Published : 02 Sep 2024, 12:54 AM
আগে ভ্যান চালাতেন, এখন দিনমজুর। দৈনিক যে কাজ জোটে তা দিয়ে সংসার টেনে নিচ্ছিলেন আব্দুল মজিদ; যার বড় ছেলে মাদ্রাসায় পড়েন, মেয়ে অনার্স সম্পন্ন করেছেন। আর ছোট ছেলে স্নাতকে পড়ছেন ঢাকার একটি নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
নিজের আয়ে না কুলাতে পারলে ধারদেনা করেছেন, আবার কাজ করে দেনা পরিশোধ করেছেন। বন্যার কারণে পানিবন্দি আব্দুল মজিদের এখন কোনো কাজ নেই, আয়ও নেই। উল্টো বাড়তি ধারদেনা করে ছোট ছেলেকে পাঠাতে হচ্ছে খরচ। আর টাকার জন্য মেয়েকে ভর্তি করাতে পারছেন না মাস্টার্সে।
লক্ষ্মীপুর সদরের পার্বতীনগর ইউনিয়নের উত্তর মকরধ্বজপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মজিদ বলছিলেন বন্যা কীভাবে তার পরিবারের জীবিকায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্যায় কাজহীন হয়ে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ আর নিজের হার্টের সমস্যার ওষুধের খরচ মেটাতে বড়ই কষ্ট হচ্ছে বয়স্ক এই পিতার।
শনিবার সদরের জকসিন বাজারে নেমে মিরিকপুরের দিকে পা বাড়াতেই সড়কে পানি। প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে মিরিকপুর বাজার পেরিয়ে বাঁ দিকে উত্তর মকরধ্বজপুর গ্রাম।
গ্রামের প্রধান রাস্তাটির পুরোটাই এখনও প্রায় হাঁটু পানির নিচে। রাস্তার পাশের ঘর থেকে পানি নামলেও বাড়ির উঠানে পানি রয়েছে। আর রাস্তা থেকে একটু দূরের কোনো বাড়ির পথে পা বাড়ালেই কোমর পানি, কোথাও বুক সমান পানি পার হতে হচ্ছে। মূল পথ ধরে প্রায় এক কিলোমিটার এগোতেই দেখা হল আব্দুল মজিদের সঙ্গে।
কথা হলে তিনি বলেন, বন্যায় অন্য কোনো কষ্ট নেই। কষ্ট শুধু ধারদেনা নিয়ে; কাজ করতে না পারায় দেনার চাপে পড়ে যাচ্ছেন দিন দিন।
তবে দিনমজুরি করে তিন সন্তানকে সুশিক্ষিত করা, বিশেষ করে ছোট ছেলেকে ঢাকার নামি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পারার মধ্যে শত কষ্টের আড়ালেও তার চোখে-মুখে যেন তৃপ্তির ঝিলিক।
তিনি বেশ গর্বের সঙ্গে বলছিলেন স্বল্প আয়েও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করা ছোট ছেলেকে এইচএসসি পড়িয়েছেন ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী পাবলিক কলেজে। এর আগে স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন তার ছেলেটি।
এর আগে অর্থাভাবের মধ্যেও বড় ছেলেকে মাদ্রাসা থেকে টাইটেল পাস করিয়েছেন আব্দুল মজিদ। আর একমাত্র মেয়েকে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ থেকে অনার্স করিয়েছেন, যাকে মাস্টার্সে ভর্তি করানোর পর বিসিএস দেওয়াবেন বলে তুলে ধরেন এই সংগ্রামী বাবা।
আব্দুল মজিদ বলেন, “আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শোকর। জীবনে আমি গাছকাডা, টুকিটাকি মাঠের কাজ করি চেষ্টা কইচ্চি তাদেরকে মানুষ করার জন্য। এখন এ পর্যন্ত আঁনি পৌঁছাইছি।"
