সময় নিয়ে মনও পরিবর্তিত হয়। মেয়ের এসব কথায় রোজালি খুশি হতে পারে না। সে ভাবে, জন্ম দেয়ার ক্ষমতা এবং ইন্দ্রিয়জ কামনার সবটুকুই যদি নিঃশেষিত হয়ে যায় তাহলে নারীত্বের আর কী বাকি থাকে?
রোজালির এহেন মানসদ্বদ্ব চলাকালে তাদের পরিবারে এসে উপস্থিত হয় আমেরিকান যুবক কেন কিটন। কেনের বয়স চব্বিশ বছর। রোজালির মেয়ে অ্যানাকে সে ইংরেজি শেখায়। কেন এমন ছেলে যে সকলের সঙ্গে দ্রুত অন্তরঙ্গ হতে পারে। বিদ্যা-বুদ্ধিতেও অসাধারণ। তার সুগঠিত দেহ আকৃষ্ট করে রোজালিকে। ধীরে ধীরে সে কেনের সঙ্গে আলাপ জমায়। একটা গোপন, কুটিল আকাঙ্ক্ষা তাকে প্ররোচিত করে কেনের দিকে এগিয়ে যেতে। তার সামনে রোজালির ভাবান্তর, কথাবার্তায় বেরিয়ে পড়া চাপা উত্তেজনা এসব কিন্তু অ্যানের চোখ এড়ায় না। কিন্তু মায়ের এ ব্যাপারটিকে অ্যান সহানুভূতির চোখে দ্যাখে। জীবনের অপরাহ্নে এসে রোজালির হৃদয় কুমারী মেয়ের মতো নতুন করে প্রস্ফুটিত হলো। দেরিতে হলেও প্রেমকে এবার উপলব্ধি করলো সে। অন্যদিকে কেনের ভাব-ভঙ্গি, আকার ইঙ্গিত থেকে রোজালি বুঝতে পারে, সেও তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে।
এক সকালে অ্যানকে অবাক করে দিয়ে রোজালি বলে যে, তার সন্তান ধারণের ক্ষমতার চিহ্ন প্রকাশিত হয়েছে আবার। রোজালি অবুঝের মতো ভাবে, প্রেম তার দেহকে সঞ্জীবিত করেছে। এবার সে সত্যিই মিলিত হতে চায় কেনের সঙ্গে। একদিন রোজালি, অ্যানা, কেন ও এডওয়ার্ড (অ্যানার ভাই) একটা পুরনো দুর্গ দেখতে যায়। সেখানে আরও অনেক দর্শকের ভিড়ে ছেলে-মেয়েকে এড়িয়ে রোজালি তার প্রেমে পড়ার কথা কেনকে বলে। সে আরও বলে যে, ঐ রাতে সে কেনের কাছে যাবে। ভাগ্যের পরিহাস, রোজালি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। তার আগেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। জরায়ুর ক্যান্সার ধরা পড়ে। তার অপারেশন হয়, কিন্তু সে আর বাঁচে না।
ক্যান্সারের ক্ষত থেকে নির্গত রক্তধারাকে নারীত্বের পুনরুজ্জীবন ভেবে উল্লসিত হয়েছিল রোজালি। ক্যান্সারের বীজ শরীরে প্রবেশ করার ফলে ক্ষণস্থায়ী জেল্লা এসেছিল তার দেহে-চোখে-মুখে। রোজালি সেটিকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিল। তখন কে জানতো, মৃত্যু তার এত নিকটে। ভাগ্যের এই নির্মম পরিহাস The Black Swan-এর ট্র্যাজেডি। Death in Venice-এর নায়ক একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। ভেনিসে বেড়াতে গিয়ে তিনি এমন এক সুদর্শন কিশোরের দেখা পান যে, তার আকর্ষণে তিনি সেখানেই থেকে যান। যুগে যুগে শিল্পীরা যে আদর্শ সৌন্দর্যের সাধনা করেছে, ওই পোলিশ কিশোরটি যেন তারই জীবন্ত প্রতিমূর্তি। সে তুলনায় কেনের প্রতি রোজালির আকর্ষণটা স্থূল ও সাধারণ। তার এই আকর্ষণের মূলে আছে ইন্দ্রিয়জ বাসনা। শিল্প কিংবা ধর্ম বা দর্শনের প্রণোদনা নেই। সে কারণেই রোজালিকে, কেনকে আমাদের পরিচিত বৃত্তের মানুষ বলে মনে হয়। একই কারণে নভেলটি জনপ্রিয় হয়েছে, যদিও টমাস মান ঠিক পাঠকপ্রিয় সাহিত্যিক নন।
