Published : 07 Sep 2013, 09:19 PM
[ শিশুদের খবর প্রকাশে নীতিমালা প্রণয়নের জন্য সংবাদমাধ্যমের প্রতি আহবান জানিয়েছেন শীর্ষ শিশু অধিকার কর্মীরা। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম আয়োজিত সাম্প্রতিক এক আলোচনায় পুলিশকন্যা ঐশীর ঘটনার প্রেক্ষাপটসহ সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে নানামত উঠে এসেছে ।
আলোচক: ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক, মনোবিদ ও কথাসাহিত্যিক। আফসান চৌধুরী, সাংবাদিক ও শিশু অধিকার কর্মী। বেবী মওদুদ এমপি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সদস্য, লেখক ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স এডিটর। ইউএম হাবিবুন নিসা, আইনজীবী, শিশু অধিকার কর্মী। ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি, এমপি ও আইনজীবী। ফরিদা আকতার মনোরোগ পরামর্শক। শেবা তাসমিন হক, শিক্ষক ও সাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট জজ। শাকিল ফয়জুল্লাহ, ইউনিসেফের কমিউকেশন স্পেশালিস্ট। সামিন ইয়াসার প্রিয়ম, হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের শিশু সাংবাদিক। ]
সঞ্চালক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু: আজকে আমরা একটি আলোচনায় বসেছি; যা আমরা অভিহিত করেছি– 'সংবাদে ঐশী: পুলিশ ও গণমাধ্যমের ভূমিকা' এই শিরোনামে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া চরিত্রের দিক থেকে ভয়ঙ্কর হৃদয়বিদারক এবং সমাজে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী একটি ঘটনা এবং সেই ঘটনায় গণমাধ্যম এবং পুলিশ কী করছে, কীভাবে করছে এবং তাদের আচরণ কী এটাই আমাদের মূল আলোচ্য বিষয়।
পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমান দুজনেই নিজেস্ব ফ্ল্যাটে খুন হয়েছেন। তাদের মৃতদেহ তাদের শয়নকক্ষে পাওয়া গেছে ১১ আগস্ট। এরপর পুলিশ দ্রুতই নিহত দম্পতির কিশোরীকন্যাকে গ্রেপ্তার করে; সেই সঙ্গে ওই বাড়ির কিশোরী গৃহপরিচারিকা এবং পুলিশকন্যার একজন বন্ধুকেও। তারা এখন পুলিশ কাস্টডিতে রয়েছে। কিন্তু প্রথমেই পুলিশ সন্দেহভাজন বা এই খুনের সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশকন্যাকে সমাজের সামনে পরিচয় করিয়ে দেয়।
আমরা সংবাদ মাধ্যমে যে ধরনের খবর পরিবেশিত হতে দেখি, তাতে সমাজে অনেকগুলো প্রশ্ন উঠেছে। বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে এবং অনেকগুলো জিজ্ঞাসা সামনে চলে এসেছে। এই সংবাদ পরিবেশনের ধরন ও প্রকৃতি কী, সেখানে সংশ্লিষ্ট আইন বা ঘটনাটির সঙ্গে জড়িত যে সংবেদনশীলতা, এর সঙ্গে জড়িত যে শিশু, তাদের কীভাবে তুলে ধরা হল না হল– এ বিষয়ে প্রশ্নগুলো উঠেছে।
