Published : 11 Aug 2024, 11:16 PM
সরকার পতনের দুদিন পর থেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ছোট-বড় শপিংমল ও মার্কেট খোলা শুরু হলেও দোকান মালিকদের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি পুরোপুরি।
তবে কাচাবাজার ও মাছবাজারে চাঞ্চল্য ফিরতে শুরু করেছে, বেড়েছে বিক্রিও।
পোশাক ও অন্যান্য সামগ্রীর দোকান মালিকরা বলছেন, আতঙ্কের মধ্যেই সাহস করে দোকান খুললেও ক্রেতার সমাগম খুবই কম, ফলে বেচাকেনা নেই বললেই চলে।
গণআন্দোলন ও জনরোষের মুখে ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ৮ অগাস্ট দেশের দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জুলাইয়ের প্রথম থেকে শুরু হওয়া এই ঘটনাপ্রবাহে শেষপর্যন্ত ক্ষমতার পালাবদল হলেও এখনও তার রেশ কাটেনি বলে মনে করছেন দোকান মালিকা ও মার্কেট মালিকরা।
রোববার ঢাকার টিকাটুলির রাজধানী সুপার মার্কেটে গিয়ে দোকানিদের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলছেন, গত এক মাস ধরে তাদের বিক্রি একেবারেই কম।
সেখানকার ‘মায়ের দোয়া শাড়ি’ দোকানের বিক্রয়কর্মী আব্দুস সালাম বলেন, “গত এক মাসের মধ্যে ১০ দিনই দোকান বন্ধ রাখছি। একেবারে বেচাবিক্রি নাই। দেশের যে অবস্থা, মানুষ দরকার ছাড়া বাইরেই বের হয় না, কেনাকাটা তো দূরের কথা।”
রাজধানী সুপার মার্কেটের জুয়েলারি ব্যবসায়ী আরিফ। কথা হলে বিডিনিউজ টোয়েন্টেফোরকে তিনি বলেন, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা।
“আমাদের যে লস হইছে, সেইটা পূরণ হতে ৬ মাস লেগে যাবে। কিন্তু মানুষ তো এখন শান্তিতে নাই। মনে শান্তি না থাকলে কি কেনাকাটা করতে আসবে?”
ধানমন্ডির মেট্রো শপিং মল, বসুন্ধরা শপিং মলসহ ঢাকার ছোট-বড় সব শপিং মল খুলেছে। তবে বেচাকেনা আগের মতো তো নেই-ই, এখন দোকান খোলা রাখতে গিয়েই লোকসান দিতে হচ্ছে বলে দাবি দোকান মালিকদের।
কাচাবাজারের পরিস্থিতি দেখতে রোববার ঢাকার কারওয়ান বাজারের গিয়ে দেখা যায় পাইকারি বাজারে ক্রেতা বেড়েছে।
সেখানকার সবজি বিক্রেতা আনিস মিয়া বলেন, “কোটা আন্দোলনের শুরু থেকেই বেচাকেনা নষ্ট হইয়া গেছিল। এত দিন মানুষ বাঁচব না মরব, সেটা নিয়াই ছিল আতঙ্কে। তখন বাজারে ক্রেতা তেমন আসে নাই।
“এবার একটা সমাধান হইছে। আতঙ্ক নাই। তাই বাজারে ক্রেতা ভিড়তেছে। এহন সব ঠিকঠাক হইবো।”
কারওয়ান বাজারে কেনাকাটা করতে দেখা গেল আল মামুন নামে এক ব্যক্তিকে।
সেখানে কথা হলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, আন্দোলনের সময় পাড়া-মহল্লার অলি-গলি থেকে মানুষ কেনাকাটা করত। বাজারে এসে কেনায় আগ্রহ ছিল না।
“আমিও বেশি জরুরি না হইলে আসতাম না। কিন্তু এখন আমরা নতুন, স্বাধীন দেশ পেয়েছি। বাজারেও ঘুরতেছি স্বাচ্ছন্দ্যে।”
‘বেচাবিক্রি করে দোকান ভাড়াও উঠেনি’
