Published : 06 Feb 2023, 11:07 PM
একুশে বইমেলার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি স্টলে চোখ আটকাল; খুব মন দিয়ে বই পড়ছেন দুজন। তবে চোখে দেখতে পান না তারা, কিভাবে পড়ছেন তাহলে?
কাছে গিয়ে দেখা গেল তারা আসলে বইয়ের অক্ষর স্পর্শ করে পড়ছেন, যেটি ব্রেইল পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। যে স্টলে তারা ছিলেন সেটি দৃষ্টিহীনদের জন্য বিশেষভাবে ছাপানো বই প্রকাশ করে থাকে। সেখানে তাদের নতুন বই পড়ার সুযোগও রয়েছে।
এক যুগ ধরে বইমেলাতে বিশেষ এ গোষ্ঠীর জন্য বই পড়ার এ সুযোগ করে দিয়েছে স্পর্শ ফাউন্ডেশন।
কথা বলে জানা গেল, নানা কারণে যারা চোখে দেখতে পান না তাদের বই পড়ার পরিসরকে আরও বিস্তৃত ও সহজ করার পরিকল্পনা নিয়ে ২০০৮ সালে যাত্রা শুরু করেছিল ফাউন্ডেশনটি। ২০০৯ সালে তারা প্রথম একটি ছড়ার বই ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রকাশ করে। আর ২০১১ সাল থেকে নিয়মিতভাবে বইমেলায় অংশ নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ১২ বছরে ১০১টি বই ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রকাশ করে বইমেলায় এনেছে তারা।
এবারের মেলাতেও ৩০টি বই আনার পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানটির, যার মধ্যে কয়েকটি বই ইতোমধ্যে প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানান এটির উদ্যোক্তা নাজিয়া জাবীন।
এবার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই একাত্তরের চিঠি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যেপাধ্যায়ের উপন্যাস চাঁদের পাহাড়, মুহম্মদ জাফর ইকবালের সাইন্স ফিকশন ‘যারা বায়োবট’।
নাজিয়া জাবীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এবারের মেলায় সিসিমপুর থেকে আমাদেরকে ১০টি বই দিয়েছে। এছাড়া আমরাও বই নিয়ে আসছি। ২১ ফেব্রুয়ারির পর ৩০টি বই নিয়ে একটি প্রকাশনা উৎসব করব। তারিখ এখনও চূড়ান্ত হয়নি।”
দৃষ্টিহীন নয় তারা চান ‘দৃষ্টিজয়ী’ শব্দ ব্যবহার করতে জানিয়ে নাজিয়া বলেন, "আমরা বলি দৃষ্টিজয়ী। তারা চোখে দেখে না। কিন্তু অনেকের চেয়েও বেশি প্রজ্ঞাবান। যারা প্রজ্ঞাহীন, তারা দৃষ্টিহীন। যারা চোখে না দেখলেও ব্রেইল পদ্ধতিতে বই পড়তে পারে।
“কোনো কোনো ক্ষেত্রে চোখের দৃষ্টি সম্পন্ন অনেকের চেয়েও ভালো কাজ করে। তারা দৃষ্টিহীন নয়। যারা চোখ থাকার পরও খারাপ কাজ করে, তারা দৃষ্টিহীন। বরং এই অন্ধরা ভালো কাজের মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠে দৃষ্টিজয়ী।"
বইমেলায় ব্রেইল পদ্ধতিতে বই প্রকাশের ভাবনাটি কীভাবে এসেছে, এ প্রশ্নের উত্তরে নিজের একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “সেদিন হঠাৎ মনে হল- ব্রেইল পদ্ধতিতে বই বের হলে তো তারাও আমাদের পাঠক হতে পারে। এরপর থেকে স্পর্শ ফাউন্ডেশন করেছি। প্রতিবছর বই প্রকাশ করছি।
"তাদের জন্য বই না থাকার কারণে এতদিন তারা মেলা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। আমরা প্রতিবছর তাদের জন্য বই প্রকাশ করে তাদেরকেও মেলায় যুক্ত করতে পেরেছি। প্রতিটি প্রকাশনার উচিত ব্রেইল বই প্রকাশ করা।"
জাতীয় গণগ্রন্থাগার, শিশু একাডেমি পাঠাগারসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্রেইল কর্নার করা হয়েছে জানিয়ে নাজিয়া বলেন, "আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন পাঠাগারে ব্রেইল কর্নার করা হয়েছে। সেখানে ব্রেইল পদ্ধতিতে বই পড়ে আমাদের অনেক পাঠক। ফলে সারা দেশে এখন আমাদের অগণিত পাঠক রয়েছে।"
নিজেও নিয়মিত লেখালেখি করেন জানিয়ে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত তার ৪০টির মত বই প্রকাশ হয়েছে।