পুলিশ তাদের প্রথমেই তাদের জনসমক্ষে হাজির করেছে, আদালতে নিয়ে গেছে, রিমান্ড চেয়েছে এবং আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। এখানে যে আইনের প্রশ্নগুলো উঠেছে, ইতোমধ্যে মিডিয়াতেও সেগুলো প্রকাশ পেয়েছে যে সাংবাদিক এবং পুলিশরা আইনের সীমানা লঙ্ঘন করেছেন কি না; সামাজিক রুচি বা সংবেদনশীলতার সীমারেখাটা লঙ্ঘন করেছেন কি না।
আফসান চৌধুরী: বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো বা গণমাধ্যম যে খুব দায়িত্বশীল এটা আমরা কেউ বলব না। যারা কাজ করি আমরা নিজেরাও তা বলব না। গত কয়েক বছরে যেহেতু সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে কম্পিটিশন বেড়েছে, তাতে দায়িত্ববোধটা তুলনামূলকভাবে কমেছে।
সমস্যাটা হচ্ছে, আমাদের যদি কোনো নীতিমালা বানানো হয় যা সাংবাদিকদের মানতে হবে, তাহলে দেখা যাবে যে মালিকপক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি চাপটা আসছে– এই নিয়মটা মানার দরকার নেই বা নিয়মটা মানলে পত্রিকার জন্য অসুবিধা হবে, পত্রিকার কাটতি কমে যাবে।
টেলিভিশনের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি প্রযোজ্য। ওখানে টিআরপি রেটিং বলে একটি কথা আছে, বিজ্ঞাপন আসবে না যদি এ ধরনের নিউজ না করি।
দ্বিতীয়ত, আমাদের সাংবাদিকদের নিজস্ব সচেতনতাবোধ অত্যন্ত কম। আমি এ কারণে বলছি, যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছিল, আপনারা দেখেছেন, গণমাধ্যম প্রায় প্রতিটি আইন লঙ্ঘন করেছে। গণমাধ্যমকর্মীরা মনে করেছে তারা হচ্ছে শাহবাগের অংশ। সেই সঙ্গে তারা মাথায় পট্টি বেঁধে শ্লোগান দিয়েছে।
পৃথিবীর কোনো জায়গায় যখন এ প্রশ্নটা ওঠে যে গণমাধ্যম কি তাহলে নিরপেক্ষ? গণমাধ্যম কি তাহলে যে কোনো বিষয়ে এমন একটা অবস্থান নিতে পারবে যেটা তার স্বার্থের সঙ্গে জড়িত নয়? সে স্বার্থ অর্থের স্বার্থ নয়, তার ভাবনার স্বার্থও হতে পারে। আমরা দেখেছি যে, গণমাধ্যমই গালাগালি করে বলেছে- "না! এটা হচ্ছে আমাদের একটা জাতীয় বিষয়।"
কিন্তু আমাদের সমাজে দুটো অংশ আছে, যাদের সবকিছুর উপরে থাকতে হয়। একটা হচ্ছে বিচার ব্যবস্থা। বিচার ব্যবস্থা কোনোভাবেই কোনো বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে না। এটা তাদের শপথনামার মধ্যে লেখা আছে। আরেকটা হচ্ছে গণমাধ্যম। গণমাধ্যম যদি প্রভাবিত হয়ে পড়ে তাহলে কোনোদিনই সঠিক তথ্য দেবে না।
এই ক্ষেত্রে, আপনি দেখবেন, যে কথাটা সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডর সময় থেকে বলা হচ্ছে, "গণমাধ্যম তো বাচ্চার চেহারা বা ছবি দেখাতে পারে না।" এটা কেউ না কেউ ওই গণমাধ্যমে থাকবে যে বলবে, "বাচ্চার ছবি দেখাতে পারে না।" এমনকি বিডিনিউজ সম্পর্কেও তখন বলা হয়েছিল যে জিনিসটা লঙ্ঘিত হচ্ছে। আমি তখন বিডিনিউজে চাকরি করতাম। এইবার আমি প্রথম দেখলাম কিছু কিছু জায়গায় মুখটাকে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি জানি না, তার বয়স যদি ১৮ হয় তাহলে কী মুখ ঢাকা যাবে না?