মহাখালী মাওয়া প্লাজার দ্বিতীয় তলায় লাবন টেলিকম দোকান বন্ধ রেখেছে প্রায় দুই সপ্তাহ। তারা বেচাবিক্রি করে গত মাসের দোকান ভাড়ার টাকাও তুলতে পারেননি।
সেখানকার বিক্রেতা সাগর আহমেদের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, “মানুষের ভেতরে আতঙ্ক রয়েছে, তেমনি আর্থিক অবস্থাও খুব একটা অনুকূলে নাই বলে মনে হচ্ছে। তাই এর প্রভাব আমাদের বেচাকেনার পড়ছে।
“ভাড়ার টাকা দিতেই হিমশিম খেতে হইছে। নিজেদের পকেট থেকে ভর্তুকি দেওয়া লাগছে। আর কর্মচারী বিল দেওয়া লাগছে বিগত মাসগুলোর যে প্রফিট ছিল, সেখান থেকে।”
একই মার্কেটের গ্রিন প্লাস মোবাইল সার্ভিসিংয়ের স্বত্বাধিকারী সাদিকুল ইসলাম বলেন, আন্দোলনের সময় বেচাকেনা কম ছিল। দোকান বন্ধ ছিল টোটাল এক সপ্তাহ।
“আমার এই দোকানের ভাড়া ২০ হাজার টাকা। ভাড়া পরিশোধ শেষে টাকা তেমন একটা হাতে নাই। তবে এখন আস্তে ধীরে মানুষজন ঢাকা ভিড়তেছে। সব স্বাভাবিক হবে এই প্রত্যাশায় আছি।”
তেজগাঁওয়ে মুদি দোকান আমান জেনারেল স্টোরের সামনে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে প্রায় ১ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দেখা যায়, মাত্র তিনজন ক্রেতা এসেছেন। তবে তারাও খুব বেশি পণ্য কিনলেন না।
নাহিদ ইসলাম বলেন, “আগের তুলনায় বেচাকেনা এখন অর্ধেকে নেমেছে। আসলে কাস্টমার কম। হঠাৎ কোন দিক দিয়ে মারামারি শুরু হয়, এখনও সেই ভয় মানুষের ভিতরে কাজ করে। তাই প্রয়োজন ছাড়া মানুষ কম বের হয়।
“আর যারা গ্রামে গেছে তারা সবাই ঢাকা ফিরে নাই বলে জানতে পারছি। সবাই ফিরলে আর মানুষের ভয় চলে গেলে বেচাকেনা স্বাভাবিক হবে বলে আশায় আছি।”
নাহিদের দোকানের পাশে নুরুল ইসলাম ফার্নিচার। বেলা পৌনে ১১টায় সেটি বন্ধ পাওয়া গেল। আশপাশের দোনকা মালিকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, নিয়মতি খুললেও সহিংসতার শুরু থেকে দোকানটি আর তেমন খোলা দেখা যায়নি।
পাশের সামিরা লেডিস টেইলার্সের দোকানি মো. এরশাদ বলেন, আন্দোলনের সময় থেকেই দোকানটি বন্ধ দেখছি। মাঝখানে একদিন খুলেছিল। কিন্তু আর খুলতে দেখা যায়নি।
‘ছাড়’ দিয়ে ক্রেতা ধরার চেষ্টা
অস্থির সময়ে ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টাও করছেন দোকান মালিকরা। এরই অংশ হিসেবে তারা ‘ছাড়’ ঘোষণা করছেন বিভিন্ন পণ্যে। অনেক ব্রান্ড শো রুমের সামনে ‘বিশাল ছাড়’ ব্যানার দেখা গেল রোববার।
ধানমন্ডির জিগাতলায় এপেক্সের শো রুমে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়েছে। শো রুমটি জুলাইয়ের প্রায় ১০ দিন বন্ধ ছিল। আর আগস্টে বন্ধ থাকে তিন দিন।
সেখানকার একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শো রুমটির যে ভাড়া, তা-ই তো গত মাসের বিক্রিতে ওঠে নাই “
এপেক্সের ওই শো রুমের ক্যাশিয়ার ফয়সাল হোসেন বলেন, “বেচাকেনা গত মাসে খুবই কম হইছে। এ মাসের শুরুতেও বেচাকেনা কম ছিল। তবে ছাড় দেওয়ার পর থেকে ক্রেতার সংখ্যা বেড়েছে। দুই দিন ধরে বেচাকেনা ভালো।”
