Published : 25 Oct 2022, 03:50 PM
হোবার্ট শহরটি যেমন ছোট, বিমানবন্দরও তেমনি খুব বড় নয়। দু-তিনটি ফ্লাইট একসঙ্গে থাকলেই টার্মিনাল প্রায় ভরে ওঠে। মঙ্গলবার সকালেও যেমন, ছিমছাম জায়গাটি প্রায় ভরে উঠল লোকের ভীড়ে। তবে ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার ইয়ান বিশপকে আলাদা করে চোখে পড়ল অনেক লোকের মাঝেও। একটু ইতিউতি ঘুরলেন। কিছুক্ষণ পর জুতসই একটি জায়গা খুঁজে পেয়ে বসলেন। পকেট থেকে ফোন বের করে কিছু একটা পড়তে থাকলেন গভীর মনোযোগে।
জীবনের ইনিংসে আগের দিনই ৫৫ পূর্ণ হয়েছে তার। ‘লেট হ্যাপি বার্থ ডে ইয়ান, হ্যাপি ফিফটি ফাইভ…”, কাছে গিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতেই তিনি চোখ তাকালেন। হাসিমুখে ধন্যবাদ জানালেন। কথা জমাতে এরপর অবধারিতভাবেই বলতে হলো, “আমি আপনার বড় ভক্ত…।”
তারকারা এসব শুনে অভ্যস্ত। স্বাভাবিকভাবেই স্রেফ হালকা হাসির ভদ্রতা দেখিয়ে আবার ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখলেন। কথা টেনে নিতে এবার আরেক দফায় বলতেই হলো, “আপনার ধারাভাষ্যও খুব ভালো লাগে। তবে আমি আসলে আপনার বোলিংয়ের ভক্ত ছিলাম। ১৯৯৫ সালে হেডিংলিতে আথারটন-স্টুয়ার্টদের কাঁপিয়ে আপনার ৫ উইকেট পাওয়ার ম্যাচটি দেখেছিলাম…।”
এই টোটকায় কাজ হলো। এবার তিনি ভালো করে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে কৌতূহল আর আগ্রহের ছাপ পাওয়া গেল। হয়তো, অনেক দিন পর তিনি এই কথা শুনলেন।
নাহ, তার বোলিংয়ের ভক্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। একসময় দারুণ সম্ভাবনাময় ও ভয়ঙ্কর এক ফাস্ট বোলার ছিলেন। গতি, বাউন্স আর মুভমেন্ট দিয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাটসম্যানদের জন্য হয়ে উঠেছিলেন আতঙ্ক। তবে তার জন্য আততায়ী হয়ে আসে চোট। বিশেষ করে স্ট্রেস ফ্র্যাকচার একরকম শেষ করে দেয় তার ক্যারিয়ার।
তার পরও ওয়ালশ-অ্যামব্রোস-বেঞ্জামিনদের জমানায় ৪৩ টেস্টে ২৪.২৭ গড়ে ১৬১ উইকেট ও ৮৪ ওয়ানডেতে ১১৮ উইকেট কিছুটা তুলে ধরে তার সামর্থ্যের ছবি।
এমন একজনের বোলিংয়ের ভক্ত অনেকে থাকতেই পারে। তবে বর্তমান বাস্তবতা হলো, ধারাভাষ্যকার হিসেবে তিনি এতটাই জনপ্রিয় ও এমন উচ্চতায় নিজেকে তুলে নিয়েছেন, তার এই পরিচয়ের আড়ালে অনেক সময়ই চাপা পড়ে যায় সাবেক ক্রিকেটার সত্ত্বা।
হুট করে তার বোলিংয়ের প্রসঙ্গ ওঠায় হয়তো তিনিও কথা চালিয়ে যেতে খানিকটা আগ্রহ পেলেন। সেই সময়ের ক্রিকেটের কিছু প্রসঙ্গ এলো কথোপকথনে। তবে বাংলাদেশের একজন সংবাদকর্মীর মূল আগ্রহ তো এখন এই বিশ্বকাপ ও বাংলাদেশ দল নিয়ে!