"এহন কাজকর্ম নাই, একটা গরু, একটা বাছুর আছে। প্রতিবছর একটা বাছুর বড় করি বিক্রি করে ২০-৫০ হাজার টাকা হয়। আর কোনো রকম হাওলাত-বরাত করি বাচ্চাটা হড়াইতেছি।"
ঢাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেটি টিউশন করেন, তারপরেও তার থাকা-খাওয়াসহ আরও অনেক খরচ রয়েছে; যা সময়ে সময়ে জোগান দিয়ে থাকেন তার বাবা আব্দুল মজিদ।
তিনি বলেন, "টাকা আমি দিতেছি, হাওলাদ (ধার) করি এর মদ্যেও ২ হাজার পাডাইছি। আর আমারে হাওলাদ দিতে কেউ মানা করে না। আঁই আবার কাজকর্ম করি হোজাই (পরিশোধ)। এ অবস্থায় আছি।"
"পানির কারণে কাম-কাজ না থাকায় ধারদেনা বেশি করন লাইগতেছে। বহু কষ্ট করি পড়ালেখা করাইতেছি। মেয়েটারে এখনও মাস্টার্স করাইতে ফারিনো পয়সার কারণে। এক বছর পিছাই গেছে, গতবছর অনার্স ফাইনাল দিছে।"
মাঠের যে কোনো কাজে রোজ ৪০০ আর গাছ কাটার কাজ করলে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পেতেন জানিয়ে আব্দুল মজিদ বলেন, "এখন কাজ-কাম তো বন্ধ ধরেন, সামান্য টুকিটাকি কাজ কইত্তেছি। কেই ধরেন জাল টানায় দিতে কইলো, কেউ বাঁশ কাডি দিতে কইলো। বন্যার কারণে বাচ্চাদেরকে পয়সাকড়ি দিতে পাইত্তেছি না।"
"আমার হার্ডের সমস্যা (হৃদরোগ)। একবার অ্যাটাক হইছে; ওষুধ খাইতেছি। এখন ওষুধ-টষুধ কিনা বা চলাফেরার সমস্যা হইছে। বাইচ্চাদেরকে এ অবস্থায় নিয়া আছি।"
আব্দুল মজিদের বাড়িতে পানি উঠেছে। রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে তার বাড়ি যেতে হয়। বাড়িতে মেয়ে, স্ত্রী ও বড় ছেলের পরিবার নিয়ে তার সংসার। বড় ছেলে বিয়ে করেছেন দুই বছর হলো। তার আট মাসের এক শিশু সন্তান আছে। একসময় গাজী গ্রুপে চাকরি করলেও বড় ছেলে এখন বেকার।
তবে বড় ছেলে চাকরিকালীন প্রতিমাসে যে ৭-৮ হাজার টাকা দিয়েছেন বাবাকে, তার সবটাই ছোট ছেলেকে পাঠিয়ে দিতেন আব্দুল মজিদ।
বন্যায় খাওয়া-দাওয়া কীভাবে চলছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “খাই আছি। মানুষও দিতাছে। বন্যা আইছে ধরি মানুষ আইসতেছে। সাহায্য কইত্তেছে, যা দিছে এই জন্য শুকরিয়া। যারা এগুলা করে, তাদের লাগি কৃতজ্ঞ।"
"টিন দিয়া চকির ওপরে চাইরটা রাইনতেছে, খাইতেছি। হুনছি হেনীর ওরা যেই অবস্থায় আছে, এর চাইতে অনেক বালা আছি।"
ঘুরে ফিরে আবারও শত কষ্ট করে সন্তানদের পড়াশোনার গল্প বলে যাচ্ছিলেন আব্দুল মজিদ। তিনি অনেক আগে একবার কাজের সন্ধানে ওমানে গিয়েছেন। সুবিধা করতে পারেননি, এক মাস জেল খেটে দেশে ফিরে আসেন। সেখানে গিয়ে পড়াশোনার গুরুত্ব বুঝে সন্তানদের যেভাবেই হোক পড়াশোনা করাবেন সংকল্প থেকেই তিনি চেষ্টা করেছেন, সন্তানরাও তার প্রতিদান দিয়েছে বলে তিনি অনেক বেশি তৃপ্ত আব্দুল মজিদ।
তিনি বলেন, "নিজে কষ্ট কইচ্চি। নিজের হরনের একটা লুঙ্গি নাই। হেদের (সন্তানদের) কাপড় আমি গায় দি, মানে হেগো যেডি। হেগোরে টাকা দি, হেরা কিনি কয়দিন পিন্দি রাখি যায়, হেগুলা আমি আইজও হড়ি।"
