Published : 05 Jun 2017, 08:48 PM
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, “মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নয়। এটা কার্যকর করলেই যে সমাজ থেকে অপরাধ দূর হয়ে যবে তা বলা যায় না। লঘুদণ্ডও অনেক সময় সমাজ থেকে অপরাধ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বা সাহায্য করে।”
মাদকাসক্ত মেয়ের হাতে রহমান দম্পতির নিহত হওয়ার ওই ঘটনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আদালত অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়েছে।
হাই কোর্ট বলেছে, “সন্তানদের জন্য বাবা-মা ও অভিভাবকই হলেন প্রাথমিক শিক্ষক। সে হিসেবে অভিভাবকদের উচিৎ সন্তানদের জন্য ভাল পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সন্তানদের উপযুক্ত সময় দেওয়া।”
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান তাদের দুই সন্তান এবং শিশু গৃহকর্মীকে নিয়ে মালিবাগের চামেলীবাগের এক ফ্ল্যাটে থাকতেন। ২০১৩ সালের ১৬ অগাস্ট ওই বাসা থেকেই তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
রহমান দম্পতির কিশোরী মেয়ে ঐশী তখন অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ‘ও’ লেভেলের ছাত্রী। একদিন লাপাত্তা থাকার পর তিনি নিজেই রমনা থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন।
পরে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ঘটনার রাতে কোনো এক সময় কফির সঙ্গে ঘুমের বড়ি খাইয়ে বাবা-মাকে কুপিয়ে হত্যা করেন ঐশী। পরদিন সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নেন।
ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩-এর বিচারক সাঈদ আহমেদ ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর এ মামলার রায়ে ঐশীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আর বাবা-মাকে খুনের পর যে বন্ধুর বাসায় ঐশী আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই মিজানুর রহমান রনিকে দেওয়া হয় দুই বছরের কারাদণ্ড।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে ঐশীর আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের হাই কোর্ট বেঞ্চ সোমবার রায় ঘোষণা করে।
রায়ে রনির দুই বছরের সাজার রায় হাই কোর্টও বহাল রেখেছে। আর ঐশীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে, ঐশীর অপরাধ ফৌজদারি আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ, মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য হলেও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে তাকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে করছে হাই কোর্ট। এর পাঁচটি কারণও রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
এক. মাদকাসক্ত ঐশী ‘মানসিক বিচ্যুতির’ কারণে জোড়া খুনের ওই ঘটনা ঘটিয়েছে। বাবা-মাকে হত্যার পেছনে তার সুস্পষ্ট কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।
দুই. আসামি ঐশী অ্যাজমাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাদের পরিবারে মানসিক সমস্যার ইতিহাস রয়েছে। ঐশীর দাদি ও মামা আগে থেকেই মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। পরীক্ষা করে ঐশীর মধ্যেও সেই সমস্যা পাওয়া গেছে।
তিন. ঘটনার সময়টি ছিল ঐশীর সাবালকত্ব পাওয়ার মুহূর্ত। তখন তার বয়স ছিল ১৯ বছর।
চার. ওই হত্যাকাণ্ডের আগে ঐশী ফৌজদারি অপরাধ করেছেন, এমন কোনো নজির নেই।
পাঁচ. বাবা-মাকে হত্যার পর ঐশী পালিয়ে না গিয়ে স্বেচ্ছায় থানায় আত্মসমর্পণ করেন।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে, বাস্তবতা ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিচার করে হাই কোর্ট ঐশীর সাজা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানানো হয় রায়ে।
পারিবারিক অ্যালবামে রহমান পরিবার
কিশোরী মেয়ের হাতে এসবি কর্মকর্তা মাহফুজ ও তার স্ত্রীর হত্যার ওই ঘটনা চার বছর আগে নাড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। বর্তমান সময়ের শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠা এবং তাতে অভিভাবকদের ভূমিকা নিয়েও সে সময় প্রশ্ন ওঠে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাই কোর্ট বলেছে, “ঐশীর বাবা পুলিশ বিভাগে এবং মা ডেসটিনিতে চাকরি করতেন। জীবন-জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তারা ঐশীকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেননি। কিন্তু তারা যখন বিষয়টি উপলব্ধি করলেন, ততদিনে তাদের মেয়ে আসক্তিতে উচ্ছন্নে গেছে।”
ঐশীর সাজা কমানোর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাণদণ্ডের সাজা নিয়েও পর্যবেক্ষণ এসেছে হাই কোর্টের এই বেঞ্চ থেকে।
আদালত বলেছে, বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ডকে নিরুৎসাহিত করা হলেও বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড কমানোর কোনো ‘গাইডলাইন’ নেই।
“এমনকি তা বিলুপ্ত করার পরিবেশ এখনও আসেনি। শিক্ষার হার যেমন বেড়েছে, তেমনি জনসংখ্যাও বেড়েছে। এ কারণে অপরাধের প্রবণতাও বাড়ছে। এ অবস্থায় মৃত্যুদণ্ড রহিত করা যুক্তিসঙ্গত নয়।”
তবে মৃত্যুদণ্ড দিলেই যে সমাজ থেকে অপরাধ দূর হয়ে যাবে না- সে কথাও আদালত বলেছে।
“মৃত্যুদণ্ড রহিত করতে সমাজের প্রতিটি স্তরে সুশাসন ও মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু রাষ্ট্রের মধ্যে নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।”
রহমান দম্পতিকে হত্যার দায়ে তাদের কিশোরী মেয়ের ফাঁসির আদেশ দিয়ে দ্রুত বিচার আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছিল, “ঐশী পরিকল্পিতভাবে, সময় নিয়ে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। সে খুনের সময় সুস্থ স্বাভাবিক ছিল। আসামিপক্ষ তাকে অপ্রাপ্তবয়স্ক বললেও তা প্রমাণ করতে পারেনি। সে মাদকাসক্ত হলেও বাবা-মাকে সে হত্যা করেছিল সুস্থ মস্তিষ্কে।”
এ বিষয়ে হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, “নিম্ন আদালত সামাজিক অবক্ষয় বিবেচনায় নিয়ে কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে ওই রায় দিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, একটা মেয়ে তার পিতা-মাতাকে নিজের হাতে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার সাহস দেখিয়েছে। কিন্তু সাজা নির্ধারণ ও বিচারের ক্ষেত্রে এ ধরনের আবেগ প্রদর্শনের সুযোগ নেই। আদালত আইনগত তথ্য ও প্রমাণ বিবেচনায় নেবে, যেখানে একজন নারী ১৯ বছর বয়সে এ ধরনের অপরাধ করেছে।”