Published : 06 Jun 2024, 04:33 PM
মাদক মামলায় ঢাকার আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বতসোয়ানার তরুণীর সাজা বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ মানবাধিকার ও প্রাণদণ্ড বিলোপে কাজ করা সাতটি আন্তর্জাতিক সংগঠন।
বুধবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সাত সংগঠনের একটি যৌথ বিবৃতিতে এ আহ্বান জানানো হয়।
আড়াই বছর আগে ঢাকার বিমানবন্দেরে তিন কেজি ১৪৫ গ্রাম হেরোইনসহ গ্রেপ্তার হওয়ার মামলায় বতসোয়ানার তরুণী লেসেডি মোলাপিসিকে ২৭ মে ঢাকার অষ্টম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আমিনুল ইসলাম মৃত্যুদণ্ড দেন।
এ সাজার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সাত সংগঠনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ও ৪০২ ধারা এবং সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদ বলে বাংলাদেশের আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়ে থাকে। অহিংস অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া আন্তর্জাতিক আইন ও মানদণ্ডের সঙ্গে পুরোপুরি অসংগতিপূর্ণ হওয়ায় আমরা প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মোলাপিসির সাজা কমানোর আহ্বান জানাচ্ছি।”
ইন্টারন্যাশনাল কনভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস-আইসিসিপিআরের অংশীদার হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য ‘জেনেবুঝে খুনের মত গুরুতর অপরাধেও যেখানে মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ার বিষয় রয়েছে’ সেখানে মাদক-সংক্রান্ত ঘটনার মামলায় প্রাণদণ্ড দেওয়া নিষিদ্ধই, বলা হয়েছে বিবৃতিতে।
মোলাপিসির মৃত্যুদণ্ড রোহিত করার যুক্তি দেখিয়ে সাত সংগঠন বলছে, ইন্টারন্যাশনাল নারকোটিকস কন্ট্রোল বোর্ড মনে করে মাদকসংক্রান্ত অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া জাতিসংঘের মাদক কনভেশনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
অ্যামনেস্টি ছাড়া বিবৃতিতে সই করা অন্য সংগঠনগুলো হল- অ্যান্টি ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক, ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রোজেক্ট, ডিটশোয়ানেলো- দ্য বতসোয়ানা সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস, এলিওস জাস্টিস- মোনাশ ইউনিভার্সিটি, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস ও অধিকার।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আহ্বানে বাংলাদেশ সরকার বা কর্তৃপক্ষের সাড়া দেওয়া সুযোগ আছে কিনা, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম তা জানতে চায় মোলাপিসির আইনজীবী ফারুক আহাম্মদের কাছে।
বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, “ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় রাষ্ট্রপতি চাইলে যে কোনো মামলা প্রত্যাহারের অনুমতি দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের একমত হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে হয়।
রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করা হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে ফারুক আহাম্মদ বলেন, এখনও এ মামলায় জেল আপিল করা হয়নি। রায়ে আপিল করার সময় বেঁধে আছে সাত দিন। সাত দিন পার হওয়ায় বিলম্বের জন্য ক্ষমা চেয়ে জেলা আপিল করা যেত। তবে যেহেতু অ্যামনেস্টিসহ সাতটি সংগঠন এগিয়ে এসেছে, ফলে আর জেল আপিল করব না।
ঢাকার আদালতে সাজা পাওয়া বিদেশিদের মুক্ত হওয়ার নজির অতীতেও আছে জানিয়ে মোলাপিসির এ আইনজীবী বলেন, “এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এলিয়েদা ম্যাককর্টের যাবজ্জীবন হয়েছিল। রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপে মার্কিন দূতাবাস তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সুতরাং উদাহরণ তো আছেই।”
পূর্বাপর
রায়ের বিবরণে বলা হয়, বতসোয়ানার নাগরিক মোলাপিসি ২০২২ সালের ২৩ জানুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ থেকে কাতারের দোহা হয়ে ঢাকাগামী ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন। গ্রিন চ্যানেল থেকে বের হওয়ার সময় তার সঙ্গে থাকা ট্রলি ব্যাগ স্ক্যান করে পাউডার বা দানাদার পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
ব্যাগের মধ্যে তিনটি ভ্যানিটি ব্যাগ ও একটি ফাইল ব্যাগ থেকে ৩ হাজার ১৪৫ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয়, রাসায়নিক পরীক্ষাতেও যার প্রমাণ মেলে। তখন এ পরিমাণ হেরোইনের বাজারমূল্য ছিল প্রায় ২০ কোটি টাকা।
ধরা পড়ার পর ঢাকার বিমানবন্দর থানায় মোলাপিসির বিরুদ্ধে মামলা করেন কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ফিরোজ আলম।
সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী মিলন হোসেন জানান, সোমবার আসামির উপস্থিতিতে রায় দেন বিচারক। মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে তাকে ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রায় শেষে তাকে সাজা পরোয়ানা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
মোলাপিসির সাজার পর তার আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, এ রায়ে তিনি সন্তুষ্ট নন।
“দণ্ডিত আসামি ইমিগ্রেশনেই ধরা পড়েছিলেন। তিনি ওই হেরোইন বিক্রি করেননি বা বিক্রির সুযোগ পাননি। ফলে কম সাজা দিলে ভালো হত। এমন অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিষয়টি বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করবে।”
দেশে মাদক মামলায় বিদেশিদের বিচার হওয়ার উদাহরণ টেনে ফারুক বলেন, প্রায় ৩০ বছর আগে ঢাকার একটি দায়রা আদালত বাংলাদেশে স্বর্ণ পাচারের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এলিয়েদা ম্যাককর্টকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল।
“তবে বতসোয়ানার নাগরিকের বিরুদ্ধে যে রায় হল, আমার জানা মতে, এটিই মাদক বহন করার মামলায় বাংলাদেশে কোনো বিদেশিকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের প্রথম ঘটনা।”
২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬(১) এর ৮(গ) ধারায় ২৫ গ্রামের বেশি পরিমাণ হেরোইন বহনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে।
ফারুক আহাম্মদ বলেন, মোলাপিসি অল্প অল্প বাংলা বুঝতে ও বলতে পারেন। তাকে সাক্ষীদের বক্তব্য পড়ে শোনানো হয় ও ইংরেজিতে বুঝিয়ে বলা হয়। তিনি সাফাই সাক্ষ্য দেননি। তবে আত্মপক্ষ সমর্থনের দিন নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন।
মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায়, মোলাপিসি ও মহিবুলকে আসামি করে ২০২২ সালের ৮ অগাস্ট আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়- পরস্পরের সহযোগিতায় তারা হেরোইনের কারবার করতেন।
২০২৩ সালের ২০ জুলাই মামলার অভিযোগ গঠন করে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করে আদালত। রাষ্ট্রপক্ষে ছয়জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করে আদালত মঙ্গলবার এক আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেয়।
মহিবুলের অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে আদালত খালাস দেন বলেন জানান ফারুক আহাম্মদ।