এর মধ্যে মেয়ের বিয়ের অনেক সম্বন্ধ এলেও তাকে বিয়ে দেননি লড়াকু পিতা আব্দুল মজিদ। তিনি বলেন, মেয়ে মাস্টার্সের পাশাপাশি বিসিএস প্রস্তুতি নেবেন বলে তাকে কথা দিয়েছেন। ছোট ছেলেও অনার্সের পর বিসিএসের প্রস্তুতি নেবেন।
সন্তানদের পড়াশোনার খরচ যোগাতে এখনও ২ লাখ টাকা ঋণ আছে জানিয়ে আব্দুল মজিদ বলেন, "বছরে একটা গরু বেঁচি ৫০-৬০ হাজার টাকা যা পাই, এগুলা হেগো দেনা দি। এহন পানিতে গরু দুইডা হালতেও কষ্ট হইতেছে। খেরাহারা ডুবি গেছে।"
ভালো নেই দিনমজুররা
আব্দুল মজিদের মতো বন্যার কষ্টেও তৃপ্তির অনেক গল্প থাকলেও মকরধ্বজপুর গ্রামের কোনো দিনমজুরই ভালো নেই। কাজ বন্ধ থাকায় আয় নেই অনেক দিন। বাড়ি ছেড়ে অনেকেই উঠেছেন বিভিন্ন স্কুল-মাদ্রাসার আশ্রয়কেন্দ্রে। যারা বাড়ি আছেন, তাদের অনেকেরই চুলা জ্বলছে না।
রাজমিস্ত্রীর কাজ করে এক সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালান বেলাল হোসেন। বৃষ্টির শুরু থেকে বন্যা পর্যন্ত প্রায় মাসখানেক তার কোনো কাজ নেই। ঘরে পানি থাকায় রান্নারও উপায় নেই। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে চেয়ে খাচ্ছেন, আর শুকনা খাবারে দিন চলছে তাদের।
বেলাল বলেন, "বর্ষার কারণে কাজ-কাম হয় না। কোনো রকম পেট চালাইতেছি। এর ঘরে দুদিন, ওর ঘরে এক দিন খাইতেছি। কয়দিন আগে কিছু শুকনা খাবার দিছিল, ওই খাই আছি।"
ঘরে পানি না থাকলেও একই গ্রামের আরিফের উঠানে হাঁটু পানি। সেখানে দাঁড়িয়ে আরিফ বলেন, "বন্যায় আমাদের ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয় নাই, শুধু চলাফেরা ও কাজের সমস্যা। কারও কাজকর্ম নাই। তবে মানুষ ত্রাণ পাইতেছে। আইজকাও এক গ্রুপ দিয়া গেছে।"
ক্ষতিগ্রস্ত ঘরে ওঠা নিয়ে চিন্তায় গ্রামের মানুষ
বন্যায় অনেকেরই কাঁচা ঘরের মাটি সরে গিয়েছে, আবার অনেকের ঘর হেলে পড়েছে। ধীরগতি হলেও পানি কিছুটা কমতির দিকে। তবে পানি নেমে গেলেও সেসব ঘরে উঠবেন কীভাবে, এ নিয়ে চিন্তিত ক্ষতিগ্রস্তরা।
চার ছেলে-মেয়ে ও স্বামীসহ দেবরের ঘরে উঠেছেন তাসলিমা আক্তার। পানি বাড়তে থাকায় চৌকির ওপর চৌকি দিয়ে থাকার চেষ্টা করেন। খানিকটা হেলে পড়ায় এবং চালও কিছুটা ভেঙে পড়ায় একপর্যায়ে সেটাও সম্ভব হয়নি।
এখন দেবরের ঘরে উঠে থাকার জায়গা হলেও নিজেদের খাবার নিজেদের আলাদা যোগাড় করতে হচ্ছে। নিজের ভাঙা ঘর দেখিয়ে তাসলিমা বলেন, "হানি চলি গেলে এই ঘরে উডার কোনো উপায় নাই। ভাঙি গেছে।"
ত্রাণ নিয়ে সন্তুষ্ট সবাই
বন্যার শুরু থেকে বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ নিয়ে নানা অসুন্তুষ্টি ও অব্যাবস্থাপনার অভিযোগ পাওয়া গেলেও লক্ষ্মীপুরের এই এলাকায় তেমনটি নয়।
জাকির হোসেন বলেন, "বড়-ছোড বেকেরেই যা আইসতেছে দেওয়া হইতেছে। কেউ যদি ইচ্ছা করি না রাখে, সেইটা তার বিষয়। কিন্তু বন্যায় বেকেই কষ্টে আছে। বেকেরেই দেওয়া হইতেছে।"