আমার মনে হয়, আমাদের দায়িত্ববোধটা জানাবার মতো কোনো প্রক্রিয়া নেই। দায়িত্বটা পালন করার মতো আমাদের কোনো মোটিভেশন নেই। যারা সাংবাদিকতায় প্রবেশ করি আমরা জানিও না যে আমাদের নীতিমালার মধ্যে কাজ করতে হয়। আমার ধারণা আমাদের দেশে রাজনীতিতে বলেন, অর্থনীতিতে বলেন, কোনো জায়গায় খুব একটা প্রতিষ্ঠিত নীতিমালা নেই। আমরা কেউ কোনো নীতিমালার অধীনে চলি না।
সাংবাদিক হিসেবে আমি কেন নীতিমালার অধীনে চলব যদি অন্যরা না চলে? এই সংকট কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীণ এবং আমাদের ভেতরকার যেমন আমাদের বাইরেরও তেমন, দেশ-সমাজের সংকট। আমার মতে, বাংলাদেশে নীতিমালা বানাতে গেলে আমরা সাধারণত উকিল ডাকি, বিচারকদের ডাকি, বিশেষ করে প্রাক্তন বিচারকদের। এখন প্রাক্তনের সংখ্যাও বেশি। কিন্তু আমরা যদি সিদ্ধান্ত নিই যে আমরা সাংবাদিকরাই ঠিক করব– আমরা এই নীতিমালা মানব, কেবল তখনই আমরা তা মানব। আমার মনে হয় সাংবাদিকদের তৈরি একটা নীতিমালা দরকার– আমরা এই নিয়মগুলো মানব, এই নিয়মগুলো মানব না।
শেষ করছি একটা কথা দিয়ে, আমাদের ঘনিষ্ঠ মানুষ মিতি আপা একটা লেখা লিখেছেন যে "রগরগে করার অধিকার কারও নেই। রগরগে করবেন না। বিষয়টা অত্যন্ত মর্মান্তিক।" এই মর্মান্তিক একটা বিষয়কে রগরগে বা সুড়সুড়িওয়ালা সংবাদে পরিণত করার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে; আমাদের লজ্জাটাও এই কারণে।
মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু : নীতিমালার প্রশ্ন উঠেছে, একটা প্রশ্ন কি আমরা তুলতে পারি যে সাগর-রুনির ক্ষেত্রে যে তাদের বাচ্চাটা এবং ঐশীর ক্ষেত্রে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, এইগুলো সংবাদ পরিবেশনের ব্যাপারটি কি সাংবাদিক বা সম্পাদকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিনির্ভর? সর্বজনগ্রাহ্য এবং মেনে চলার মতো নীতিমালা কে কোথায় তৈরি করবে? আর ব্যক্তিগত দৃষ্টিনির্ভর না হলে এটার কোনো আইনের বিধান আছে কি না?
আফসান চৌধুরী : সরকারের নীতিমালা ভাঙতে, আইনের নীতিমালা ভাঙতে আমাদের চেয়ে যোগ্য খুব কম মানুষ আছে। আমরা আইন ভাঙবই, এটা আমাদের জাতীয় ধর্ম। কিন্তু আমার মনে হয়, যদি সরকার নীতিমালা বানায় যেটা মঞ্জু ভাই বলছেন বা কেউ যদি বানায়, আমরা ভাঙলে আমাদের পানিশ করবে কে? কোন আইনের মধ্যে পড়বে?
আমাদের বাংলাদেশে প্রেস কাউন্সিল আছে। প্রেস কাউন্সিলের মামলা করে ওগুলো তো বন্ধ করা উচিত ছিল। প্রেস কাউন্সিলকে কেউ পাত্তা দেয়? কেউ প্রেস কাউন্সিলকে পাত্তা দেয় না। যাদের প্রেস কাউন্সিলে নিয়োগ করা হয়, তাদের কেউ শ্রদ্ধা করে না। এ অবস্থার মধ্যে আমরা যদি নিজেরা সিদ্ধান্ত নিই যে আমরা আইনগুলো মানব তাহলেই কেবল আমরা তা মানব।
আমার মনে হয় না বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সামনে যারা নীতিমালা বানান, তাদের শ্রদ্ধা করবেন এমন লোক নেই। যারা নীতিমালা বানান, তাদের আমরা শ্রদ্ধা করি না, নীতিমালাকেও শ্রদ্ধা করি না। এটা যখন অবস্থা হয়, আমার মনে হয় আমরা নিজেরা যদি বলি, "না ভাই, আমরা এগুলো মেনে চলব।" আমরা কী বলব? আমি 'প্রথম আলো', আমি এটা মানব, আর 'যুগান্তর' মানল না। তাহলে আমার তো ব্যবসায় অসুবিধা হবে।
