Published : 05 Jul 2025, 08:42 PM
শহীদ মিনারের বেদীতে বিছানো কার্পেটে বসে মেয়েকে বই পড়ে শোনাচ্ছিলেন মোহাম্মদ রাসেল খান, সেখানে নগরের বইপ্রেমী কিছু মানুষ জড়ো হয়েছিলেন বই বিনিময় উৎসবে।
শনিবার বিকালে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম ‘মেঘের ধাক্কা’ আয়োজিত এ উৎসবে যোগ দেওয়া রাসেলের ১৫ মাস বয়সী মেয়ের হাতে ছিল একটি বই। কথা বলে জানা যায়, তার নাম মায়ামী।
রাসেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফেইসবুকে পোস্ট দেখেই মোহম্মদপুর থেকে তিনি মেয়েকে নিয়ে বই বিনিময় উৎসবে অংশ নিতে এসেছেন।
তিনি বলছিলেন, “ছাত্রজীবন থেকেই পাঠাগার চর্চার সঙ্গে আমি যুক্ত, বই ভালো লাগে।
“আমার মেয়েটা ছোট, এজন্য হয়তো ওর স্মৃতিতে থাকবে না। তবুও ভালো কিছুর সঙ্গে মেয়েটা বড় হোক, এটাই চাওয়া।”
আয়োজকেরা জানিয়েছেন, বইপ্রেমী পলান সরকারের স্মরণে ‘বই বিনিময় উৎসব’ এর এটি চতুর্থ আয়োজন। ২০২২ সালে শহীদ মিনারে প্রথম এই উৎসব হয়। তখন পলান সরকারের ছেলে হায়দার আলী উপস্থিত ছিলেন। ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বরও উৎসব হয়েছে।
তবে, ২০২৪ সালে আয়োজনটি সম্ভব হয়নি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তৃতীয়বারের মত আয়োজনটি করা হয় বান্দরবানে।
উৎসব প্রাঙ্গণে দেখা যায়, একে অপরকে বই দিচ্ছেন অনেকে। কেউ আবার সেই মুহূর্তটির ছবি তুলে রাখছিলেন। মঞ্চে মাইক্রোফোনে নিজের অনুভূতিও প্রকাশ করেন কেউ কেউ।
আয়োজনটিতে ছিল না কোনো প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি কিংবা উদ্বোধক।
আয়োজকেরা জানান, এখানে আসা প্রত্যেকেই আয়োজনটিকে নিজের করে যেন ভাবতে পারেন, প্রাণ খুলে গল্প-আড্ডায় মেতে থাকতে পারেন। সেজন্যই এমন ভাবনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক মলয় বালা এসেছিলেন উৎসবে, দর্শক সারিতে তাকেও দেখা যায় বই বিনিময় করতে।
মলয় বালা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তো নানা রকম উৎসব হতে দেখি। বই বিনিময় একটা ব্যক্তিক্রমী ভাবনা। আমরা যে কারণে বই পাঠ করি, এই উৎসব সেই আদর্শকেই আরো বড় পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়ার বার্তা দেয়।”
বই বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই উৎসব মানুষের মাঝে সৌহার্দ্যের বার্তা ছড়াবে বলেও মনে করেন মলয় বালা।
তিনি বলেন, “এ ধরণের উৎসব সব জায়গায় ছড়িয়ে যাক। একদিন জাতীয় উৎসবে পরিণত হোক, এই প্রত্যাশা করি।”
রাজশাহীর পলান সরকার বই নিয়ে ছুটে যেতেন মানুষের কাছে। তিনি বিনামূল্যে মানুষকে বই দিতেন। সেই বই পড়া শেষ হলে আবার গিয়ে নতুন বই দিয়ে আসতেন। এভাবে জীবনের ৯০ বছর অবধি তিনি পায়ে হেঁটে, নিজের টাকায় বই কিনে মানুষকে বই পড়তে অনুপ্রাণিত করে গেছেন।
১৯২১ সালের ১ আগস্ট নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার নূরপুর মালঞ্চী গ্রামে জন্ম নেওয়া পলান সরকার চতুর্থ শ্রেনি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। শৈশবে বাবা হারানোর পর আর পড়াশোনা হয়নি। ২০১৯ সালের ১ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সেই পলান সরকার স্মরণে এই উৎসব করার মধ্য দিয়ে মানুষের মাঝে মিলন ঘটানোর ভাবনার কথা তুলে ধরেন আয়োজক ‘মেঘের ধাক্কা’র পরিচালক জহির রায়হান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে আমাদের পুরো বাড়িতে একটা টিবওয়েল ছিল, সেখানে পানি নিতে আসতো বাড়ির সবাই। এখন প্রত্যেকের বাড়িতে আলাদা আলাদা টিবওয়েল। এখন আর পানি আনতে গিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা হয় না। ঝগড়া হয় না, ভালোবাসা বিনিময়ও হয় না।
“আমাদের বাড়িগুলো সুরক্ষিত প্রাচীরে আলাদা হয়ে গেছে। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি। পাশের বাসার লোকটির সঙ্গেও আমাদের পরিচয় থাকে না। মানুষের মাঝে মিলন ঘটানোর জন্যই বই বিনিময় উৎস। আমাদের উদ্দেশ্য, একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া। একে অপরকে জানতে পারা। এমন ভাবনা থেকেই উৎসবটির আয়োজন।”