মেলার একমাত্র এই ব্রেইল স্টলে কথা হল স্বেচ্ছাসেবী তরিকুল ইসলাম নাজিমের সঙ্গে, যিনি চোখে দেখতে পারেন না। তিনি বললেন, “মেলায় এই স্টলে বসে অনেকেই বই পড়ছে। মেলার পর আমরা অনেককে বইগুলো উপহার হিসেবে দেব। সারা দেশেই এখন আমাদের পাঠক আছে।"
মেলার ষষ্ঠ দিন
সোমবার বইমেলার ষষ্ঠ দিনে নতুন বই এসেছে ১২১টি।
গ্রন্থ উন্মোচন মঞ্চে মেহেদী হাসান উজ্জল রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তুমি নামের অসুখ' গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া কবি মারুফুল ইসলাম। সানিউর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার, কবি শরাফত হোসেন, মনিরুল ইসলাম মনি, রিয়াজুল মোর্শেদ মোয়াজ।
বিকাল ৪টায় মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণ: কাজী রোজী এবং স্মরণ: দিলারা হাশেম শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নাসির আহমেদ ও তপন রায়। আলোচনায় অংশ নেন আসলাম সানী, শাহেদ কায়েস, আনিসুর রহমান ও শাহনাজ মুন্নী।
প্রবন্ধে বলা হয়, "কবি, গীতিকার, নাট্যকার, গল্পকার কাজী রোজী আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের এক প্রগতিশীল সাহসী নারী, সদা প্রাণোচ্ছল এক লড়াকু জীবনযোদ্ধা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সকল প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে সম্মুখসারির কর্মী ছিলেন তিনি।
“অপরদিকে বাংলাদেশের খ্যাতিমান ঔপন্যাসিকদের মধ্যে দিলারা হাশেম একটি বিশিষ্ট নাম। ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, কবি, অনুবাদক, সংবাদ পরিবেশক, সংগীতশিল্পী ইত্যাদি নানা অভিধায় তাকে অভিহিত করা যায়। তিনি মূলত নগরজীবন ও বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের সুখ-দুখ, স্বপ্ন-সাধ, ভালোবাসা, হতাশ ও জীবনের বাস্তবতা তার সাহিত্যে তুলে এনেছেন।”
সভাপতির বক্তব্যে অসীম সাহা বলেন, “জীবনের নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে কাজী রোজী যে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়েছেন, তাতে তিনি সফল হয়েছেন। জীবনের অন্তর্গত রহস্য ও নিম্নশ্রেণির মানুষের সংগ্রাম দিলারা হাশেমের সাহিত্যকর্মে ওঠে এসেছে। আমাদের উচিত যথাসময়ে তাদের মতো গুণী মানুষের কাজের স্বীকৃতি ও সম্মান প্রদর্শন।"
সোমবার 'লেখক বলছি' অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন মোজাম্মেল হক নিয়োগী, রহীম শাহ, সত্যজিৎ রায় মজুমদার ও তুষার কবির।
সন্ধ্যায় মূল মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি মাহবুব সাদিক, ফারুক মাহমুদ ও আতাহার খান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, মাহিদুল ইসলাম ও অনন্যা লাবনী।
এছাড়া ছিল সাইমন জাকারিয়ার পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ভাবনগর ফাউন্ডেশন’র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী আজগর আলীম, আবুবকর সিদ্দিক, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, রহিমা খাতুন, শান্তা সরকার। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন আব্দুল আজিজ (তবলা), ডালিম কুমার বড়–য়া (কী-বোর্ড), অরূপ কুমাল শীল (দোতারা) ও মো. শহিদুল ইসলাম (বাঁশি)।
মঙ্গলবার যা থাকছে
মঙ্গলবার সপ্তম দিনে বিকাল ৪টায় মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে স্মরণ: মাহবুব তালুকদার এবং স্মরণ: আলী ইমাম শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন গাজী রহমান ও আহমাদ মাযহার। আলোচনায় অংশ নেবেন লুৎফর রহমান রিটন, নিমাই মন্ডল, আমীরুল ইসলাম ও ওমর কায়সার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন ফরিদুর রেজা সাগর।