তার চেয়ে, বড় বড় অন্তত ৫০-৬০টা, সবাই মিলে যদি আমরা বলি নীতিমালা করলাম, বাচ্চাদের ব্যাপারে। বড়দের ব্যাপারে কী দেখাব না দেখাব এটা অন্য কথা। কিন্তু আমরা যদি সিদ্ধান্ত নিই বাচ্চাদের ব্যাপারে নীতিমালা মানব তাহলে কেবলমাত্র সম্ভব। আমি একেবারে ১৯৭২ সাল থেকে হিউম্যান রাইটস আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। আমরা কোনো নিয়ম-টিয়ম মানি না। নিজেদের নিয়ম ছাড়া আমরা কোনো নিয়মকে শ্রদ্ধা করি না, মানিও না।
মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু : আমাদের দেশে প্রেস কাউন্সিলের একটা নীতিমালা আছে। আর আন্তর্জাতিকভাবে তো সাংবাদিকতার নীতিমালা আছে। কিন্তু আইনের কোনো বিধিনিষেধ আছে কি না? শিশু, যারা জড়িত, ভিকটিম হতে পারে এবং অপরাধ সংঘটনকারী হতে পারে…
ইউএম হাবিবুন নিসা: খুব পরিষ্কারভাবে আইনে উল্লেখ করা আছে। আমার মনে হয় যে আমি আফসান ভাইয়ের সঙ্গে অনেকখানি একমত। কিন্তু আবার দু-একটা জায়গায় মনে হচ্ছে আপনি যেটা বলছিলেন সেখানে একটা বিষয় আমাদের মাথায় আনতে হবে– দায়বদ্ধতা এবং দায়িত্বশীলতার একটা বিষয় রয়েছে। আমি আপনার সঙ্গে পুরোপুরি একমত যে আমরা কাউকে শ্রদ্ধা করি না।
মোটিভেশন যাই থাকুক, প্রেস কাউন্সিল পছন্দ করি আর না করি, কিন্তু যদি আইনের শাসন থাকে তাহলে শ্রদ্ধা আপনি ভেতরে করেন কি না করেন আপনাকে এটা ফলো করতে হবে। প্রবলেমটা কিন্তু ওখানে, সেটার জন্য অনেকগুলো বিষয় আলোচনার দাবি রাখে।
সঞ্চালকের সরাসরি প্রশ্নটা ছিল যে আইডেনটিটি প্রকাশ করা। এটা সম্পর্কে কোনো আইনি বিধান আছে কি না? খুব পরিষ্কার করে আইনে আছে– ১৯৭৪ সালে শিশু আইনেও ছিল– ২০১৩-তেও আছে।
কিন্তু তার আগেও যদি আমি ফেরত যাই, আপনি যদি ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমটা দেখেন। শিশুর এবং বয়স্কদের জাস্টিস সিস্টেম আমরা গুলিয়ে ফেলেছি। এটা হল আমাদের প্রথম ভুল। ফলে আমাদের আচরণের মধ্যে একটা সাধারণত্ব চলে আসছে। আমরা পার্থক্যটা করছি না– আমি বড়দের সঙ্গে কী আচরণ করব আর যারা বড় না তাদের সঙ্গে কী আচরণ করব।
এখন স্ট্যান্ডার্ড হল ১৮ বছর। চেহারা দেখে ১৮ ঠিক করব নাকি ফরেনসিকে যাব? এটা ডিবেট তৈরি করে। আমরা যদি মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি– একজন যদি দাগী খুনিও হয়, ১০টা খুন করে এসেছে, আপনি কি তাকে ক্যামেরার সামনে এক্সপোজ করতে পারেন? পারেন না।
কারণ মডার্ন রাষ্ট্রের পলিটিক্যাল সায়েন্স যারা পড়েন, তারা আরও ভালো করে বলবেন, লইয়ার হিসেবে আমার সামান্য জ্ঞান থেকে আমি বলতে পারি এবং মানবাধিকারকর্মী হিসেবে বলতে পারি যে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে সবসময় কারেকশন করা; রাষ্ট্রের দায়িত্ব পানিশমেন্ট দেওয়া নয়। পানিশমেন্ট আসবে তাকে কারেক্ট করার জন্য। শাস্তি দিয়ে সুখভোগ করার জন্য নয়, সুখবোধ করার জন্য নয়।
আমি বোঝাতে পারছি কি না জানি না। আমাদের জজ সাহেবরা, আমাদের সাংবাদিক ভাইয়েরা যখন দেখেন যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, আত্মীয়-স্বজনদের সামনে মাইক্রোফোনটা ধরে– 'আপনার কেমন লাগছে', এত ভুল একটা জিনিস আমরা করি। ওই মানুষটা যে হারিয়েছে তার স্বজন, আরেকজনের শাস্তি হলে তার ভালো লাগবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সে হয়তো সাময়িক প্রশান্তি পেতে পারে– 'যাক বিচার পাইছি'– কিন্তু যে হারিয়েছে, সে তো হারিয়েছেই, তাই না?
