Published : 02 Jun 2025, 01:36 PM
চার হাজার ওয়ানডে রান থেকে ১০ রান পেছনে ছিলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। সেই দূরত্ব আর কখনও ঘুচবে না। ওয়ানডে ক্রিকেটেই যে আর দেখা যাবে না তাকে! অনেকের মতে ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ইনিংসটি খেলেছেন যিনি, যার ব্যাট থেকে এসে স্মরণীয় আরও কিছু ইনিংস, আগ্রাসী ও বিনোদনের ফেরিওয়ালা এই ক্রিকেটার বিদায় বলে দিয়েছেন ৫০ ওভারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে।
গত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পর এই সংস্করণ থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন আরেক অস্ট্রেলিয়ান তারকা স্টিভেন স্মিথ। তার সঙ্গী হলেন এবার ম্যাক্সওয়েল। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি অবশ্য খেলে যাবেন ৩৬ বছর বয়সী তারকা। আপাতত তার দৃষ্টি আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে।
গত ফেব্রুয়ারি-মার্চে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে তিনটি ম্যাচ খেলেছিলেন ম্যাক্সওয়েল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে স্বভাবসুলভ ব্যাটিংয়ে ১৫ বলে ৩২ রানে অপরাজিত ছিলেন। আফগানদের বিপক্ষে বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত ম্যাচে ব্যাটিং পাননি। ভারতের বিপক্ষে আউট হন ৭ রানে। দুবাইয়ে সেই ম্যাচটিই হয়ে থাকল তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ।
ফাইনাল ওয়ার্ড পডকাস্ট-এ দীর্ঘ আলোচনার ফাঁকে সোমবার এই অবসরের সিদ্ধান্ত জানান ম্যাক্সওয়েল।
১৪৯ ম্যাচে ৩৩.৮১ গড়ে ৩ হাজার ৯৯০ রান নিয়ে শেষ হলো তার ওয়ানডে ক্যারিয়ার। সেঞ্চুরি চারটি, ফিফটি ২৩টি। অফ স্পিনে উইকেট ৭৭টি, ম্যাচে চার উইকেট নিয়েছেন চারবার।
শুধু এসব সংখ্যায় তাকালে মনে হবে সাদামাটা এক ক্যারিয়ার। কিন্তু এসব সংখ্যার সাধ্য কী ম্যাক্সওয়েলকে ফুটিয়ে তোলার! কীর্তিময় এমন কিছু ইনিংস তিনি খেলেছেন, যা ওয়ানডে ক্রিকেটে অমর করে রাখবে তাকে। ২০১৫ ও ২০২৩ বিশ্বকাপ জয়ের সুখস্মৃতি তার সঙ্গী। তবে এই সংস্করণকে দিনি উপহার দিয়েছে অবিস্মরণীয় কিছু ইনিংস।
গত বিশ্বকাপে মুম্বাইয়ে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ইনিংসটি যেমন। ২৯২ রান তাড়ায় ৯১ রানে ৭ উইকেট হারিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। সেখান থেকে কল্পনার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া এক ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়ে দেন ম্যাক্সওয়েল। পায়ে বারবার ক্র্যাম্প করেছ তার, ব্যথায় চিৎকার করেছেন, এক পর্যায়ে বলতে গেলে স্রেফ এক পায়ে ব্যাটিং করেছেন, দৌড়ে রান নেননি। অষ্টম উইকেটে ২০২ রানের রেকর্ড জুটি গড়েন অধিনায়ক প্যাট কামিন্সকে সঙ্গী করে, সেখানে কামিন্সের অবদান ছিল স্রেফ ১২!
