Published : 14 May 2024, 12:42 AM
কারো মা অপেক্ষায় আছেন প্রাণপ্রিয় সন্তানের জন্য। কারো প্রিয়তমা স্ত্রী বন্দরে যাবেন স্বামীকে নিয়ে আসতে। এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের প্রত্যেকের পরিবারে চলছে শেষ কয়েক ঘণ্টার আনন্দময় অপেক্ষা।
সোমবার সন্ধ্যায় কুতুবদিয়ায় নোঙর করেছে জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরা বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। জাহাজে ফিরেছেন জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়া ২৩ নাবিকও।
মঙ্গলবার বিকেলে একটি ছোট জাহাজে করে তারা পৌঁছাবেন চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি-১) জেটিতে। সেখানেই দুই মাস পর সামনা সামনি দেখা হবে পরিবারের সদস্যদের সাথে।
সাধারণত নাবিকরা ছয় মাস বা আরো বেশি সময়ের জন্য জাহাজে করে দেশ ছেড়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যান। জাহাজ ভেড়ে বিশ্বের নানা বন্দরে। তাই দীর্ঘ সময় প্রিয়জনদের অনুপস্থিতিতে খানিকটা অভ্যস্ত নাবিকদের স্বজনরা।
কিন্তু এবারের ফেরা অন্য রকম। দুই মাস আগে ভারত মহাসাগরের সোমালিয়া উপকূলে সশস্ত্র সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে আবদুল্লাহ; নাবিকরা হন জিম্মি। পরিবারের সদস্যদের ফোন করে তারা জানান, মুক্তিপণ না দিলে তাদের একে একে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
সেই ১২ মার্চ থেকেই পরিবারের সদস্যদের ফিরে পেতে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ আর অনিশ্চিত অপেক্ষার শুরু।
এরপর সমুদ্র পথের নিরাপত্তায় থাকা আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলো এমভি আবদুল্লাহকে অনুসরণ করে, অভিযান চালিয়ে জাহাজ মুক্ত করার আগ্রহ দেখায়। স্থলভাগ থেকে সোমালি পুলিশের জলদস্যুদের ঘিরে ফেলার খবর আসে। জিম্মি জাহাজে পানি ও খাবার ফুরিয়ে আসার খবর উদ্বেগ বাড়ায়। একের পর এক ঘটনায় নাবিকদের পরিবারে বাড়তে থাকে দুশ্চিন্তা।
জিম্মি হওয়ার এক মাস পর যখন মুক্তি পান নাবিকরা, তখন সেই উদ্বেগের অনেকটা লাঘব হয়। কিন্তু স্বজনদের কাছে পাওয়ার অপেক্ষার শেষ হয়নি তখন। মঙ্গলবার শেষ হতে চলেছে সেই অপেক্ষা।
স্বজনদের কাছে আর দেশের মাটিতে ফেরার আকুল অপেক্ষায় আছেন নাবিকরাও।
সোমবার সন্ধ্যায় দেশের সমুদ্রসীমায় কুতুবদিয়া চ্যানেলে যখন এমভি আবদুল্লাহ নোঙর করে, তার কিছুক্ষণ পরই এমভি আবদুল্লাহর চিফ অফিসার আতিকউল্লাহ খান ফেইসবুকে দুটি ছবি দিয়ে লেখেন, “ভালোবাসি বাংলাদেশ। আমার বাংলাদেশ।”
এমভি আবদুল্লাহর নাবিক আইনুল হকের ছোট ভাই মাইনুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সন্ধ্যার পর ভাইয়া ফোন করেছিল। উনারা এখন কুতুবদিয়ায় আছেন। কথা হয়েছে বেশি আম্মুর সাথে। আপনি বরং আম্মুর সাথেই কথা বলেন।”
আইনুল হকের মা লুৎফে আরা বেগমের কণ্ঠে ছেলে ঘরের ফেরার উচ্ছ্বাস স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছিল। তিনি বলেন, “কালকে ওদের সবাইকে একসাথে বন্দরে নিয়ে আসবে। সেখানে আমি যাব না, আমার আরেক ছেলে যাবে।
“ছেলে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হয়ে ঘরে ফিরছে। এরচেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই আমার কাছে। যখন তারা জিম্মি হয়েছিল তখন শুধু আল্লাহকে বলেছি, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও। আল্লাহর রহমত, আমার ছেলে ফিরেছে। কাল দেখা হবে।”