পাশাপাশি আমরা কী করছি, সোসাইটিতে আরেকটি অশান্তি তৈরি করছি। যাকে শাস্তিটা দেওয়া হল তার স্বজনরা ভাবছে, 'আমার ভাই, আমার বোন, আমার মা তো অপরাধটা করেনি, অথচ তুমি শান্তি পাচ্ছ, এখন ঠিক আছে আমি দেখে নিব।' এই যে প্রতিহিংসার বীজ বপন করছি– এটা হল একটা দিক। আরেকটি দিক হল, ওই মানুষটিকে তার বিচারের আগেই এক্সপোজ করে দিলেন, এই মানুষটার সংশোধনের সুযোগটা আর কই? তার সবকিছুই তো আমরা মেরে ফেললাম। মানবাধিকারের দৃষ্টিতে এটা একটা অপরাধ।
শিশুর বেলায় বলা আছে, তার কোনো আইডেনটিটি প্রকাশ করা যাবে না। সে যদি অপরাধের শিকার হয়, তাহলেও হবে না। আপনারা সাগর-রুনির বাচ্চার কথা বলছেন, আরেকটা বলা হচ্ছে এখন ঐশী। যদিও এখন আমরা জানি ১৯, কেউ বলছে ১৮, কেউ বলছে ১৭।
রাষ্ট্রের অবস্থানটা দেখি– আমাদের মূল ফিলোসোফি কোন জায়গায়? 'রাষ্ট্রের একটি মানুষও শাস্তি পাবে না অন্যায়ভাবে। একটি মানুষেরও ক্ষতি হবে না অন্যায়ভাবে।' অন্যায়-ন্যায় বিষয় না, ক্ষতি হবে না। সেটি যদি আমাদের মূল অবজেকটিভ থাকে তাহলে এই মানুষটা সবকিছুর সিদ্ধান্তের পরে যখন আমি দেখব সে অপরাধ করেই ফেলেছে, ইভেন ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের মূল কথা, 'পেছনের কারণটা খুঁজে বের করো এবং তাকে কারেকশনে পাঠাও।'
এই যে জেল এন্ড প্রিজন সিস্টেম এটারও দুইটা পরিষ্কার ফিলোসফি আছে, তাকে কারেকশনে পাঠাও। আমাদের চারটা প্রিন্সিপালের একটা হচ্ছে– কারেকটিভ মেজার্স। খুব সংক্ষেপে যদি আমি বলতে চাই, কোনো মানুষের মানবাধিকার বা জন্মগতভাবে সে তার মর্যাদা পাওয়ার যে অধিকার তা খর্ব করার অধিকার কারও নেই।
মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু : বিচারের দার্শনিক বিষয়ে কারেকশনের প্রশ্ন আসতে পারে। কিন্তু আমরা আজকের আলোচনা থেকে জানতে চাই যে, আইডেনটিটি প্রকাশ করে অথবা বয়স নিরূপণের ক্ষেত্রে ফরেনসিক টেস্টে পাঠিয়ে সংবাদ মাধ্যম এবং পুলিশ আইন লঙ্ঘন করেছে কিনা? রিমান্ড দিয়ে আইন লঙ্ঘন করেছে কি না? করে থাকলে কেন হচ্ছে এটা?