সেখানে মাহমুদ হাসান নামে একজন ক্রেতার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আসলে কেনাকাটার ইচ্ছা এখন ছিল না। বাইরে ছাড় লেখা দেখে এসেছি। কিন্তু মনে হচ্ছে ছাড় দেওয়ার পরেও দাম বেশি।
আগুনে পুড়ে ছাই ধানমন্ডির ইয়েলো
সরকার পতনের আগের দিন বিকালে আন্দোলনকারীরা আগুন দেয় পোশাকের চেইন প্রতিষ্ঠান ইয়েলোর ধানমন্ডির জিগাতলা শাখায়। কয়েক ঘন্টায় পুড়ে ছাই হয়ে যায় আউটলেটটি।
শপিংমলটির পেছনের অংশে ছিল বেক্সিমকো গ্রুপের অফিস, সেটাও পুড়ে পুরো স্থাপনার এমন অবস্থা হয়েছে যে, কেউ দেখলে আগের ছবির সঙ্গে মেলাতে পারবেন না।
এখন সেই জায়গায় পোড়া ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা হলে ভবনটি ধসে পড়ার আশঙ্কার কথা শোনালেন তারা।
রোববার দুপুর ১২টায় সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া ইয়েলোর আউটলেটটির ভেতরে কয়েকজন বসে আছেন। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, তারা ইয়োলোর লোক নন।
তাদের মধ্যে একজন রিকশা চালান, নাম মো. আজিজ। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভাই, জায়গাডা কেমন আছিল আর কেমন হইয়া গেল! জীবনে এই দিক দিয়া রিকশা নিয়া কতবার গেলাম, ভেতরে যাইতে পারি নাই। খালি বড় লোকরা আইতো। এহন এইহানের সব শেষ।”
ভবনটির মাঝামাঝি ও পেছনের অংশে বসে থাকতে দেখা যায় কর্মচারীকে। পুড়ে যাওয়া ভবনটির পাহারায় রয়েছেন তারা। হতাশার সুরে বললেন তারা, এখনও বেতন পাননি।
জুলাইয়ের বেতন অগাস্টের ১০ তারিখেই হয়ে যাওয়ার কথা। কোম্পানির এত বড় ক্ষতির কারণে এবার ঠিক কবে বেতন পাবেন, তা অনুমানও করতে পারছেন না তারা।
একজন বলেন, “আমাদের লোক ছিল আরও কয়েকজন। তাদের তো কাজ নাই এইখানে। এখন অন্য কোথাও চাকরি খোঁজা লাগতে পারে। কত সুন্দর ব্যবসা ছিল এটা। কত মানুষ চাকরি করতো এইখানে। এখন সব শেষ।”
দেশজুড়ে ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, “এ রকম একটা পরিবর্তনের সময় কিছুই যে হবে না, এটা ভাবা যায় না। তবে ক্ষতির পরিমাণ অনেক। ঢাকার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সিলেট ও কুষ্টিয়ায়। সিলেটে বড় ধরনের লুটপাট হয়েছে। সেখানে মাহি সুপার স্টোর থেকে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার মালামাল লুটপাট হয়েছে। এখন অবশ্য কেউ কেউ মালামাল ফেরতও দিচ্ছে।”
ঢাকায় বেচাকেনা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে কি না, এমন প্রশ্নে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, তাদের জানা মতে মানুষের বর্তমান আর্থিক অবস্থা খুব ভালো না। তাই বেচাকেনা খুব বেশি হচ্ছে না।
“এখন নতুন করে সবকিছু শুরু হচ্ছে। আশা করি খুব দ্রুত এ অবস্থা থেকে উত্তরণ হবে।”