Published : 09 Aug 2024, 10:18 PM
‘হয়রানিমূলক’ মামলা প্রত্যাহার, সব মন্ত্রণালয় পরিচালনায় শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত রাখা, দ্রুত সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া, আর্থিক খাতগুলো সক্রিয় করতে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
শুক্রবার বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের প্রথম বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয় বলে জানিয়েছেন বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বেশ সময় নিয়ে আলোচনা করেছি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যত দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেটা নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে। আইজিপি মহোদয়ও সেখানে যোগ দিয়েছেন।
“যত দ্রুত সম্ভব যেন পুলিশ নেমে যায় এবং আমরা সকলেই জন্য তাদের সহযোগিতা করি। কারণ পুলিশের মত একটা বাহিনীর যদি মনোবল ভেঙে যায়, তখন সে অনিরাপদ বোধ করবেন। সেজন্য আমাদের শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা তাদের সঙ্গে কথা বলবেন।”
কিছু কিছু জায়গায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করে বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব করে, এমন সংস্থাগুলোর সাথে আলোচনা করে আপাতত একটা রক্ষা বলয় করা হবে। এ বিষয়ে আইজিপি মহোদয়ের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে।”
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে অনেক ‘হয়রানিমূলক’ মামলা হয়েছে মন্তব্য্য করে তিনি বলেন, “এর আগেও হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। সেই সব হয়রানিমূলক মামলাগুলো কী করে বন্ধ করা যায়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
“কিছু কিছু আইন আছে যেটার ভুক্তভোগী আপনারাও যেমন- আইসিটি, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট। আইসিটি ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল হলেও সেগুলোর অধীনে অনেকের শাস্তি হয়েছে, অনেকে জেলে আছে, অনেকের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। হয়রানিমূলক মামলার মধ্যে সেগুলোকেও আনা হবে।”
কীভাবে পরিবর্তন আনা হলে এই আইনগুলো আর স্বাধীন মত প্রকাশে বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারবে না বা বিরোধী দমনে ব্যবহৃত হতে পারবে না, সে বিষয়েও আলোচনা করা হবে বলে জানান তিনি।
সব মন্ত্রণালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা হবে জানিয়ে তিনি রিজওয়ানা হাসান বলেন, “কীভাবে তারা সম্পৃক্ত থাকবেন, এটার কাঠামো কী হবে, এটা আমরা পরবর্তীতে চিন্তা করব।”
দ্রুত সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে বলে জানান রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেন, “এখনো রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ নেই, শিক্ষার্থীরা রাস্তা ম্যানেজমেন্ট করছেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি না যে কালই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেব। শিক্ষক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করা হবে, শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে এনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।”
বিচার বিভাগের কার্যমের বিষয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, “আইন উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে যত দ্রুত সম্ভব বিচার কাজ শুরু করা যায়, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।”
তিনি বলেন, “সকল সেক্টরের রিফর্ম নিয়ে আমরা কথা বলি। এভাবে চলে না, চলতে পারে না, সিস্টেমটা আমাদের বদলাতে হবে। সেই রিফর্মগুলো একা তো আর করা যাবে না। সমাজের সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে, গণমাধ্যমাধ্যমের সঙ্গেও কথা বলা হবে, পেশাজীবীদের সঙ্গে কথা বলা হবে। সবার সঙ্গে কথা বলে রিফর্ম এজেন্ডা ঠিক করে আমরা আলাপ-আলোচনায় যাব।”