ইউএম হাবিবুন নিসা : সে শিশু কি না সেটা পরীক্ষা করার জন্য যদি কোনো আবেদন করা হয়, সেই আবেদনটির জন্য অপেক্ষা করাটাই কিন্তু সমীচীন এবং যুক্তিযুক্ত বলে আইন তাই মনে করে।
মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু : আমি একটু সাহায্য করি, আইনে রয়েছে বয়স নিরূপণ করতে হবে জন্ম নিবন্ধন, জন্ম নিবন্ধন না থাকলে স্কুলের সার্টিফিকেট, সার্টিফিকেট না থাকলে ভর্তির …
ইউএম হাবিবুন নিসা : স্কুল সার্টিফিকেট ঠিক, জন্ম নিবন্ধন যেটি, রেজিস্ট্রেশন যেটি আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য। এখন স্কুল সার্টিফিকেটে তো যে কোনোভাবেই বয়স কমিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, বয়স বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। আমরা সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। যেহেতু ফরেনসিক বিভাগে তার বয়স নিরূপণের জন্য পাঠানো হয়েছে তো রিপোর্টটা না আসা পর্যন্ত– এটা একটা প্রক্রিয়া যে– অপেক্ষা করতে হবে। আইন তাই বলে।
মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু : আমরা বুঝলাম যে ফরেনসিক রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তার আগে যখন ঘটনাটা ঘটেছে, যেদিন আদালতে নেওয়া হয়েছে এবং রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়েছে সেইদিন হতে তার বয়সের ডকুমেন্টের এভিডেন্স কী ছিল, স্কুলের ছিল, সেটি বিবেচনার ক্ষেত্রে …
ইউএম হাবিবুন নিসা : বিবেচনা করবেন কি না, সেটি বিচারকের উপর নির্ভর করে। তবে সেই স্কুল সার্টিফিকেটে যে বয়স ছিল, সেটি বিবেচনায় নেবেন কি না, সেটি যদি রেজিস্ট্রি করা হত, জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি যেভাবে হয়, দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, সেটি সিটি করপোরেশন আর ঢাকার বাইরে হলে পৌরসভা কিংবা সেখান থেকে যদি বিধিবদ্ধভাবে হত, তাহলে সেটি গ্রহণযোগ্য।
স্কুল সার্টিফিকেটের বয়সটি গ্রহণযোগ্য হবে কি না সেটি পরিবেশ-পরিস্থিতি-পারিপার্শ্বিকতা বলবে। আর সেটি গ্রহণযোগ্য হয়নি বলেই কিন্তু তাকে ফরেনসিকে পাঠানো হয়েছে। আইনজীবী হিসেবে আমি আমার এ বক্তব্যটুকু দিচ্ছি।
মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু : আমি একটু যোগ করি, আইনের কিন্তু বিধান রয়েছে সার্টিফিকেট বা ডকুমেন্টারি এভিডেন্স প্রডিউস করার। আরেকটি হচ্ছে, আমি জানি না যে এ বিষয়টি আছে কি না, ফরেনসিক টেস্টে নির্দিষ্টভাবে বয়সটি নিরূপণ করা যায় কি না– এত দিন এত মাস…
ইউএম হাবিবুন নিসা: আমি অনেক ফরেনসিক অভিজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে কাজ করেছি। উনারা প্রত্যেকেই যেটি বলেন, সুনির্দিষ্ট করে উনারা বলতে পারেন না। এক বছর, ৯ মাস, ১০ মাস এ রকম তারতম্য হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ১৮, ১৮-রও আগে।
আপনি আরেকটি প্রশ্ন করেছিলেন রিমান্ডে নেওয়া যায় কি যায় না। আমার এখানে পরিষ্কার অবস্থান হচ্ছে, ঐশীকে যখন নেওয়া হল, মেয়েটি নিজেই বলেছে যখন কথাটি, "আমি এই ঘটনাটি ঘটিয়েছি," তারপরে রিমান্ডে নেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না সেটা একটা কঠিন প্রশ্ন। কারণ রিমান্ড তখনই প্রয়োজন যখন আমার তথ্য-উপাত্ত কনফিউজিং মনে হচ্ছে।