কর্ণফুলী থানার দক্ষিণ শাহ মিরপুর এলাকা নগরী থেকে কিছুটা দূরের হলেও নাবিক নুরুদ্দীনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস মঙ্গলবার আড়াই বছরের ছেলেকে নিয়ে যাবেন চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি জেটিতে স্বামীকে বরণ করতে।
টেলিফোন করতেই বেশ সপ্রতিভ হাসিতে নিজের আনন্দের কথা জানিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, “আমি খুব খুশি। পরিবারের সবাই আজ খুশি। আমার আড়াই বছরের ছেলেটা এত কিছু বোঝে না। কিন্তু টেলিফোনে বাবার গলা শুনলে পাপা পাপা করে। আজও সন্ধ্যায় টেলিফোনে বাবার কথা শুনছিল।
“কাল ওকেও সাথে করে নিয়ে যাব। সে তো আর জানে না, তার বাবা কি পরিস্থিতি থেকে ফিরে এসেছে।”
সোমালি জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত এমভি আবদুল্লাহ সোমবার সন্ধ্যায় কুতুবদিয়ায় নোঙর করেছে। সেখানে নোঙর করার পর সেটি থেকে পণ্য খালাসের কাজ শুরু হয়েছে।
এদিকে জাহাজে থাকা ২৩ নাবিক মঙ্গলবার চট্টগ্রামে ফিরবেন। তাদের জায়গায় জাহাজের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ২৩ জন নাবিকের আরেকটি দল সোমবার বিকেলে কুতুবদিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে।
নতুন ২৩ নাবিককে নিয়ে কুতুবদিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া জাহান মনি-৩ নামের ওই লাইটার জাহাজটিতে করে মঙ্গলবার এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিক চট্টগ্রামে ফিরবেন।
এমভি আবদুল্লাহ কুতুবদিয়া চ্যানেলে দুই দিন পণ্য খালাসের পর আবার চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে আসার কথা রয়েছে। সেখানে বাকি পণ্য খালাস করা হবে। ৫৬ হাজার মেট্রিক টন পাথর আছে ওই জাহাজে।
গত ১২ মার্চ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে দুবাই যাওয়ার পথে সোমালিয়া উপকূল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। অস্ত্রের মুখে জাহাজ ও ২৩ নাবিককে জিম্মি করে দস্যুরা।
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে ৩৩ দিন পার করার পর গত ১৩ এপ্রিল রাত ৩টার দিকে জলদস্যুরা জাহাজ ছেড়ে চলে যায়। এরপর দুবাইয়ের আল হামরিয়া বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় জাহাজটি।
এমভি আবদুল্লাহ শুরুতে যায় সংযুক্ত আর আমিরাতের আল-হামরিয়া বন্দরে। সেখানে জাহাজে থাকা কয়লা খালাস করা হয়। এরপর ওই বন্দরেই পণ্য লোডের পর মিনা সাকার বন্দরে যায় আবদুল্লাহ। সেখান থেকে আরব আমিরাতের ফুজাইরা বন্দরে থেমেছিল জ্বালানি নিতে। এরপর দুবাই থেকে ৩০ এপ্রিল রওনা হয় চট্টগ্রামের উদ্দেশে। বাংলাদেশের জলসীমার মধ্যে জাহাজ প্রবেশের খবর আসে বৃহস্পতিবার।
জিম্মি দশার দুই মাস পর দেশে ফিরছেন এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিক। জাহাজের ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আব্দুল রশিদ বলেছেন, নাবিক দলের সবাই সুস্থ আছেন। প্রিয়জনদের কাছে ফেরার জন্য উম্মুখ হয়ে আছেন তারা।
পুরনো খবর
জিম্মি নাবিকদের ছাড়াতে কত লাগল?
মুক্ত নাবিকদের ঘরে ‘ঈদের আনন্দ’
এমভি আবদুল্লাহ ও নাবিকরা মুক্ত
একসঙ্গে ঈদের নামাজ পড়লেন জিম্মি নাবিকরা, 'ভালো থাকার' বার্তা
এমভি আবদুল্লাহ: টাকা না দিলে ‘একজন একজন করে মেরে ফেলার’ হুমকি দিচ্ছে জলদস্যুরা
জলদস্যুর কবলে বাংলাদেশি জাহাজ ‘আবদুল্লাহ’, ২৩ নাবিক জিম্মি