Published : 27 Dec 2023, 12:57 PM
মহল্লার নাম ‘হেঁতেম খাঁ’। এই নামে এক ডাকাত বাস করতো এখানে, যার ভয়ে থর থর করে কাঁপতো লোকজন। ভয়ঙ্কর এই ডাকাতের নামেই নামকরণ হয় মহল্লার। তবে হেঁতেম খাঁ এলাকার নাম যে এক ডাকাতের নামে তা অনেকেরই অজানা। অনেক অনেক বছর আগের কথা তো!
নাহ, এখন তার গল্প বলছি না। তার গল্প হবে আরেকদিন। এতটুকু বলেই থেমে গেলেন আশেকীন স্যার। ক্লাস ভরা ছাত্র-ছাত্রী। সবাই চেয়ে আছে স্যারের দিকে। ‘তাহলে কোন গল্প শোনাবেন স্যার। আর হেঁতেম খাঁর কথাই বা কেনো বললেন?’ স্যারের উদ্দেশে এমনই এক প্রশ্ন ছুড়ে দেয় পরি।
কারণ তো নিশ্চয় আছে। একটু পরই ঠিক বুঝতে পারবে সবাই। স্যার বললেন, ‘গল্পটা এই হেঁতেম খাঁ মহল্লার। এখন এখানে যেমন বড় বড় দালান দেখছো, তেমনটা ছিলো না সেই সময়। এটা ছিলো একটা ছোট্ট গ্রাম। আর গ্রামের চারপাশ জুড়ে ছিলো বিশাল বড় জঙ্গল। চারদিকটা ছিলো প্রচুর গাছ-গাছালিতে ঘেরা। এই জঙ্গলে বসবাস করতো অনেক বন্যপ্রাণী। হরহামেশা দেখা যেতো বাঘ, শেয়াল, বেজি, বনবিড়াল, নানা প্রজাতির বিষাক্ত সাপ, বনমোরগসহ আরও অনেক জন্তু-জানোয়ার।
সন্ধ্যা নামলেই নীরব হয়ে যেতো পথঘাট। ছিলো ডাকাতের কবলে পড়ার ভয়। আর ছিলো বাঘের ভয়। একা কোনো মানুষ রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেই পড়তো বাঘের খপ্পরে। অনেক মানুষের মৃতদেহ পাওয়া গেছে এই পথের ধারে। গলার রগ ছিঁড়ে রক্ত পান করে পালিয়ে যেতো বাঘ। শরীরের নানা অংশ ছিঁড়ে কুড়ে খেয়ে ফেলত। বাঘের উৎপাতে গ্রামের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। সবাই মুক্তি পেতে চাইছে এই বাঘের খপ্পর থেকে।
সেই সময় এক তুলকালাম ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো আজমল করিম নামের এক পাগল, ‘পাগলা কাকু’ নামেই গ্রামে পরিচিত ছিলো সে। ছোটরা তাকে ‘পাগলা কাকু’ নামে ডাকতো। পথে দেখা হয়ে গেলে ‘পাগলা কাকু’ বলে ডাকতাম আমরাও। তিনি সাড়া দিতেন। কাছে ডাকলে আসতেন। কখনো কখনো বাড়ি থেকে গুড় মুড়ি এনে তাকে খেতে দিতাম। উনি বেশ মজা করেই খেতেন। খাওয়া শেষ হলে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন দূরে।
বিকেলে খেলাধুলা শেষ করে সন্ধ্যা নামার আগে আগে আমরা যখন হুড়োহুড়ি করে বাড়ির দিকে ছুটতাম সেই সময়ও তাকে দেখতাম নির্ভয়ে এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন। পাগলদের মনে হয় কোনো আর ভয় লাগে না। আমরা বাঘের ভয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। আর উনি কিনা একা একা আজগুবি কথা বলতে বলতে এগিয়ে যেতেন। তাকে দেখতেও বেশ অদ্ভুত লাগতো। মাথায় বড় বড় চুল। গালভরা জঙ্গলের মতো দাড়ি। ময়লা জামা কাপড় পরে থাকে সব সময়। কখনো কখনো গায়ে চট জড়িয়েও ঘুরে বেড়াতে দেখা যেতো।
সবাই যখন কাছে এসে পৌঁছালো তখন দেখা গেলো এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। একটা নয়। তিনটা গেছো বাঘ একসঙ্গে আক্রমণ করেছে পাগলা কাকুর উপর।
গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা খড়ের ঘরে ঘুমাতো পাগলা কাকু। গ্রামের মানুষ ডেকে ডেকে খাবার খেতে দিতো তাকে। এভাবেই জীবন চলতো তার। একদিন এই পাগলা কাকু পড়লো বাঘের খপ্পরে। সন্ধ্যা তখন ঘনিয়ে এসেছে। চারদিক আলো অন্ধকার মিশানো। এমন সময় একটা চিৎকার শোনা গেলো।
‘বাঘ বাঘ।’
‘আমাকে বাঘে খেয়ে ফেললো।’
‘বাঁচাও বাঁচাও।’
আশেকীন স্যার গল্প বলে চলেছেন। তার দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে তার ক্লাসের ছাত্র ছাত্রীরা। স্যারের চোখে মুখেও আতঙ্ক ঝরে পড়ছে। সবাই শোনার জন্য অপেক্ষা করছে এরপর কী হতে চলেছে। স্যার বললেন, আজ থাক। বাকি গল্পটা আরেকদিন বলবো। আর কারো তর সইছে না। আর স্যার এমন সময়ই এসে গল্প থামিয়ে দেন। এর আগেও অনেকবার গল্প বলতে বলতে এই কাণ্ড করেছেন তিনি। গল্প জমিয়ে দিয়ে থেমে যান।
নাহ, পরি আর বসে থাকতে পারলো না। উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। বললো, প্লিজ স্যার এমন করবেন না। বলেন না তারপর কী ঘটলো! আহারে নিরীহ বেচারা পাগলটাও কিনা শেষে বাঘের মুখে পড়লো। স্যার বললেন, ‘থামবি তোরা। কতক্ষণ থেকে গল্প বলছি। একটা পান খেয়ে নিই। পকেট থেকে পান বের করে মুখে পুরে চিবুতে শুরু করলেন তিনি।’ তারপর গল্প বলতে শুরু করলেন আবারও।
বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে গেলো গ্রামের মানুষ। বুঝতে আর বাকি রইলো না। আবারও কেউ বাঘের কাছে জমা পড়েছে। লাঠি, খুন্তি নিয়ে তেড়ে আসলো গ্রামের একদল মানুষ। ছুটতে ছুটতে একজন বলে উঠলো, ‘আজ বাঘের মুখে যে পড়েছে তাকে বাঁচাতেই হবে।’ আরেকজন বলে উঠলো, ‘আজ বাঘের একদিন কি আমাদের একদিন। বাঘ যত বড়ই হোক না কেনো তার নিস্তার নেই। বাঘ মেরে ওর চামড়া দিয়ে জুতো বানাবো।’ গ্রামের মানুষদের আসতে বেশ সময়ই লাগলো। চিৎকার তখনও থামেনি। দূর থেকেই শোনা যাচ্ছে। বাঘ এসেছে। বাঘ... বাঘ...আমাকে খেয়ে ফেললো গো। বাঁচাও বাঁচাও।
সবাই যখন কাছে এসে পৌঁছালো তখন দেখা গেলো এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। একটা নয়। তিনটা গেছো বাঘ একসঙ্গে আক্রমণ করেছে পাগলা কাকুর উপর। একটা বড় বাঘকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে ভয়ে লাফাচ্ছেন তিনি। এই বাঘটা সম্ভবত তার গলায় দাঁত বসানোর চেষ্টা করছে। বাঁচার জন্য প্রাণপণ লড়াই করে চলেছেন কাকু। আশেকীন স্যার বলতে থাকেন, ‘আমি ভাবছি। বাঘটা এতক্ষণে কাকুর গলায় দাঁত বসিয়ে দিয়েছে কিনা। এমন সময় চোখে পড়লো পাগলা কাকুর শাদা কালো দাড়িতে ছোপ ছোপ রক্ত। আর বাকি দুইটা বাঘ কাকুর পায়ে কামড় বসানোর চেষ্টা করছে।
অনেকক্ষণ চললো বাঘের সঙ্গে পাগলা কাকুর লড়াই। তারপর কাটা কলাগাছের মতো শব্দ করে মাটির উপর লুটিয়ে পড়লো কাকুর দেহটা। ততক্ষণে সেখানে পৌঁছে গেছে গ্রামের মানুষ। লাঠিশোটা নিয়ে এত মানুষকে একসঙ্গে আসতে দেখে ভয়ে পালিয়ে যায় দুটো বাঘ। দেখা যায় একটা বাঘ বুকে জড়িয়ে ধরে পড়ে আছেন কাকু। তার কোনো নড়াচড়া নেই। একি লোকটা কি মারা গেলো! বললো একজন। আরেকজন বললো, নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখতে হবে নিঃশ্বাস চলছে কিনা।