আমাকে আরও গভীরে যেতে হবে, আরও গভীরে যেতে হবে এবং ঐশীর বেলায় এটা প্রয়োজন ছিল কি না এটা পুলিশের ভাবা উচিত ছিল– এক। দুই নম্বর হল, ঐশীকে যদি জিজ্ঞাসাবাদ করতেও হয়, তাহলে প্রথমেই তাদের দরকার ছিল– বয়স আমি পরে জানব, ইমিডিয়েট জানতে পারছি না– প্রবেশন অফিসার কোথায় ছিল, প্রবেশন অফিসারকে নিয়ে ঐশীকে একটা নিরাপদ স্থানে জিজ্ঞাসাবাদ করাই ছিল আইনানুগ সিদ্ধান্ত। কিন্তু সেটা করা হয়নি। তাই আমি মনে করি, এখানে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে।
মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু : আমাদের আলোচকদের একজন ছিলেন সাবেক আইজিপি। তিনি না আসাতে হয়তো এই প্রশ্নগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ জবাব পাব না। তবে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে আমরাও একজন স্বাক্ষরকারী এবং সেই আলোকেই আমাদের এই আইনটা ২০১৩ সালে করতে হয়েছে।
শাকিল ফয়জুল্লাহ : আমরা যে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করছি, মিডিয়ার কারণে বা মিডিয়ার কল্যাণে বলি, সুকল্যাণে বলি, অকল্যাণেই বলি– যে কারণেই বলি যেটা হয়েছে যে, যেদিন ঐশীকে কোর্টে নেওয়া হল ১৮ আগস্ট, ততদিনে একটা জিনিস মানুষের মনে অ্যাস্টাবলিসড হয়ে গেছে যে, 'শি ইজ আ ডেভিল'। তাকে যখন কোর্টে নেওয়া হয়েছে তখন ''এভরিবডি ইজ বায়াসড অলরেডি, সি ইজ এ ডেভিল, সো ডেভিল ডাজন্ট্ হ্যাভ এনি রাইটস''।
এই পারসেপশনটা দেওয়ার জন্য দায়ী কে, সে উত্তরটা আমরা সবাই জানি। পারসেপশনটা দেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ উৎসাহ দেখাতে গিয়ে তারা হয়তো বোঝেননি মিডিয়ার কাছে কতটুকু তথ্য প্রকাশ করা যাবে। সেটা খেয়াল করেননি। মিডিয়া যখন সেটা প্রচার করেছে, তারা নিজেদের যে দায়িত্ববোধ, তাদের যে নৈতিকতার প্রশ্ন সেটা ভুলে গিয়েছে। যখন তাকে কোর্টে নেওয়া হল ততদিনে এটা অ্যাস্টাবলিসড যে, 'শি ইজ এ ডেভিল ইন দ্য গাইজ অব হিউম্যান বিইং'।
ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট হচ্ছে আমার পাশে বসে আছে 'হ্যালো'র শিশু সাংবাদিক, সে আমাকে জানাল, ঐশী 'ও' লেভেল পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিল। 'ও' লেভেল পরীক্ষা দিতে গেলে যে কোনো মানুষের নিয়ম হচ্ছে তার পাসপোর্ট লাগে। ঐশীর পাসপোর্ট আছে। পাসপোর্ট কে দিয়েছে? সরকার দিয়েছে। সরকার যখন পাসপোর্ট দেয়, এসবি থেকে তার বয়স টেস্ট করা হয়, তার বাড়িতে যায়, নানা ঝামেলা করে এক মাস সময় নেয়।
সবকিছু করেছে কিন্তু ওইখানে গিয়ে তার বয়স ১৮ হয়ে গেছে। এখন পাসপোর্ট অনুযায়ী তার বয়স আমরা যেটা জানতে পেরেছি, সেটা হচ্ছে ১৭ আগস্ট ১৯৯৬। ১৮ আগস্ট তাকে কোর্টে নেওয়া হয়েছে, ওই দিন তার বয়স ছিল ১৭ বছর ১ দিন; তার পাসপোর্ট এবং স্কুলের রেকর্ড অনুসারে।
এখন দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, আমি আমার সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে যেটা দেখেছি, আমরা বলেছি মেয়েটি হচ্ছে দুর্ভাগা। কারণ হচ্ছে যে চিলড্রেন অ্যাক্ট ২০১৩ সংসদে পাস হয়েছে জুন মাসে। কিন্তু এটা ইমপ্লিমেন্টেশনের ডেইটের জন্য যে গেজেটটি প্রকাশিত হয়েছে এতে বলা হয়েছে এটি ইমপ্লিমেন্ট হবে যেদিন থেকে এটা কার্যকর হবে। ১৮ আগস্ট এটা কার্যকর ছিল না। কার্যকর হয়েছে ২১ আগস্টে।
