Published : 15 Dec 2022, 11:07 PM
যে যুদ্ধ ভালেবাসার
সেখানে পরাজয় নেই
সেখানে বিজয়ী জাতির রক্তে
প্রতিদিন ভোর আসে
প্রতিদিন সূর্যোদয়ে
আত্মসমর্পণ করে হানাদার।
আমাদের একটি বিজয় দিবস আছে। সব জাতির বিজয় দিবস নেই। আমরা দেশকে ভালবেসে যুদ্ধ করেছিলাম অর্ধশতাব্দীপূর্বে— সেই যুদ্ধে আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনিকে পরাজিত করে অবিস্মরণীয় বিজয় পেয়েছি। যে যুদ্ধ দেশকে ভালেবাসার, সে যুদ্ধে পরাজয় নেই--আমরা সেটা প্রমাণ করেছি। আজ আমরা বিজয়ী জাতি।
এই বিজয় দিবস আমাদের শৃংখল মুক্তির দিবস—আমাদের রাষ্ট্র-স্বপ্নের পূর্ণতা প্রাপ্তির দিন। আজ পেছনে তাকালে মনে হয় কী গভীর আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাস জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। এই জন্য কত রক্তসাগর পাড়ি দিতে হয়েছে আমাদের! কত অশ্রুর বিনিময়ে এই অর্জন। আমাদের পতাকা এখন লালসবুজ পতাকা--মুক্তিযুদ্ধকালে এ পতাকা ছিল বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত। এখন সেটি নেই কিন্তু পতাকার গভীরে আজো আন্দোলিত সেই মানচিত্র, তিরিশ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগ, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরগাথা --সম্ভ্রমহারা কত মা বোনের কান্না! সর্বোপরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুনিয়া কাঁপানো নেতৃত্ব।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয় দিবস আর আজকের বিজয় দিবসে অনেক তফাত। সেদিনের বিজয় দিবস এরকম অবিমিশ্র আনন্দের ছিলনা। নয় মাসব্যাপী পাকিস্তানি দখলদার বাহিনি ও তাদের দোসর আলবদর রাজাকাররা যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার জন্য এর আগে প্রকাশ্যে শোক করতে পারেনি অবরুদ্ধ দেশের মানুষ, অন্যদিকে রণাঙ্গনে শহিদ হয়েছেন লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা। সেদিনের বিজয় দিবস ছিল আনন্দ ও স্বজন হারানো শোকের অশ্রুতে একাকার।
এতকাল পরে তিরিশ লক্ষ শহিদের মৃত্যুর সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে থাকার বেদনাভার অনেকটা লাঘব হয়েছে--সময়ের ধুলোর নিচে চাপা পড়ে গেছে আত্মত্যাগের অনেক ইতিহাস। তাই শুধু উদযাপনই বিজয় দিবসের সবকিছু নয়। বিজয় দিবস মানে আত্মত্যাগ ও গৌরবের ইতিহাসের কাছে ফিরে যাওয়া।
নেশান বা জাতি একদিনে সৃষ্টি হয়না। জাতিসত্তার বহু শতাব্দীর সাংস্কৃতিক মিথষ্ক্রিয়া ও আন্দোলন সংগ্রামের নানা পথ পেরিয়ে সৃষ্টি হয় জাতির। এর জন্য আরো প্রয়োজন জাতি হিসাবে সৃষ্টি হওয়ার প্রকাশ্য ও সম্মিলিত অভিপ্রায়ের। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি হিসাবে সৃষ্টি হওয়ার অভিপ্রায় প্রকাশ করেছিল, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে--এর চুড়ান্ত পরিণতি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাঙালির কাঙ্ক্ষিত বিজয়ে।
আজকের তরুণ প্রজন্ম এই ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী নয়। তারা এই ইতিহাসের উত্তরাধিকার, এর উপরই দাঁড়িয়ে আছে তাদের ভবিষ্যত--সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন। বিগত অর্ধ-শতাব্দীতে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা হয়েছে বহুভাবে--যার জের চলেছে একুশ বছর। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। রাজাকারের গাড়িতে লাল সবুজ পতাকা উড়েছে। এভাবে ম্লান হয়েছে মহান বিজয়ের অনিন্দ্য অর্জন। সেই স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিকূল সময় পেরিয়ে শেখ হাসিনার যুগান্তকারী নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এখন ক্ষমতায়। বাংলাদেশ এখন আর স্বল্পোন্নত রাষ্ট্র নয়--উন্নয়নশীল দেশ। কিন্তু এখনো ষড়যন্ত্র চলছে--বাংলাদেশের অগ্রগতিকে রুখে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। দেশকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে পিছিয়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র। তরুণ প্রজন্মকেও এ বিষয়ে সচেতন ও সজাগ হতে হবে। সে জন্য প্রথমেই প্রয়োজন বাঙালির আত্মত্যাগ ও গৌরবের ইতিহাস জানা, এই ইতিহাসই আমাদের আত্মপরিচয়।
১৫.১২.২০২২