Published : 12 Sep 2022, 11:11 PM
বেঁচে থাকার শেষ সময় পর্যন্ত লেখার মধ্যে থাকতে চেয়েছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। আর তার সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছে বলে জানালেন এই বরেণ্য গীতিকারের স্ত্রী জোহরা গাজী।
শিল্পকলা একাডেমিতে সোমবার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের স্মরণসভায় জোহরা গাজী জানালেন, মৃত্যুর আগের দিনও গান লিখেছেন তিনি।
“ও আমাকে রুনি বলে ডাকত। সে বলত, ‘রুনি আমি যতদিন বেঁচে থাকি, যেন লিখে যেতে পারি’। ওর সেই ইচ্ছাটা পূরণ হয়েছে। মৃত্যুর আগের দিন সে লিখেছিল, ‘সব নদীর ঢেউ বন্ধু/সমানতালে চলে না’। তরুণ সুরস্রষ্টা অপু তখন পাশে ছিল। অল্প সময়ে সেই লেখাটিতে সুর দিয়েছিল অপু।”
গীতিকবি সংঘ ও শিল্পকলা একাডেমির যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত এই স্মরণসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। সভাপতিত্ব করেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, সঞ্চালনা করেন সংগীতশিল্পী জয় শাহরিয়ার।
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের নামে স্মৃতি জাদুঘর এবং গানের স্কুল করার পরিকল্পনার কথা অনুষ্ঠানে তার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তার গানগুলো সংরক্ষণ এবং তার নামে স্থাপনার দাবি জানান গীতিকার-সংগীতশিল্পীরা। তার লেখা পাঠ্যপুস্তকে রাখার দাবি জানায় পরিবার।
২০ হাজারের বেশি গানের স্রষ্টা গাজী মাজহারুল আনোয়ার ৭৯ বছর বয়সে গত ৪ সেপ্টেম্বর পথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। চলচ্চিত্রের অনেক গানের পাশাপাশি ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘এক তারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’ এমন অনেক দেশাত্মবোধক গান এসেছিল তার লেখনীতে।
তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ অনুষ্ঠানে বলেন, “যতদিন বাংলা গান থাকবে, ততদিন তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। তার মৃত্যুটা আমার কাছে একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল।”
“তার আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল গানটা শুনলে এখনও আনমনা হয়ে পড়ি। অতীত তো বটেই, ভবিষ্যতের গীতিকারদের মাঝেও তিনি অমর হয়ে থাকবেন।”
গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে চিরবিদায়: ‘মাটির মানুষ’ ফিরে গেলেন মাটির কোলে
স্বাগত বক্তব্যে গীতিকবি সংঘের সাধারণ সম্পাদক আসিফ ইকবাল দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা গাজী মাজহারুল আনোয়ারের নামে করার অনুরোধ করেন। তার গানগুলো প্রযুক্তির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সংরক্ষণের দাবি জানান সঙ্গীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ।
গীতিকবি রফিকুজ্জামান বলেন, "আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ। এই অনুষ্ঠানটিতে আসার জন্য দিঠি (গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মেয়ে) মামনি ফোন করেছিল। আমার মনে হয়েছিল, যদি অ্যাম্বুলেন্সে করেও আসতে হয়, আমি এই অনুষ্ঠানে থাকব।”
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের গানে বাংলাদেশকে পাওয়া যেত মন্তব্য করে রফিকুজ্জামান বলেন, “পাকিস্তান আমলেও গাজী মাজহারুল আনোয়ার যে গান লিখেছে, সেখানেও বাংলাদেশের বাংলা গান পাওয়া যেত। মুক্তিযুদ্ধের সময় লিখেছে জয় বাংলা গানটি। সেই গানে লিখেছে হবে হবে হবে/হবে নিশ্চয়। কতটা প্রত্যয় নিয়ে এই ‘হবে’ শব্দটি লিখেছেন। সেটি অসাধারণ!”
বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ফাউন্ডেশনের সভাপতি গাজী আব্দুল হাকিম বলেন, গাজী মাজহারুল আনোয়ার যদি জীবনে শুধু ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি লিখতেন, আর কোনো গান না লিখলেও তিনি অমর হয়ে থাকতেন।
গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির বলেন, “দ্রুত গান লিখতে পারতেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। কোনো বিষয় জেনে, সেটি নিয়ে তিনি দ্রুত গান লিখতে পারতেন তিনি। এই গুণটি মনে হয় উপমহাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই।”
সংগীতশিল্পী খুরশীদ আলম বলেন, “গাজী মাজহারুল আনোয়ারের গানগুলো সংরক্ষণ করার জন্য আমিও অনুরোধ করবো। গুণী শিল্পীদের গানগুলো বিকৃত করবেন না। মূল কথা ও সুর ঠিক রেখে নতুন প্রজন্মকে গানগুলো করার জন্য আমার অনুরোধ থাকবে।”
সুরস্রষ্টা শেখ সাদী খান বলেন, “গাজী ভাইয়ের ৬০/৭০টা গান আমি করেছি। একজন গীতিকার একা সংগীত ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতেন না, যদি তিনি সুরস্রষ্টাদের সঙ্গে কাজ না করতেন। যখন লেখাটিতে সুর দেওয়া হয়, তখন সেটি গান হয়ে ওঠে। এজন্য গীতিকারদের সাথে সুরস্রষ্টাদেরও শ্রদ্ধা জানাই।”
সংগীতশিল্পী রফিকুল আলম বলেন, “মৌলিক গান লেখার লোক কমে গেছে। মৌলিক চিন্তা, কাব্যিকতা না হলে গান স্থায়িত্ব পায় না। গাজী ভাই যা লিখতেন, তাতে কাব্য ছিল এবং মৌলিকত্ব ছিল। গানের মধ্য দিয়ে রসিকতা করার লোকও গাজী মাজহারুল আনোয়ার ছাড়া আমাদের খুব বেশি গীতকার আসেননি।”
সংগীতশিল্পী আবিদা সুলতানা বলেন, “গাজী ভাই ছিলেন আমার অভিভাবক, বন্ধু এবং বড় ভাই। তিনি যেভাবে ভালোবাসতেন, সেটি ছিল আমার বাবার মতো। গাজী ভাই চলে যাওয়ায় আমার মাথার উপর থেকে ছাদ সরে গেল।”
সুরকার-সংগীতশিল্পী নকীব খান বলেন, “কিংবদন্তির কোনো মৃত্যু নাই। গাজী ভাই আমাদের হৃদয়ে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।”
পারিবারিক জীবনেও মাজহারুল আনোয়ার সফল ছিলেন জানিয়ে স্ত্রী জোহরা গাজী বলেন, “গাজী মাজহারুল আনোয়ার একটা ইতিহাস বাংলাদেশের জন্য। আমি ইতিহাসের একটু অংশ হতে পেরেছি। তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি সফল। আমি তার পারিবারিক জীবন নিয়ে বলব, তিনি সফল। আমি একটা আগুনের সাথে বসবাস করেছি। আমি চেষ্টা করেছি, সেই আগুনটাকে প্রজ্জ্বলিত রাখতে। দৃশ্যত সে নেই, কিন্তু সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে সে আছে।”
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ছোট বোন নাহিদা নাসরিন বলেন, “গাজী ভাই ছিলেন আমাদের পরিবারে বড় ছেলে, আর আমি সবার ছোট মেয়ে। বাবার আদর-স্নেহ পেয়েছি ভাইয়ের কাছ থেকে। বাবার শূন্যতা পূরণ করেছেন আমার ভাই।”
পাঠ্যপুস্তকে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা যুক্ত করার অনুরোধ করেন তার মেয়ে দিঠি আনোয়ার। সেই সাথে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের নামে স্মৃতি জাদুঘর করা এবং গানের স্কুল করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি। একাজে সরকারের সহায়তাও চান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে দিঠি আনোয়ার বলেন, “বাবা জীবদ্দশায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার পেয়েছেন, মৃত্যুর পরও তিনি সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই। তিনি বাবাকে জীবদ্দশায় স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়েছেন।"
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের গানগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “কাজটি তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধবকেই প্রাথমিকভাবে করতে হবে। শুধু গান নয়, চলচ্চিত্র নির্মাণেও তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। আমরা তার সৃষ্টিকর্ম সংরক্ষণ করব।”