Published : 10 Feb 2024, 10:42 PM
একুশে বইমেলায় শনিবারের বিকালটা ছিল অন্যরকম; ক্যান্সারজয়ীরা এসে জীবনের শত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও থেমে না যাওয়ার বার্তা ছড়িয়ে গেলেন।
মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) স্টলের সামনের চত্বরে দেখা গেল তাদের। চেয়ার নিয়ে বসে আড্ডা-গল্পে সময় কাটাচ্ছিলেন।
এ সময় তাদের হাতে হাতে ছিল একটি বই, নাম 'এখানে থেমো না'। ৪২ জন ক্যান্সার লড়াকুর বয়ান নিয়ে এ বই প্রকাশ করেছে ‘সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশন’। মেলায় বইটির পরিবেশক ইউপিএল। বইটির লেখকদের নিয়েই অনানুষ্ঠানিক এ আড্ডার আয়োজন।
এদিন যারা এসেছিলেন, তাদের সবাই ক্যান্সারজয়ী। তাদের মধ্যে ছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী, অণুজীববিজ্ঞানী ড. সেঁজুতি সাহা, সূর্যদীঘল বাড়ি খ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মসিহউদ্দিন শাকের, ডা. এস এম শহীদুল্লাহ, নাসরিন বানু পান্না।
আয়োজনটির সমন্বয়ক ক্যান্সার থেকে সেরে ওঠাদের স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠন সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশন (সিসিসিএফ) এর সাধারণ সম্পাদক জাহান-ই-গুলশান শাপলা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কঠিন একটি সময় পার করে আমরা এখানে এসেছি, অনেক সাহস আর শক্তি নিয়ে। বইমেলায় অনেক উদ্দীপনা নিয়ে আমরা এসেছি।
"আমিসহ ৪২জন ক্যান্সারজয়ী মিলে একটা বই লিখেছি, যার নাম 'এখানে থেমো না'। বইটিতে যারা লিখেছেন, এমন ছয়জন ক্যান্সারজয়ী এসেছি মূলত আড্ডা দিতেই।"
আড্ডার ফাঁকে সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেন তারা। মেলায় আগত দর্শনার্থীদের সেলফি তোলার আবদারও মেটান এবং গল্পে গল্পে শোনান ক্যান্সারজয়ের নানা কথা।
ডা. শুভাগত চৌধুরী বলেন, "আমাদের জীবনটা একটা লড়াই। নানাভাবেই সেই লড়াইয়ের মুখোমুখি আমাদের হতে হয়, ক্যান্সার একটা উপলক্ষ মাত্র। আমি ক্যান্সারের কঠিন সময় পার হয়ে আসার কথা লিখেছি বইটিতে।"
ক্যান্সার প্রতিরোধ এবং গবেষণার জন্য সরকারের দিক থেকে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে শুভাগত চৌধুরী বলেন, "ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়ে আমরা কিছু পরিকল্পনা করছি। কিন্তু ক্যান্সার প্রতিরোধ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে এবং ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা বাড়াতে হবে।
“তাহলে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা কমে আসবে। আর ক্যান্সার শুরুর দিকে ধরা পড়লে কিন্তু চিকিৎসাটা সহজ হয়।"
অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা বলেন, "আমি ক্যান্সারজয়ী। ১২ বছর আগে আমার ক্যান্সার ধরা পড়ে। তখন আমি কানাডায় ছিলাম। ২৪ বছর বয়স, অল্প বয়সেই এটি ধরা পড়ে।
“সেখানে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করেছি। আমার চিকিৎসার জন্য কিন্তু কোনো খরচ হয়নি। পরে আমি ভেবেছি, আমার ক্যান্সারজয়ের জয়ের পেছনে তো শুধু চিকিৎসক নয়, আরও অনেকে যুক্ত। আমার পরিবার, বন্ধুরা- সবাই আমাকে সাপোর্ট করেছে। সবার ভালোবাসায় তো আমি দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি।"
সাত বছর আগে দেশে ফেরেন জানিয়ে সেঁজুতি সাহা বলেন, "ক্যান্সার থেকে সুস্থ হওয়ার পর আমি ভাবতাম, কানাডায় আমি যে চিকিৎসা বা সুযোগ পেয়েছি, দেশের সকল মানুষ কি সেটা পায়? পরে আমি ২০১৬ সালে কানাডা থেকে দেশে চলে আসি এবং বাংলাদেশেই আমার বাকি জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
বাংলাদেশে এখন চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনে (সিএইচআরএফ) কাজ করছেন সেঁজুতি।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রাপ্য পরিষেবা এবং প্রাপ্য চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছি। বিশেষ করে শিশুদের নিয়ে কাজ করছি। একটি জিনোমিক্স সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছি।
“ক্যান্সার এবং অন্যান্য জেনেটিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের ডায়াগনস্টিক পরিষেবা দেওয়ার জন্য একটি অত্যাধুনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার তৈরির কাজ করছি।"
মসিহউদ্দিন শাকের বলেন, "আমি লাইফস্টাইলের প্রতি জোর দেওয়ার কথা বলব। আমরা যদি শুদ্ধ এবং সহজ জীবন নিয়ে ভাবি, তাহলে ক্যান্সার ঠেকানো সহজ হবে। ক্যান্সার চিকিৎসার পাশাপাশি ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সহজ হবে।"
শনিবার ছিল বইমেলার দশম দিন। এ দিন মেলা শুরু হয় বেলা ১১টায়, চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। বেলা ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ছিল শিশুপ্রহর।
এদিন বেলা সাড়ে ১১টা, বিকাল সাড়ে ৩টা এবং সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শিশুদের মাঝে বাড়তি আনন্দ ছড়ায় সিসিমপুরের জনপ্রিয় চরিত্র হালুম, টুকটুকি, শিকু, ইকরি, জুলিয়া।
বিকালের পর থেকে দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। সন্ধ্যার পর তা রূপ নেয় জনসমুদ্রে।
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম জানান, এদিন মেলার সাতটি প্রবেশদ্বারের হিসাব অনুযায়ী ১ লাখ ১৫ হাজার ৪৯৪ জন মেলায় এসেছিলেন।
শুক্র ও শনিবার দু'দিনে হিসাব যোগ করলে আড়াই লাখের বেশি দর্শনার্থী ছুটির দুই দিনে মেলায় এসেছেন।
বইমেলার জনসংযোগ বিভাগ জানিয়েছে, শনিবার মেলার তথ্যকেন্দ্রে নতুন বই জমা পড়েছে ১৫২টি। ১০ দিনে মেলায় মোট বইয়ের সংখ্যা দাঁড়ালো ৮২৩টি।
এদিন লেখক বলছি মঞ্চে অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি ও অনুবাদক জিল্লুর রহমান, কথাসাহিত্যিক পলাশ মজুমদার, শিশুসাহিত্যিক আহমেদ রিয়াজ ও প্রাবন্ধিক মোতাহার হোসেন মাহবুব।
শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতা
অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে শনিবার সকাল ১০টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার প্রাথমিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১৭৫ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। বিচারক হিসেবে ছিলেন শিল্পী ইয়াকুব আলী খান, চন্দনা মজুমদার ও সুমন মজুমদার।
মূল মঞ্চ
বিকাল ৪টায় মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: সুচিত্রা মিত্র’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাইম রানা। আলোচনায় অংশ নেন আহমেদ শাকিল হাসমী ও অণিমা রায়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মফিদুল হক।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি দিলারা হাফিজ, চঞ্চল আশরাফ ও রনজু রাইম। আবৃত্তি পরিবেশন করেন অনিমেষ কর, কাজী বুশরা আহমেদ তিথি, মিজানুর রহমান সজল ও মুস্তাক আহমেদ।
পুঁথি পাঠ করেন ফকির আবুল হাশেম। এছাড়া ছিল মিতা মোস্তফার পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্র’ এবং আনোয়ার হোসেনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘আরশিনগর বাউল সংঘ’র পরিবেশনা।
সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী কিরণ চন্দ্র রায়, তপন মজুমদার, অনাবিল ইহসান, রুশিয়া খানম, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, জামাল দেওয়ান ও সাগর দেওয়ান। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ পাল (তবলা), আনোয়ার সাহদাত রবিন (কী-বোর্ড), মনিরুজ্জামান (বাঁশি), অনুপম বিশ্বাস (দোতারা) ও দশরথ দাস (বাংলা ঢোল)।
রোববার যা থাকবে
মেলা শুরু হবে বিকাল ৩টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: কলিম শরাফী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সরওয়ার মুর্শেদ। আলোচনায় অংশ নেবেন মাহমুদ সেলিম ও গোলাম কুদ্দুছ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।