Published : 20 Oct 2024, 10:10 PM
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৩ বছরের এক কিশোরী গৃহকর্মী। ভয়ঙ্কর নির্যাতনে তার সামনের পাটির চারটি দাঁত উপড়ে ফেলা হয়েছে, বীভৎসভাবে সারা শরীরে ‘হেয়ার স্ট্রেইনার’ যন্ত্র দিয়ে দেওয়া হয়েছে ছ্যাঁকা।
শনিবার রাতে কল্পনা নামের ওই কিশোরীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে ভাটারা থানার পুলিশ।
আর গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগে গৃহকর্ত্রী দিনাত জাহান আদরকে (২১) গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়েছে একদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, শনিবার রাতে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকের কাছ থেকে খবর পেয়ে তারা বসুন্ধরার আই ব্লকের ৩ নম্বর সড়কের ৪৬৬ নম্বর বাসা থেকে ওই কিশোরীকে উদ্ধার করে। রাত সোয়া ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে তাকে ভর্তি করা হয়।
ভাটারা থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, “তার সারা শরীরে পোড়া ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। রাতেই গৃহকর্মীর মা আফিয়া বেগম বাদী হয়ে নারী শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেছেন। মামলায় গৃহকর্ত্রী দিনাত জাহান আদরকে (২১) গ্রেপ্তার করে রোববার আদালতে পাঠানো হয়।”
বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক মো. নাসির উদ্দিন বলছেন, “গৃহকর্মীর গোটা শরীরে যে পরিমাণ পোড়া ক্ষত হয়েছে তা একদিনের আঘাত নয়, দীর্ঘদিন ধরে তাকে এ সমস্ত জায়গায় নির্যাতন করা হয়েছে। বিনা চিকিৎসায় অনেকগুলো ক্ষতস্থান শুকিয়ে গেছে। আবার অনেক স্থানে গভীর ক্ষত রয়েছে। তার সামনের দিকে চারটি দাঁত নেই। অনেক স্থানে ইনফেকশন হয়ে গেছে।”
“বর্তমানে তার যে অবস্থা, তার সেরে উঠতে প্রায় দুইমাস সময় লাগতে পারে। নির্যাতনের কারণে সে কিছুটা মানসিক ট্রমায় রয়েছে,” বলেন এই চিকিৎসক।
নির্যাতনের শিকার কিশোরীর বাড়ি হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলা সুজন গ্রামের শহিদ মিয়া ও আফিয়া বেগমের মেয়ে। পাঁচ বোন এক ভাইয়ের মধ্যে সে পঞ্চম।
হাসপাতালে শিশুটির মা আফিয়া বেগম বলেন, গত পাঁচ বছর ধরে মাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতনে ওই বাসায় কাজ করছিল তার মেয়ে। পরে ১০ হাজার বেতন দেয়ার কথা ছিল। শেষ তিন মাসের বেতন পাননি তারা।
মেয়ে কি কখনো নির্যাতনের কথা জানায়নি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে ফোনে মেয়ের সাথে কথা হতো গৃহকত্রীর মোবাইলে ফোনে।
“এখন জানতে পারলাম কথা বলার সময়ে গৃহকর্ত্রী সামনে থাকত, তাই ভয়ে নির্যাতনের কথা বলতে পারত না কল্পনা।”
নির্যাতিত কল্পনা জানিয়েছে, সাত তলা ভবনের দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে থাকত সে। গৃহকর্ত্রী দিনাত জাহান ওই বাসায় একাই থাকতেন। বাসায় তার বন্ধু ও স্বজনেরা যাতায়াত করতেন।
তার ভাষ্য, বিভিন্ন কাজ না পারা বা ভুল করার অজুহাতে তাকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হতো। দেয়া হতো হেয়ার স্ট্রেইনার মেশিন দিয়ে ছ্যাঁকা, পেটানো হতো লাঠি দিয়ে।
সে আরও জানিয়েছে, ওই বাসার কর্ত্রী বাসার রান্না খেতেন না, বাইরে থেকেই খেয়ে আসতেন, আবার খাবার বাসায় নিয়েও আসতেন। মাঝে মধ্যে তার ভাই খাবার নিয়ে আসতেন। আহত কল্পনা নিজের খাবার নিজেই রান্না করে খেতো।
পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেপ্তার দিনাত জাহান আদর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ পড়াশোনা করতেন, তবে বর্তমানে পড়াশোনা বন্ধ রয়েছে। তার বাবা মা ধানমন্ডিতে আলাদা বাসায় থাকেন।
হাসপাতালে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ রোববার ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে যান। তিনি মেয়েটি চিকিৎসার দায়িত্বও নিয়েছেন।
হাসপাতালে কামাল উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকেদের বলেন, “দারিদ্র্যের জন্য অন্যের বাসায় কাজ করে এই শিশুরা। তাই বলে নির্মমতার শিকার হবে, এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। এই মেয়েটিকে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। মেরে তার চারটি দাঁত ফেলে দেওয়া হয়েছে। তার শরীরে সকল ধরনের আঘাত রয়েছে।”
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, “একটা সুস্থ মানুষ এ ধরনের নির্যাতন করতে পারে না। এই মেয়েটা পাঁচ বছর ধরে একটা পরিবারে কাজ করে। সাড়ে চার বছর ধরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, কেউ জানেও না। এ রকম আরও কত হচ্ছে অনেকেই তা জানি না।”
এই ঘটনায় অভিযুক্ত দিনাত জাহানের বাবা-মাও দায় এড়াতে পারেন না উল্লেখ করেন কামাল উদ্দিন।
তিনি বলেন, “এই মেয়েটিকে বসুন্ধরার যে বাসায় নির্যাতন করা হয়েছে, সেখানে দিনাত জাহান নামের মেয়েটা একাই থাকত। তবে তার (দিনাত জাহানের) মা-বাবার সঙ্গে কথা বলেই কাজে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, তার বাবা-মাও এই দায় থেকে রেহাই পাওয়ার কথা নয়।
“দিনাত জাহান অ্যাডাল্ট, তবুও তার বাবা-মা এ দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তাদের বিরুদ্ধেও যাতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এমন একটা উদাহরণ সৃষ্টি করা যায়, যেন এই সমাজে বিভিন্ন জায়গায় নিষ্ঠুর কারখানা হচ্ছে, এটা যাতে না হয়, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সবাই মিলে চেষ্টা করে এই গৃহকর্মী নির্যাতন দমন আইনকে বাস্তবায়ন করতে হবে।”