কৌশলে তাই দ্রুতই কথার মোড় বদলে নব্বই দশকের হেডিংলি থেকে চলে এলো এই বিশ্বকাপের হোবার্টে। আগের দিন বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস ম্যাচে ধারাভাষ্য দিয়েছেন বিশপ। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে তিনি নিবিড়ভাবে অনুসরণ করে আসছেন বেশ অনেক বছর ধরেই।
বাংলাদেশের একজনের সঙ্গে কথা বলছেন জানার পর বিশপ নিজ থেকেই বললেন, “বাংলাদেশ তো জয়ে শুরু করল, অভিনন্দন!”
ডাচদের বিপক্ষে বাংলাদেশ জিতলেও জয়ের ধরনে অস্বস্তি থাকার কথা সমর্থক, সংবাদকর্মীদের। সেই আক্ষেপের কথা তুলে ধরতেই বিশপ যেন আশ্বস্ত করতে চাইলেন, “বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ সবসময়ই কঠিন, ম্যান! আর অস্ট্রেলিয়ায় এসে প্রথম ম্যাচে মানিয়ে নিতে সমস্যা হতেই পারে। নেদারল্যান্ডস তো খুব ট্রিকি প্রতিপক্ষ। নিশ্চিত থাকতে পারেন, যত সময় গড়াবে, ওদের পারফরম্যান্সে উন্নতি হবে।”
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে বাংলাদেশের জয়ের দুই নায়কই পেসার। ৪ উইকেট ম্যাচ সেরা তাসকিন আহমেদ। তরুণ হাসান মাহমুদ ২ উইকেট নেন স্রেফ ১৫ রানে। বিশপ বরাবরই পেস বোলিং নিয়ে কথা বলেতে উৎসাহী। তাসকিনকে নিয়ে তার ভালোলাগাও অনেক দিনের। পুরনো সেই উচ্ছ্বাস আবার ফুটে উঠল তার কণ্ঠে।
“তাসকিনের পরিবর্তনটা দারুণ। আগের চেয়ে অনেক বেশি ফিট সে, সেটির প্রতিফলন পড়ছে বোলিংয়ে। আমি শুনেছি, সে অনেক পরিশ্রম করেছে। একটা সময় ওর বোলিং একটু হতাশাজনক ছিল। খুব ভালো ব্যাপার যে নিজের সম্ভাবনা সে বুঝতে পেরেছে। এখন ওকে বেশ দায়িত্বশীল ও পরিণত মনে হয়। বোলিং আক্রমণের নেতাও সে এখন, সেটাও মনে হয় উপভোগ করছে।”
অনেক দিন ধরেই তাসকিনকে দেখে আসছেন বিশপ। হাসানকে খুব একটা দেখেননি আগে। নিজ থেকেই বললেন, বাংলাদেশের তরুণ এই পেসারকে তার মনে ধরেছে।
“হাসান দারুণ সম্ভাবনাময়। অ্যাকশন খুব মসৃণ। গতি আছে। বয়স ও অভিজ্ঞতার তুলনায় পরিণত বলে মনে হয়। হি ইজ বিকামিং আ লিটল স্টার।”
বাংলাদেশের পেসারদের নিয়ে এমন প্রশংসা করছেন, কিন্তু চুপসে গেলেন তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাদ পড়ার প্রসঙ্গ উঠতেই। ফোনের স্ক্রিনের দিকে দেখালেন। কোনো ক্রিকেট ওয়েবসাইটে একটি লেখা তিনি পড়ছিলেন, যেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাদ পড়ার দিনটিকে কাইরন পোলার্ড বলেছেন, ‘স্যাড ডে।’ বিশপও হতাশার ভঙ্গিতে স্রেফ বললেন, “ভেরি স্যাড…।”
কোচ ফিল সিমন্সের পদত্যাগের খবরও তখনই চোখে পড়ল তার। সেটিও দেখালেন এমন এক ভঙ্গি করে, যেটির অর্থ বোঝা কঠিন।
মুস্তাফিজের বোলিং নিয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার ছিল। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিদায়ের বিষাদে বুঝি হারিয়ে গেল তার সব আগ্রহ। ‘আপনার ফ্লাইট কখন? শুভ কামনা… আমি একটু কফি নিতে যাই।”
হাসিমুখে বিদায় নিয়ে তিনি কফির লাইনে দাঁড়ালেন। দিয়ে গেলেন তাসকিন, হাসান আর বাংলাদেশ দলের জন্য প্রেরণার রসদ।