The Black Swan-এর গল্পটি আকর্ষণীয় নিঃসন্দেহে। কিন্তু একটা সরলভাবে বলে যাওয়া কাহিনি নয়। তার অপরাপর গল্প-উপন্যাসের মতো এখানেও মান অনেক সঙ্কেত এবং প্রতীকের আশ্রয় নিয়েছেন। সব মিলিয়ে এক ধরনের অস্পষ্টতাও তৈরি হয়েছে যা আবার অনেক পাঠকেরই পছন্দ নয়। লক্ষ করুন, এই উপন্যাসের তরুণ নায়ক হচ্ছেন আমেরিকান এবং বয়স্ক নায়িকা জার্মান। সুতরাং ক্ষয়জর্জরিত ইউরোপের ওপরে প্রাণবন্ত, দীপ্তিমান আমেরিকার প্রভাবের সাংকেতিকতার বিষয়টিও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। মানের শেষ বয়সের এই লেখাটিকে কোথাও অবসাদগ্রস্ততার ছাপ নেই। ভাষা কিছুটা সহজ, কিন্তু বুদ্ধিমত্তায় ভাস্কর এই রচনা। সব কিছু বিবেচনায় রাখলে বলতে হবে, The Black Swanও লেখকের একটি শক্তিশালী কাজ। ঔপন্যাসিক হেনরি জেমস তার বিখ্যাত Art of Fiction প্রবন্ধে বলেছেন, ‘As People feel life, so they will feel the art that is most closely related to it.’ জেমস কিন্তু এখানে People বলতে সাধারণ লোককেই বুঝিয়েছেন, জয়েসের মতো লেখকের রচনার রসাম্বাদন করতে পারেন তেমন পাঠককে বোঝাননি। সেই নিরিখে The Black Swan-এর মতো উপন্যাসের গুণগ্রাহীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। প্রধান কারণ, এই বইয়ের শিল্পিতা জীবনের সঙ্গে ‘most closely related’’। টমাস মানের পাঠক, আমার মতে, দু’রকম। একটা শ্রেণী যারা Buddenbrooks, The Black Swan বা বড় জোর, Death in Venice এর অনুরাগী। অন্য শ্রেণীটি The Magic Mountain এবং Dr. Faustus প্রভৃতি উপন্যাসের রসগ্রাহী। এসব রচনার পাঠকপ্রিয় হতে না পারার পিছনে প্রথম বাধা হচ্ছে এগুলোর বিষয়বস্তু। দ্বিতীয় বাধা সেই বিষয়বস্তুর কঠিন রূপায়ণপদ্ধতি। মানের গল্প-উপন্যাসে, বিশেষত উপন্যাসে, ডিটেল এত বেশি এবং প্রায়শই বর্ণনা এত দীর্ঘ যে, আধুনিক সাহিত্যের অগ্রসর পাঠকও কখনো কখনো ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলতে পারেন। পাঠকের বিরক্তির কারণ হতে পারে চরিত্র বিশ্লেষণের অতি পুঙ্খানুপুঙ্খতা, তির্যকতা, অবিচ্ছিন্ন দুঃখবাদ এবং নেতিবাচকতা। দুঃখবাদের বিষয়ে তিনি প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন দার্শনিক শোপেনহাওয়ারের দ্বারা, ২৩-২৪ বছর বয়সেই, যা উত্তরকালে তার কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান সুর হিসেবে দেখা যায়।
উপন্যাসের ভাষারীতি প্রসঙ্গে ফ্লবেয়ারের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। মন্তব্যটি হচ্ছে, If you know exactly what you want to say, you will say it well. এখন কথা হচ্ছে, বক্তব্যবস্তু প্রসঙ্গে স্বচ্ছ ধারণা থাকলেই তো আর রচনা সুলিখিত হবে না। সে জন্য চাই উদ্ভাবনী ভাষা আর কল্পনার বিশিষ্টতা। মানের হাতে দুটো জিনিসই ছিল। কাব্যগুণান্বিত গদ্যের একটি নিজস্ব রূপ আমরা লক্ষ করি এই মহান লেখকের মধ্যে, যেমনটি আমরা দেখেছি জয়েস, হেসিংওয়ে প্রমুখের ক্ষেত্রে। এখানে আরেকটা জিনিসের কথা না বললেই নয়। সেটা হচ্ছে লেখার বিষয়বস্তুর ওজন তার লিপিকৌশল নির্ধারণ করে দেয়। সে জন্য আমরা দেখেছি, প্রেমের গল্পের ভাষা একরকম, যুদ্ধের গল্পের ভাষা আরেক রকম। আমার বিবেচনা, টমাস