Published : 07 Nov 2024, 08:59 AM
একের পর এক উইকেট নিয়ে আল্লাহ মোহাম্মাদ গাজানফার যেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না, কীভাবে উদযাপন করবেন। তানজিদ হাসানকে আউট করে শূন্য লাফিয়ে উঠলেন। ক্যারম ডেলিভারিতে মুশফিকুর রহিমকে ঘোল খাইয়ে ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর মতো ‘Siuuu’ উদযাপন করলেন। তাসকিন আহমেদকে বোল্ড করে বাঁধনহারা দৌড়ে ছুটলেন।
শারজাহর ২২ গজে যা ফুটে উঠছিল, কণ্ঠের দোলায় সেটিই যেন বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে চাইলেন ধারাভাষ্যকার, “উজ্জ্বল হয়ে এখানে জ্বলে উঠছেন আল্লাহ মোহাম্মাদ… নতুন এক সেনসেশন, আফগানিস্তানের নতুন নায়ক…।”
তার প্রতিভার খবর ক্রিকেট বিশ্বে কিছুটা ছড়াতে শুরু করেছিল আগে থেকেই। গত মৌসুমে আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সে ছিলেন। এই বছর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে নজর কেড়েছেন। আন্তর্জাতিক অভিষেকও হয়ে গেছে আগেই। সম্ভাবনাময় একজন হিসেবে তাকে নিয়ে টুকটাক আলোচনা ছিল ক্রিকেট বিশ্বে। তবে নিজের আগমণী বার্তা তিনি সত্যিকার অর্থে সরবে ছড়িয়ে দিলেন বাংলাদেশকে বিধ্বস্ত করে।
৬.৩ ওভারে ২৬ রানে ৬ উইকেট, শারজাহতে বুধবার বাংলাদেশের ব্যাটিং ধ্বংস করে দিলেন ১৮ বছর বয়সী স্পিনার। ৯২ রানের জয়ে সিরিজে এগিয়ে আফগানিস্তান।
অবশ্য ‘ধ্বংস’ বা ‘বিধ্বস্ত’ শব্দগুলির চেয়ে তার বোলিংয়ের উপযুক্ত পরিচয় হতে পারে ‘ইন্দ্রজাল।’ রহস্যময় স্পিনের মায়াবি জাল ছড়িয়েই তো তিনি শিকার ধরেন। তাকে অফ স্পিনার বলা হলেও পারেন আসলে আরও অনেক কিছু। দুই দিকেই টার্ন, ক্যারম বল, ব্যাক স্পিন, গুগলি… কী পারেন না তিনি! বলের গতির কারণে ‘অফ দা পিচ’ তাকে পড়তে পারা ব্যাটসম্যানদের জন্য কঠিন। গতির হেরফেরও করতে পারেন প্রয়োজন বুঝে।
এই সব অস্ত্রের কথা জেনে আরেকজন স্পিনারের কথা মনে পড়তে বাধ্য। গত সাত বছর ধরে ক্রিকেট বিশ্বকে এসব জাদু দেখিয়ে আসছেন তো মুজিব-উর-রাহমান!