পানিতে নিজের ঘরে থাকার উপায় নেই, তাই দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়িতে উঠেছেন এক নারী। সেখানে পানি থাকলেও কিছুটা কম। স্বামী মানসিক রোগী, তাকেই সব সামলাতে হচ্ছে।
ত্রাণ পেয়ে খুশি এই নারী বলেন, "এগুন পাইতেছি তাই খাই আছি। আল্লাহ সব ভাইগরে ভালো রাখুক। তারা কোন দেশেরতে কোন দেশে আসি সাহাইয্য কইতেছেন। সবাইরে ভালা রাখুক।"
এই এলাকায় বন্যায় বিদ্যুৎ না থাকায় আর পানির টিউবওয়েল সব তলিয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে বলে তুলে ধরেন ওই নারী।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পার্বতীনগর ইউনিয়নের উত্তর মকরধ্বজপুর গ্রামে বেশকিছু স্বেচ্ছাসেবী দলকে শনিবার ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে একটি দল এসেছে কুমিল্লার তিতাস থেকে। বেশকিছু শিক্ষার্থী নিজেদের উদ্যোগে সাধ্যমত সহায়তা নিয়ে এসেছেন।
তাদের একজন তৌহিদুল ইসলাম তামিম বলেন, "আমরা বন্ধুরা মিলে পাঁচশর বেশি প্যাকেট নিয়ে এসেছি। যতটুকু পারছি দিচ্ছি। যদি পারি আরও দিবো। আমার মনে হয় এলাকার অনেকেই ভালো নাই। খাওয়ার মতো পরিষ্কার পানি নাই। রাস্তার অবস্থা হাঁটুপানি, কোনো বাড়িতে যেতে হলে এখনও বুক সমান পানি। আমরা রাস্তার ওপরে থেকে দিচ্ছি, আমাদের আরেকটা গ্রুপ নৌকা নিয়ে গেছে।"
বন্ধ লক্ষ্মীপুরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান সড়ক
লক্ষ্মীপুর পৌঁছাতে চৌমুহনী চৌরাস্তা থেকে পশ্চিম দিক বরাবর প্রধান সড়কটি প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ রয়েছে। বন্যার পানিতে সড়কে অনেক খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া পানি রয়েছে এখনও অনেক জায়গায়।
নোয়াখালীর মাইজদী হয়ে চলাচল করছে লক্ষ্মীপুরগামী সকল যানবাহন। মাইজদী বাজার থেকে ভেতরের একটি পথ হয়ে চন্দ্রগঞ্জ বাজারে গিয়ে লক্ষ্মীপুরের প্রধান সড়কে উঠছে যানবাহন। ঘুরাপথ এবং সরুপথ হওয়ায় লক্ষ্মীপুরের দূরত্ব যেমন বেড়েছে, তেমনি পৌঁছাতে সময়ও লাগছে বেশি।
এই পথে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক মো. ফয়সাল বলেন, বাংলাবাজার থেকে চৌমুহনী চৌরাস্তা পর্যন্ত অনেক জায়গায় পানি আছে এখনও। অনেক বড় বড় গর্ত তৈরি হওয়ায় সে পথে যাচ্ছে না বাস-ট্রাকের মত যানবাহন।
বেড়েছে সাপের উপদ্রব
লক্ষ্মীপুরে বন্যায় সাপের উপদ্রুব দেখা দিয়েছে। গত ১০ দিনে জেলার বিভিন্ন স্থানে ১১২ জন সাপে কাঁমড়ানো রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে।
শনিবার জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সদর হাসপাতালে ৮০ জন, রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সাতজন, রামগঞ্জে ১৪, কমলনগর ১১ জন সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।