২১ চার ও ১০ ছক্কায় ১৩৮ বলে ২০১ রানের অপরাজিত ইনিংসটিতে ওয়ানডের সর্বকালের সেরা ইনিংস মনে করেন অনেকেই।
এটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি, রান তাড়ায় ওয়ানডে ইতিহাসের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি, ছয় নম্বরে নেমে তো বটেই, ওপেনিংয়ের নিচে নেমে কোনো ব্যাটসম্যানের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি।
ওই বিশ্বকাপেই নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে তার ৪০ বলের সেঞ্চুরি বিশ্বকাপ ইতিহাসের দ্রুততম শতরান। ২০১৫ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন ৫১ বলে। বিশ্বকাপে যা চতুর্থ দ্রুততম সেঞ্চুরি।
ম্যাক্সওয়েলের অন্য ওয়ানডে সেঞ্চুরিটিও স্মরণীয়। ২০২০ সাল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩০৩ রান তাড়ায় ৭৩ রানে পাঁচ উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া। এরপর তিনি ও অ্যালেক্স কেয়ারি মিলে জিতিয়ে দেন অস্ট্রেলিয়াকে। সাত ছক্কায় ৯০ বলে ১০৮ রান করেছিলেন সেদিন তিনি। সেঞ্চুরি করেছিলেন কেয়ারিও।
পরিসংখ্যানের একটি দিকে তাকালে অবশ্য ম্যাক্সওয়েলের ক্রিকেট দর্শনের একটি দিক ফুটে ওঠে। ওয়ানডেতে তার স্ট্রাইক রেট ১২৬.৭০। অন্তত ৫০ ইনিংস ব্যাট করা বা কমপক্ষে ১০৫০ রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ইতিহাসের সেরা স্ট্রাইক রেট তারই।
এসব বাইরেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তার ছোট ছোট অবদান ছিল মহামূল্য। এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেই তার ১৫ বলে ৩২ রানের অপরাজিত ইনিংসটি অস্ট্রেলিয়াকে সহায়তা করে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির রেকর্ড ৩৫২ রান তাড়ায়। ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই উইকেট নেওয়ার পর ব্যাটিংয়ে ২৯ বলে অপরাজিত ৪৪ রানের মূল্যবান ইনিংস খেলেন।
স্রেফ উইকেট সংখ্যা দেখে তার বোলিংয়ের গুরুত্ব বোঝা যাবে না। এখন অবিশ্বাস্য মনে হলেও ২০১৫ বিশ্বকাপ জয়ের পথে অস্ট্রেলিয়ার মূল স্পিনারই ছিলেন তিনি। আরও নানা সময়ে তার কয়েকটি ওভার, কোনো ব্রেক থ্রু, এসব ঘুরিয়ে দিয়েছে ম্যাচের মোড়। ২০২৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে উড়ন্ত সূচনা করা রোহিত শার্মাকে বিদায় করেছিলেন তিনিই। ২০১৪ সালে একটি ওয়ানডেতে শেষ ওভারে দুই উইকেট নিয়ে পাকিস্তানের যখন দরকার দুই রান, তিনি তখন ডাবল উইকে মেডেন নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে জিতিয়েছিলেন এক রানে।
ফিল্ডিংয়ে তো তিনি সর্বকালের সেরাদের একজন। অবিশ্বাস্য সব ক্যাচ নিয়েছেন, মাঠের যে কোনো জায়গায় দুর্দান্ত ফিল্ডিং করে গেছেন ম্যাচের পর ম্যাচ।
অবসরের পেছনের কারণ হিসেবে ম্যাক্সওয়েল বললেন চোটের কথা। ২০২২ সালে পা ভেঙে দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে থাকার পর নানা সময়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে তিনি ধুঁকেছেন। এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে চোট তাকে ভুগিয়েছে বেশ। ২০২৭ বিশ্বকাপে যে খেলতে পারবেন না, তা তিনি বুঝে গেছেন। এজন্যই বিকল্প তৈরি করার সুযোগ দিতে চান নির্বাচকদর ও টিম ম্যানেজমেন্টকে।
“আমার মনে হচ্ছিল, কন্ডিশন অনুযায়ী আমার শরীর যেভাবে সাড়া দিচ্ছে, তাতে দলকে হতাশ করে যাচ্ছিলাম আমি। জর্জ বেইলির (প্রধান নির্বাচক) সঙ্গে বেশ ভালো আলোচনা হয়েছে আমার এবং সামনের পথচলায় তার ভাবনা জানতে চেয়েছিলাম আমি। ২০২৭ বিশ্বকাপের প্রসঙ্গ এসেছে আমাদের এবং তাকে আমি বলেছি যে, ‘মনে হয় না যে ওই বিশ্বকাপে আমি খেলতে পারব। এর চেয়ে বরং সময় হয়েছে আমার পজিশন নিয়ে পরিকল্পনা সম্ভাব্যদের বাজিয়ে দেখার এবং জায়গাটি তার নিজের করে নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার। আশা করি এই ভূমিকায় মানিয়ে নেওয়ার পর্যাপ্ত সময় তারা পাবে।”
“আমি সবসময়ই বলেছি, যতদিন নিজেকে খেলার জন্য যথেষ্ট ভালো মনে হবে, ততদিন জায়গা কাউকে দেব না। তবে আরও গোটা দুয়েক সিরিজ জায়গা ধরে রাখা ও প্রায় স্বার্থপর কারণে খেলা চালিয়ে যেতে চাইনি আমি। তারা খুব পরিষ্কার পরিকল্পনা ধরে এগোচ্ছে। আগামী বিশ্বকাপে তাকিয়ে সম্ভাব্য লাইন-আপ খতিয়ে দেখার সুযোগ হবে এতে। পরিকল্পনা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আমি জানি।"
তার টেস্ট ক্যারিয়ার থমকে আছে সাত ম্যাচ খেলে। আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেননি এই সংস্করণ থেকে। তবে সেই অধ্যায়ও আদতে শেষ হয়েই গেছে। এখন ম্যাক্সওয়েলের পরিচয় শুধুই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার।
আইপিএল থেকে ফিরেছেন তিনি আঙুলের চোট নিয়ে। তবে ফিট হয়ে সামনেই মেজর লিগ ক্রিকেটে খেলবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এরপর জাতীয় দলের জার্সিতে আগামী মাসে খেলবেন ওয়েস্ট ইন্ডিজে টি-টোয়েন্টি সিরিজে।