হ্যাঁ, গাজানফার একই ঘরানার বোলার। আফগান ক্রিকেটে ‘নতুন মুজিব’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি বেশ আগে থেকেই। যদিও তার আদর্শ রাভিচান্দ্রান অশ্বিন। ভারতীয় স্পিন গ্রেটের মতোই তার প্রিয় ডেলিভারি ক্যারম বল।
গাজানফারের গল্প অন্য বেশির ভাগ আফগান ক্রিকেটারের মতোই। ছেলেবেলায় টেনিস বলে খেলতেন। তার পর একটি একাডেমিতে নাম লেখান। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার কারণে শুরুতে ছিলেন পেসার। পরে স্পিন বোলিংয়ে তার সহজাত প্রতিভা দেখে তাকে স্পিনার হতে বলেন কোচরা। তাকে নিবিড় যত্নে গড়ে তোলেন সাবেক আফগান অধিনায়ক দাওলাত আহমাদজাই।
এই বছর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে চার ম্যাচে আট উইকেট শিকার করেন। তার বোলিংয়ের ধরন ও অস্ত্রের সমাহার দেখে তখনই তার দিকে নজর পড়ে বিশ্ব ক্রিকেটের অনেক বিশেষজ্ঞের।
যুব বিশ্বকাপের মাস খানেক পরই আফগানিস্তানের হয়ে অভিষেক হয়ে যায় ওয়ানডেতে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি ওয়ানডে খেলে উইকেট পাননি, বিশেষ কিছু দেখাতে পারেননি।
তবে তার ভেতর যে বিশেষ কিছু আছে, এটা তো অনেকেই জেনে গেছেন।
চোট পাওয়া মুজিব উর রাহমানের বদলি হিসেবে আইপিএলে তাকে নিল কলকাতা নাইট রাইডার্স। আগের আইপিএলের নিলামে নাম দিলেও দল পাননি সেবার। এবার নিলাম ছাড়াই পেয়ে গেলেন দল। যদিও ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি।
তবে জাতীয় দলে তার সুযোগ এলো পরের সিরিজেও। এবার প্রতিপক্ষ আরও কঠিন। তবে গাজানফার মেলে ধরলেন নিজেকে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই ১০ ওভারে স্রেফ ২০ রান দিয়ে নিলেন ৩ উইকেট। সিরিজের শেষ ম্যাচেও উইকেট নিলেন আরেকটি।
এরপর গত মাসে ইমার্জিং টিমস এশিয়া কাপে দুর্দান্ত পারফর্ম করে বড় অবদান রাখলেন তিনি আফগানিস্তানের শিরোপা জয়ে। ফাইনালে ম্যাচের সেরা ছিলেন তিনিই।
সেই পথ ধরে বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজে থাকা অবধারিতই ছিল তার। মুজিব দলে থাকলে অবশ্য একাদশে সুযোগ পেতেন কি না, সেই প্রশ্ন তোলা যায়। তবে সুযোগ পেয়ে তিনি প্রশ্নের অবকাশই রাখলেন না, মুজিবের ঘাটতিও বুঝতে দিলেন না।
বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ভুগিয়ে, ধুঁকিয়ে ২৬ রানে ৬ উইকেট তার। এর মধ্যে জাদুকরি শেষ স্পেলে ৩.৩ ওভারে চার রানে তার শিকার পাঁচ উইকেট!
আফগানিস্তানের হয়ে ওয়ানডেতে দ্বিতীয় সেরা বোলিং কীর্তি এটি। ওয়ানডে ইতিহাসে তার চেয়ে কম বয়সে ৬ উইকেট নিতে পেরেছেন আর কেবল ওয়াকার ইউনিস ও রাশিদ খান।
ম্যাচের পর আফগান অধিনায়ক হাশমাতউল্লাহ শাহিদির কণ্ঠে শোনা গেল গাজানফারকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আর সামনের পথচলা নিয়ে উচ্চাশা।
“সে স্পেশাল এক প্রতিভা। ভালো ছেলে। আফগানিস্তানের হয়ে তার ভবিষ্যৎ ভালো। তার ওপর আমি বিশ্বাস রেখেছি। এজন্যই সে দলে আছে এবং খেলছে।”
“প্রথম তিন ওভারে সে খুব ভালো বোলিং করেছে। তবে ওই ‘নো’ বলের পর তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘কি করছো? এসব আর করা যাবে না।’ সে তখন বলেছে, ‘ঠিক আছে, আর হবে না।’ পরের স্পেলে সে প্রথম বল থেকে খুব ভালো করেছে। আশা করি ভবিষ্যতেও সে আমাদের দলের হয়ে এরকমই করে যাবে।”
আফগানিস্তানের হয়ে তো বটেই, রাশিদ-নাবি-মুজিবদের মতো শিগগিরই তাকে বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট মাতাতে দেখা যাবে নিশ্চিতভাবেই। আগামী বিপিএলে তিনি খেলবেন রংপুর রাইডার্সে, খেলবেন আইএল টি-টোয়েন্টিতেও। এবারের আইপিএলের নিলামেও তাকে নিয়ে বাড়তি আগ্রহ দেখা গেলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।