আর্থিক খাতগুলো চালু ও সক্রিয় করতে নেতৃত্বের স্থানে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, অবিলম্বে সেসব পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হবে।
“ব্যবসাকে উজ্জীবিত করার জন্য যত ধরনের সুরক্ষা নেওয়া যায়, সেটাকে আমাদের চিহ্নিত করে সেই সুরক্ষাগুলো আমাদের নিতে হবে। যে ব্যবসায়ীরা হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন, তাদের যাতে আবার উজ্জীবিত করা যায়।
“জনগণের জীবন-জীবিকার কষ্ট লাঘব হবে, বাজারের ক্ষেত্রে যে নিয়ন্ত্রণ, অর্থের ক্ষেত্রে যে নিয়ন্ত্রণ, সেটাও অগ্রাধিকার পাবে অর্থ মন্ত্রণালয় যখন পরিকল্পনা করবে সেখানে। বিস্তারিত কর্ম পরিকল্পনার জন্য তো একটু সময় লাগবে। আজই তা হয়ে যাবে না।”
দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “সিস্টেম পরিবর্তনের জন্যই তো ওরা লড়াইটা করেছে। কাজেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আজকে বেশিরভাগ আলোচনাই ছিল আইনশৃঙ্খলা ও অর্থসংক্রান্ত।”
কোটা সংস্থার আন্দোলনে হত্যার বিচারের বিষয়ে তিনি বলেন, “কীভাবে বিচার নিশ্চিত করলে সেটা স্বচ্ছ হবে এবং এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কখনো বংলাদেশে হবে না, সেটার জন্য কোন পথে আমরা যাব, সে ব্যাপারে আমরা চিন্তা করে জানাবো। প্রতিটা গুলির আমরা বিচার করব।”
যত শিক্ষার্থী এই আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের সবার পরিবারের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রীয় অথিতি ভবন যমুনায় বসবেন বলে জানান উপদেষ্টা রিজওয়ানা।
তিনি বলেন, “যারা আহত হয়েছেন, তাদের চিকিৎসার সুব্যবস্থা করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যাদের বিষয়ে আমরা জানি না, তারা তাদের তথ্য দিলে আমরা তাদেরকেও সাহায্য করা হবে।”
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “ছাত্রদের নেতৃত্বেই এই অভ্যুত্থানটি সংঘটিত হয়েছে। ছাত্রদের ওপর আস্থা রেখেই রাস্তায় নেমে এসেছে। ছাত্ররা যখন সরকারে এসেছে এবং রাষ্ট্রের সংস্কারের জন্য কথা বলছে, আমরা মনে করি জনগণকে এই তরুণ ছাত্রদের ওপর আস্থা রাখবেন।
“আমরা এই উপদেষ্টা প্যানেলে দক্ষ এবং যোগ্যদের মনোনীত করেছি। আমরা মনে করেছি, এই পুরো প্যানেলটি তদারকির জন্য ছাত্রদের ভয়েস থাকা দরকার। ছাত্রদের জায়গা থেকেও উপদেষ্টা প্রয়োজন। সেই জায়গা থেকে আমরা দুইজন ছাত্র প্রতিনিধি এই উপদেষ্টা প্যানেলে রয়েছি।”
অন্তর্বর্তী সরকারে যারা উপদেষ্টা আছেন, তাদের সহকারী হিসেবে ছাত্রদের কাজ করার সুযোগ থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে একটি গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছি। এখন আমাদের সময় দেশকে নতুন করে গঠন করা। সেখানে আমাদের ঐক্যবদ্ধ করা। বাংলাদেশের সিস্টেম ভেঙে পড়েছে। এটাকে গড়ে তোলা সম্ভব প্রশাসকের সাথে নাগরিকরা যদি একসাথে কাজ করতে পারে। তাহলে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা সম্ভব।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কতদিন?
অন্তবর্তী সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে বৈঠকে সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “মেয়াদের বিষয়ে এখন আলোচনা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না। আপনি কী রিফর্ম চান, সেটা না বুঝে তো আমি মেয়াদের কথা বলতে পারব না। “রিফর্ম যদি আপনারা না চান, তাহলে আরেক কথা। কাজেই এখন মেয়াদ মেয়াদ করে অস্থির হওয়ার কিছু নেই।”
রিজওয়ানা বলেন, “আমরা সবাই যাতে দেশে একটা গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু করতে পারি, সেটার প্রস্তুতির জন্যই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য যেটুকু সময় দরকার শুধু সেটুকু সময়ই আমরা নেব। শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের দিকেই আমাদের যাত্রা করতে হবে।”