মানের কথাসাহিত্যের বিষয়ের যে গাম্ভীর্য সর্বতোভাবে তার উপযোগী হয়েছে লেখকের বিশিষ্ট ভাষারীতি। Death In Venice থেকে দৃষ্টান্ত তুলে দিচ্ছি, Aschenbach saw much of the boy Tadzio, he saw him almost constantly; in a confined environment, with a common daily program, it was natural for the beautiful creature to be near him all day, with only brief interruptions. He saw him and met him everywhere : in the ground-floor rooms of the hotel, on their cooling journeys by water to the city and back, in the Sumptuous Piazza itself, and often elsewhere from time to time, in alleys and by ways, when chance had played a part. But it was during the mornings on the beach above all, end with the happiest regularity, that he could devote hours at a time to the contemplation and study of this exquisite phenomenon. Indeed, it was precisely this ordered routine of happiness, this equal daily repetition of favorable circumstances, that so filled him with contentment and jest for life, that made this place so precious to him, that allowed one sunlit day to follow another in such obligingly endless succession. (চতুর্থ অধ্যায়, পৃষ্ঠা-২৩৫, মিনারভা পেপারব্যাক সংস্করণ, ১৯৯৬)।
The Magic Mountain সহ মানের অন্য প্রধান সৃষ্টিগুলোর ভেতর ভাষার এই উঁচুমান লক্ষ করা যায়। আমাদের বাংলা সাহিত্যে গোরা, পুতুলনাচের ইতিকথা, খোয়াবনামা প্রভৃতি উপন্যাসের ভাষার মধ্যে লেখকের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যদীপ্তি উজ্জ্বলভাবে প্রতিফলিত হতে দেখি। শুধু তাই নয়, বড় পরিসরের এইসব লেখায় ঔপন্যাসিকের সামঞ্জস্যজ্ঞান এবং আন্তঃসম্বন্ধবোধ যেভাবে প্রযুক্ত হয়েছে তা বিরল দক্ষতা ব্যতিরেকে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
উপন্যাসে আমরা কী খুঁজি? শুধুই জীবনের নানা রকম চেহারা? না কি জীবন সম্বন্ধে উপন্যাসকারের দৃষ্টিভঙ্গি বা বক্তব্যও? যদি দুটোই চাই, তাহলে বুঝতে হবে সার্থক উপন্যাস সৃষ্টির জন্য অভিজ্ঞতার সাহায্যে একটি অখণ্ড রসমূর্তি তৈরির কোনও বিকল্প নেই। টমাস মানের জীবনাভিজ্ঞতার ঝুলিটি যথেষ্টই ভারী ছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সর্বার্থে অসাধারণ এক লিপিদক্ষতা এবং হেনরি জেমস কথিত ‘quality of the mind’। নীতিশিক্ষা দেওয়া আধুনিক উপন্যাসের কাজ নয়। কিন্তু ঔপন্যাসিকের নৈতিক সচেতনতা থাকার প্রয়োজন আছে, যেটি না থাকলে তার অভিজ্ঞতার প্রয়োগমূল্য অনেকটা ফিকে হয়ে যেতে পারে।
মান সারাজীবন একটা আদর্শের জায়গা থেকে লড়াই করে গেছেন। সেই লড়াইয়েরই ভিন্নতর রূপ তার সাহিত্য ফর্মগুলো। তার ভাবতন্ময় ব্যতিক্রমী শিল্পজগৎ-- বিষয় মাহাত্ম্য, বাকচাতুর্য, অসাধারণ লিপিকৌশল এবং কীর্তির বহুমুখিতা --সবকিছুই আমাদের অবসরভাবনার উন্নত খোরাক। আর সে জন্যই, তার মৃত্যুর এত বছর পরেও, বিশ্বের গুণী পাঠক সমাজে তার লেখালেখির কদর এতটুকু ম্লান হয়নি।