Published : 29 Jun 2025, 12:31 PM
অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা বিধি অনুমোদন ও গ্রহণ করে ২০১৮ সালের আপিল বিভাগের রায় স্থগিত করেছে আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে যে আদেশ দিয়েছিল আপিল বিভাগ, সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি দিয়েছে সর্ব্বোচ আদালত।
রোববার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারকের আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
বেঞ্চের অপর পাঁচ বিচারপতি হলেন- মো. আশফাকুল ইসলাম, জুবায়ের রহমান চৌধুরী, মো. রেজাউল হক, এস এম এমদাদুল হক ও ফারাহ মাহবুব।
এ আদেশের ফলে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে হাই কোর্টে যে রিট মামলার শুনানি চলছে, তা নিষ্পত্তি করতে আর কোনো বাধা থাকলো না বলে জানিয়েছেন রিট আবেদনকারী আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশ করে সরকার। ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি তা গ্রহণ করে আপিল বিভাগ।
এই বিধির মাধ্যমে অধস্তন আদালতের বিচারকদের আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বলে। এর ফলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, ছুটি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে যায়।
আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
মোহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি তৈরি করার জন্য একটি প্রস্তাব সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয়। ২০১৬ সালের ২৮ অগাস্ট সংশোধনীসহ এই শৃঙ্খলঅবিধি আবার সরকারের কাছে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, যদি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে এই শৃঙ্খলাবিধিতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে।
“কিন্তু তৎকালীন সরকার এই শৃঙ্খলাবিধি কোনো পরিবর্তন না করে ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর গেজেট আকারে প্রকাশ করে। সুপ্রিম কোর্টে এই শৃঙ্খলাবিধিটি একটি আদেশের মাধ্যমে ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি গ্রহণ করে।”
“এর মধ্যে আমাদের আগের প্রধান বিচারপতি দেশের বাইরে যেতে বাধ্য হন। দেশের বাইরে থেকে তিনি পদত্যাগপত্র পাঠান। পরে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ এই শৃঙ্খলাবিধিটি গ্রহণ করে ২০১৮ সালের তেসরা জানুয়ারি।”
শিশির মনির বলেন, “এই আদেশের বিরুদ্ধে আমরা একটি রিভিউ আবেদন করেছিলাম। এতে আমরা বলেছিলাম, আগের ৯ সদস্যের আপিল বিভাগ যে আদেশ দিয়েছিল, সে আদেশ রিভিউ না করে ৫ সদস্যের আপিল বিভাগ এ আদেশ দিতে পারেন না। এটি সুপ্রিম কোর্টের অতীত আদেশের অবমাননার শামিল। ওই রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে আজ আদেশ হয়েছে।
“আদেশে ২০১৮ সালের তেসরা জানুয়ারি ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. ওয়াহাব মিয়ার নেতৃত্বে যে আদেশ দিয়েছিলেন, তা স্থগিত করে দিয়েছেন। একইসঙ্গে নিম্ন আদালতের যে শৃঙ্খলাবিধি আছে ‘ইন দ্য মিন টাইম’ তা কার্যকর থাকবে।
“একইভাবে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে হাই কোর্টে আমাদের যে শুনানি হচ্ছে তা চলতে আর কোনো বাধা থাকবে না। এই আদেশের মাধ্যমে আগের শৃঙ্খলাবিধি স্থগিত করা হয়েছে এবং আমাদের লিভ গ্রান্ট করা হয়েছে।”
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চলতি বছর বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব। এতে বিবাদী করা হয় মাসদার হোসেন ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের।
১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ মাসদার হোসেন মামলায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয়। এই রায়ের আলোকে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়।
ওই রায়ের আলোকে অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল।
১২ দফা নির্দেশনার মধ্যে ছিল-
>> সংবিধানের ১৫২ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সব বিভাগের কাজ সার্ভিস অব রিপাবলিকের ভেতরে পড়বে। তবে বিচার বিভাগের কাজ ও অবকাঠামোর সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভিসের অনেক ভিন্নতা রয়েছে। বিচার বিভাগকে অন্যান্য সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে একত্রিত করা যাবে না।
>> বিচারিক হাকিমদের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা এবং নির্বাহী বিভাগের হাকিমরা বিচারিক কাজ করতে পারবেন না।
>> সিভিল সার্ভিস অর্ডার ১৯৮০ অনুযায়ী, সব হাকিমকে পিএসসির অধীনে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া হয়। একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া সংবিধান পরিপন্থি।
>> এই রায় পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা এবং কমিশন গঠন করতে হবে।
>> সংবিধানের ১১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়ারির সবার চাকরির বিধিমালা (নিয়োগ, পদায়ন, বদলি পদোন্নতি ও ছুটিসহ অন্যান্য) প্রণয়ন করবেন।
>> রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন করবেন।
>> সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের থাকবে।
>> বিচার বিভাগ জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকবে না এবং বিচারিক হাকিমসহ সব বিচারক স্বাধীনভাবে কাজ করবেন।
>> জুডিশিয়ারির (অধস্তন আদালত) বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের ওপর নির্বাহী বিভাগের কোনো হাত থাকবে না। এই বাজেট সুপ্রিম কোর্ট প্রণয়ন এবং বরাদ্দ করবে।
>> জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা প্রশাসনিক আদালতের আওতাভুক্ত থাকবেন।
>> এই রায় অনুযায়ী বিচার বিভাগ পৃথককরণের জন্য সংবিধানে কোনো সংশোধন করার প্রয়োজন নেই। তবে পৃথককরণ আরও অর্থবহ করতে যদি সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তবে তা করা যাবে।
>> জুডিশিয়াল পে-কমিশন: জুডিশিয়াল পে-কমিশন জুডিশিয়ারির সদস্যদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ না করবে, ততদিন পর্যন্ত বর্তমান অবকাঠামো অনুযায়ী তার সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।
জুডিশিয়াল সার্ভিসকে সিভিল সার্ভিসে অন্তর্ভুক্তি চ্যালেঞ্জ করে বিচার বিভাগ আলাদা করার নির্দেশনা চেয়ে ১৯৯৫ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করে জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।
সমিতির তখনকার নেতা হিসেবে বিচারক মাসদার হোসেন এই আবেদনে বাদী ছিলেন বলে তার নামেই মামলাটি পরিচিতি পায়।
আরও পড়ুন: