Published : 17 Aug 2024, 04:58 PM
দূর থেকেই আলাদা করে চোখে পড়ে ছেলেটিকে। উচ্চতা যে গড়পড়তা বাংলাদেশিদের চেয়ে একটু বেশিই। নিজের একটা আলাদা পরিচিতও তিনি অল্প কদিনে গড়ে তুলেছেন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কোনো প্রতিনিধি তার আগে বাংলাদেশ ক্রিকেটের মূল স্রোতে আসতে পেরেছেন কি না, খুঁজলেও পাওয়া মুশকিল। তবে ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি ছুঁইছুঁই উচ্চতা বা জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়ে নয়, নজর কেড়েছেন তিনি প্রতিভা দিয়েই। পেস বোলিংয়ে উজ্জ্বল সম্ভাবনার ঝিলিক দেখিয়ে দেশের যুব ক্রিকেটের শীর্ষ পর্যায়ে উঠে এসেছেন অনিক দেব বর্মন।
২০২৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে তাকিয়ে বাংলাদেশ দল গঠনের জন্য ৩০ জনকে নিয়ে অনুশীলন ও ট্রায়াল ম্যাচের পর্ব চলছে এখন। প্রাথমিক সেই স্কোয়াডে আছেন অনিক। মূল দলেও তিনি জায়গা করে নিতে পারবেন বলে আশা করছেন কোচরা। তার রান আপ ও অ্যাকশন, তার প্রতিভা, সুইং করানোর ক্ষমতা ও অন্যান্য স্কিল, সব মিলিয়ে তার মধ্যে সম্ভাবনার রসদ আছে যথেষ্টই।
হবিগঞ্জের বাহুবল থানার কালিগুচিয়া গ্রামের সন্তান অনিক। অনেক বছর ধরে অবশ্য তারা থাকেন শ্রীমঙ্গলে। ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর ছেলেটির খেলাধুলা করতে ভালো লাগত একদম ছোট্টবেলা থেকেই। টিভিতে খেলা দেখতেন, এলাকার বড় ভাইদের সঙ্গে খেলতেন। ক্রিকেটে বড় মাঠ নেই তার গ্রামে। ছোট জায়গাতেই হাত ভেঙে বোলিং করতেন। এভাবেই ক্রিকেটের শুরু।
পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় তারা চলে এলেন শ্রীমঙ্গলে। ক্রিকেট খেলার সুযোগটা এখানে একটু বেশি। পড়াশোনার পাশাপাশি চলতে থাকল তার ক্রিকেট খেলা। ছোট একটি একাডেমিতেও নাম লেখালেন। সেখানে ক্রিকেট বলে অনুশীলনের সুযোগ পেলেন। এরপর মৌলভীবাজার জেলার অনূর্ধ্ব-১৬ ট্রায়ালে ভালো বোলিং করে টিকে গেলেও স্কোয়াডে জায়গা পেলেন না। আশাহত না হয়ে নিজের কাজ চালিয়ে গেলেন। ২০২১ সালে মৌলভীবাজারে স্কুল ক্রিকেটে দারুণ বোলিং করে প্রতিভার জানান দিলেন।
এরপর শিক্ষকদের পরামর্শে তিনি হবিগঞ্জ জেলা দলের ট্রায়ালে নাম লেখান। সেখানে তার দিকে আলাদা করে নজর পড়ে জেলা কোচদের। ফোনে তারা সেটি জানান বিসিবির কোচ নাজমুল হোসেনকে। জাতীয় দলের সাবেক এই পেসার অনিকের উচ্চতার কথা জেনেই বোলিংয়ে ভিডিও দেখতে চান। ভিডিও ক্লিপ দেখে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়নি তার। দ্রুতই জেলা কোচদের জানিয়ে দেন, জেলা দলে যেন নেওয়া হয় দীর্ঘদেহী এই পেসারকে।
এরপর বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে অনিকের এগিয়ে যাওয়ার পালা। হবিগঞ্জ জেলা দলে ভালো বোলিং করে জায়গা করে নিলেন বিভাগীয় দলেও। সেখানেও নিজেকে আলাদা করে জানান দিয়ে জাতীয় যুব ক্রিকেট লিগে খেলেন। সব আসরে ভালো করেই এখন তিনি বাংলাদেশ যুব দলে জায়গা করে নেওয়ার খুব কাছাকাছি।
নানা বাস্তবতার কারণেই বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে ফুটবল ও অন্যান্য খেলার দিকে ঝোঁক থাকে বেশি। অনিকের ক্রিকেটপ্রীতি গড়ে উঠে টিভিতে খেলা দেখে। মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে শনিবার সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে সেই গল্প শোনালেন তিনি।
“আমাদের বাসায় সাদা-কালো টিভি ছিল। ছোটবেলায় আমি সেখানে অনেক খেলা দেখতাম। বেশিরভাগ ভারতের খেলা দেখতাম। তখন আমি প্রায় সব ক্রিকেটারের নাম জানতাম। তখনই ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসার শুরু। বড় ভাইদের সঙ্গে খেলতাম। ওখান থেকে আস্তে আস্তে এখানে আসা।”
ছেলেবেলা থেকে বোলিংই করতেন তিনি। সেই পথ ধরেই ছুটে চলেছেন। তবে এগিয়ে চলার পথে বড় বাধা পেয়েছেন পরিবার থেকেই। তার বাবার ট্রাক আছে একটি, নিজেই চালান। বাবা চাননি দুই ছেলের মধ্যে বড়জন খেলাধুলা করে সময় নষ্ট করুক। কিন্তু কখনও পরিবারকে ফাঁকি দিয়ে, কখনও লড়াই করে নিজের ভালোবাসাকে আঁকড়ে রাখেন অনিক।
“আমার পরিবার তো শুরুতে কেউ সমর্থন দিত না। তখন আমি পালিয়ে খেলতাম। আমাকে মানুষ বাসা থেকে এসে নিয়ে যেত (খেলতে)। বাবা মানা করতেন। খেলে কী হবে, কী করব, এসব বলতেন। তবু আমি পালিয়ে খেলতাম। মারও খেয়েছি অনেক।”
বাবার সঙ্গে সেই লুকোচুরি আর লড়াই শেষ হয় একটা পর্যায়ে। মা তো ছেলের পাশে ছিলেন আগে থেকেই। জেলা পর্যায়ে খেলা শুরুর দিকে বাবা ও পরিবারের অন্যরাও তাকে উৎসাহ দিতে থাকেন। এই যে এখন দূরে আছেন, বাবা-মা প্রতিদিন খোঁজখবর নেন ফোন করে। যান্ত্রিক ঢাকায় সাবধানে চলতে বলেন তাকে।
উৎসাহ পেলেও পরিবারের আর্থিক সাধ্য খুব বেশি ছিল না। ক্রিকেটের পথ ধরে যখন এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি, তখন জানতে পারলেন পেসারদের জন্য বিশেষ বুট প্রয়োজন হয়। সেই বুট কেনার টাকা দিতে পারেননি বাবা। কিছুাদন পরে অবশ্য বাবাই টাকা জোগাড় করে বুট কিনে দিয়েছেন ছেলেকে। সেই বুট তালি দিয়ে সেলাই করে চালিয়ে নিচ্ছেন তিনি।
আপাতত তার লক্ষ্য যুব দলে জায়গা করে নেওয়া। তবে ক্রিকেটে তার স্বপ্নটা আরও বড়।
“আমার স্বপ্ন, আমি এক দিন বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলব। এটাই স্বপ্ন। এখন যে মঞ্চটা পেয়েছি, মনে হচ্ছে সামনে এগোতে পারি। কোচরা বলেছেন, ‘তুমি ভালো বোলিং করো। সামনে আরও ভালো হবে।”
নিজের আদর্শ মানেন তিনি তাসকিন আহমেদকে। দেশের বাইরে ভালো লাগে শোয়েব আখতার ও ব্রেট লিকে। তাদের বোলিংয়ের ভিডিও দেখেন মাঝেমধ্যেই।
তাসকিনের মতো খুব গতিময় অবশ্য এখনও নন অনিক। কোচ নাজমুল জানালেন, আপাতত ১৩০ কিলোমিটারের একটু ওপরে হতে পারে গতি। সাবেক এই পেসারের বিশ্বাস, আরেকটু ভালো খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে থাকলে, শরীর আরও পোক্ত হলে, ভালো কোচিং পেলে অনিকের গতি আরও বাড়বে।
পেছন ফিরে তাকিয়ে নাজমুল বললেন, শুরু থেকেই অনিকের বোলিংয়ে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ছাপ যথেষ্ট দেখতে পেয়েছেন তিনি।
“আমি ওকে জেলা দলে নিতে বললাম। এরপর বাকি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ও নিজেই চলে এসেছে। নিজেই পারফর্ম করেছে। বাকি যারা ছিল, তাদের চেয়ে বেশি প্রতিভাবান ও। যুব ক্রিকেট লিগে ওর পারফরম্যান্স ভালো ছিল। আর বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে খেলাগুলোতে কিন্তু পারফরম্যান্সের চেয়ে আমরা প্রতিভা বা কোন দিকে যাবে, সেগুলো আমরা বেশি মূল্যায়ন করি। এগুলো চিন্তা করে, আমার মনে হয়েছে ও সম্ভাবনাময়।”
“আমাদের মনে হয়েছে, আমরা যদি ওকে নার্সিং করি, তাহলে অনেক দূর যেতে পারে। এই চিন্তা করেই ওকে নেওয়া। এছাড়া জেলা পর্যায়ে আমরা দেখেছি, প্রত্যেকটা ম্যাচে ওর আশেপাশে কেউ নেই। নিজেই তাই অটোমেটিক চলে এসেছে এই পর্যায়ে।”
সময়ে সঙ্গে গতি বাড়ার আশা তো আছেই। অনিকের স্কিলেও দারুণ ভরসা রাখছেন নাজমুল।
“আসলে আমার নিজেরও একটা ভুল ধারণা ছিল যে, আদিবাসিরা এত লম্বা হয় না। কিন্তু অনিক ৬ ফুটের বেশি। ওর যে বয়স, আমার মনে হচ্ছে, আরও লম্বা হবে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীর পোক্ত হবে, গতি আরও বাড়বে। পেশাদার ক্রিকেট এখনও বোঝেনি। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে আসার পরে বুঝতে শিখেছে। আমি মনে করি, গতিটা বাড়া সম্ভব। সঙ্গে সুইং আছে।”
“শুধু উচ্চতা নয়, ওর রান-আপ থেকে শুরু করে সব কিছুই আমাদের ভালো লেগেছে। অন্য যে বোলার দেখেছি তাদের চেয়ে ওর গতি বলেন, অ্যাকুরেসি বলেন, রান-আপ বা সব কিছু মিলিয়ে আমরা নির্বাচক প্যানেলে যারা ছিলাম, তাদের মনে হয়েছে, বাকিদের চেয়ে অনিক ভালো। আমি মনে করি, ওর ভবিষ্যৎ ভালো।”
সেই সম্ভাবনার পূর্ণতার পথেই এগোতে চান অনিক। পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছেন। শ্রীমঙ্গল সরকারী কলেজ থেকে এবার এইচএসচি পরীক্ষা দিচ্ছেন। তবে স্বপ্নজুড়ে এখন শুধু ক্রিকেট। যে শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে এখন ট্রায়াল দিচ্ছেন তিনি, এখানেই একসময় বল হাতে ছুটতে চান দেশের জার্সি গায়ে চাপিয়ে আর পতাকাকে হৃদয়ে ধারণ করে।
স্বপ্নটি শুধু তার একারই নয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নামের যে বড় এক জনগোষ্ঠী, এই দেশে যারা নানাভাবে অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ, তাদের সবার স্বপ্নকেও তো ধারণ করছেন অনিক!