পাগলা কাকু কাউকে দেখলেই শুধু বলতে থাকে ‘বাঘ মেরেছি, বাঘ মেরেছি।’ আর বিকট সুরে হো হো করে হাসতে থাকে।
কিন্তু বাঘটা এখনো রক্ত খাচ্ছে? এ বেটা কি রক্ত খেতে খেতে বেহুশ হয়ে গেছে। এত মানুষ দেখেও পালাচ্ছে না কেনো!এ কসঙ্গে কয়েকজন ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘটার উপর। তারপর পাগলা কাকুর হাতদুটো দুই দিকে সরিয়ে ছাড়িয়ে আনা হলো বাঘটাকে। তারপর যে দৃশ্য দেখা গেলো তা দেখে সবাই অবাক। চেপে ধরে বাঘটাকে প্রায় ভর্তা বানিয়ে ফেলেছেন কাকু। ও আর জ্যান্ত নেই। একজন বলে উঠলো, এমন ঘটনার কথা জীবনেও শুনিনি। বন্দুক দিয়ে বাঘ শিকার করে শুনেছি। দুই হাত দিয়ে বুকের সঙ্গে চেপে ধরেও বাঘকে মেরে ফেলা যায়! এই ঘটনা জীবনের প্রথম দেখলাম! পাগলের দেহে শক্তি আছে বলতে হবে।
পাগলের কথা বলতেই সবাই তাকালো পাগলা কাকুর দিকে। নাহ। বাঘটার মতই নিথর হয়ে পড়ে আছে কাকু। একজন নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখলো। কোনো কিছুই ঠিক বোঝা গেলো না। সবাই চিন্তিত তাহলে কী বাঘের সঙ্গে সঙ্গে উনিও মারা গেছেন। বেশ আতঙ্ক নিয়ে একজন বুকের মধ্যে কান লাগিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো। লাফ দিয়ে উঠে বললো প্রাণ আছে মনে হচ্ছে। রক্তে সারা শরীর মাখামাখি হয়ে গেছে। দেখ দেখ গলা ফুটো করে দিয়েছে কিনা। এই কথা বলে উঠলো পাশের জন। দেখা গেলো গলা ফুটো করতে পারেনি বাঘটা। তবে ঘাড়ের এক অংশের মাংস ছিঁড়ে ফেলেছে। বুকেও দেখা গেলো নখের আঁচড়। একজন চোখে মুখে পানি ছিটাতে শুরু করলো।
পানির ছিটা দিতেই চোখ মেললো কাকু। সবাই ধরাধরি করে তাকে দাঁড় করালো। তার ক্ষতস্থানগুলোতে দুর্বাঘাসের রস লাগিয়ে দেওয়া হলো। জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গে পাগলা কাকু চিৎকার করতে শুরু করলেন, ‘আমাকে বাঘে খেয়ে ফেললো গো। বাঘ বাঘ...’ একজন বলে উঠলো, ‘না কাকু তোমাকে বাঘে খায়নি, বরং তুমিই একটা বাঘকে মেরে ফেলেছো। ওই যে দেখো কতো বড় বাঘটা তোমার সামনে পড়ে আছে।’ পাগলা কাকু তার সামনের মৃত বাঘটাকে দেখেই খুশিতে লাফ দিয়ে ওঠে। তারপর বলতে থাকে, ‘এই যে দেখো আমি একটা বাঘ মেরেছি। হই হই আমি একটা বাঘ মেরেছি।’ বাঘ মেরেছি বাঘ মেরেছি বলেই সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে পাগলা কাকু। পাগলের কাণ্ড দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। রক্তমাখা কাপড় পরেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবার চোখের আড়ালে চলে যান।
শোনা যায় এই ঘটনার পর থেকেই হেঁতেম খাঁ গ্রামে বাঘের উৎপাত কমে যায়। কেউ কেউ বলে পাগলা কাকুর ভয়েই নাকি এই জঙ্গলের বাঘগুলো সব পালিয়ে গেছে। পাগলা কাকু কাউকে দেখলেই শুধু বলতে থাকে ‘বাঘ মেরেছি, বাঘ মেরেছি।’ আর বিকট সুরে হো হো করে হাসতে থাকে। তাকে পথ দিয়ে হাঁটতে দেখলেই লোকেরা বলে, ‘ওই যে দেখো বাঘের যম আসছে।’