১৮ আগস্ট কার্যকর কী ছিল? ১৯৭৪-এর আইনটি। ১৯৭৪-এর আইন অনুযায়ী ওইখানে বলা হচ্ছে, ১৬ বছর। সো ওই বেচারা ১৭ বছর ১ দিনের ফ্যাসাদে পড়ে গেছে। দুটি ল-এর ইমিপ্লিমেন্টের লুপ হোলের ভেতরে আটকা পড়ে এখন সে রিমান্ডেই আছে।
রিমান্ড দেওয়া হল ভালো কথা, মিডিয়াতে শুরুতে তাকে 'ডেভিল' প্রমাণ করে কোনো একটা সময় কয়েকজন সুবুদ্ধিপূর্ণ লোকের কথার কারণে যখন মনে হল– 'হায় হায় একটা তো ছোটখাটো ভুল হয়ে গেছে'', এ জন্য মিডিয়াতে যখন লেখালেখি শুরু হল, তখন সবার বোধোদয় হলো ''বোধহয় আসলে সে শয়তান নয়, সে একটু একটু মানুষও''।
এখন এটা প্রমাণ করার জন্য ফরেনসিকে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ফরেনসিকে পাঠানো হল ভালো কথা, ফরেনসিক এ ক্ষেত্রে অলরেডি বায়াস তার বিষয়ে। সো ফরেনসিকের রেজাল্টও বায়াসড হতে পারে এবং ফরেনসিকের যে রেজাল্ট আসবে, সেটা যদি অন্যরকম হয় তাহলে সরকার নিজের যে পাসপোর্টের প্রক্রিয়া সেটাকে অস্বীকার করবে।
খুব ভালো কথা করল। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ফরেনসিকে যদি তার বয়স ১৮-এর নিচে হয়, তাহলে এই যে ৫ দিন সে রিমান্ডে রইল, এই ৫টি দিন কে ফেরত দেবে? আমি নিজে ভয় পাই, আমাকে যদি বলে ২ ঘণ্টা রিমান্ডে থাকতে হবে, আমি ওই ভয়েই অস্থির হয়ে যাব। আমি এখানে কথা বলছি আমার ভয় করছে, এখানে যদি বেফাঁস কথা বলে ফেলি, আমাকে যদি রিমান্ডে নেয়।
এখন সেই বেচারা যে ৫ দিন রিমান্ডে রইল, ৫ দিন রিমান্ডে নেওয়ার পরে তার বয়স যদি ১৮-এর কম হয়, এজন্য তার কমপেনসেশন কে দেবে? তার এ চাইল্ডহুডটা কে ফেরত দেবে? হু উইল আনসার দ্য কোয়েশ্চেন? আমরা তো এ বিষয়ে কেউ কথা বলছি না। আমরা এখানে কথা বলছি, সে কী করেছে না করেছে সবকিছু নিয়ে কথা বলছি।
আমি এখানে ইউনিসেফের পক্ষ থেকে এসেছি। অবশ্যই আমি এখানে চেষ্টা করব না ইউনিসেফ কতটুকু ভালো কাজ করেছে সেটা প্রমোট করার জন্য। আপনাদের ইনফরমেশনের জন্য আমি যেটা জানাতে চাই, ২০০৯ সাল থেকে ইউনিসেফের পক্ষ থেকে একটা কাজ করা হয়েছে।
শিশুদের ক্ষেত্রে নৈতিকতা বিষয়ে কাজ করার জন্য বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের অন্তত ১০টা প্রিন্ট মিডিয়া এবং জাতীয় পর্যায়ের ১০টা ব্রডকাস্ট মিডিয়াতে ইন-হাউজ ট্রেনিং করে তাদের সঙ্গে কনসালটেশন করে প্রত্যেকটা মিডিয়া হাউজে তাদের নিজস্ব এথিক্যাল গাইড লাইন তৈরি করা হয়েছে। যেটা তাদের সুপিরিয়র ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ্রুভ করেছে, উইথ অল দ্য ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট। এ প্রসেসটা শুরু হয়েছিল ২০১০-এ। এই বছরের জুন মাস নাগাদ শেষ হয়েছে।
ডিস্ট্রিক্ট লেভেলেও এ কাজটা করা হয়েছে। ডিস্ট্রিক্ট লেভেলে ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টারে ওয়েলনোন ১০টা ডিস্ট্রিক্ট লেভেলের নিউজপেপার নিজস্ব এথিক্যাল গাইডলাইন অ্যাডপ্ট করেছে। কিন্তু অ্যাডপ্ট করে তারা কী করেছে? ইউনিসেফ হিসেবে আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি, কী হয়েছে? একটা কাগজ তৈরি হয়েছে, প্রিন্টারের কালি নষ্ট হয়েছে, আর ওই যে আমরা ই-মেইলের নিচে লিখে দিই 'সেভ এনভায়রনমেন্ট' প্রিন্ট করে আমরা সেই এনভায়রনমেন্টের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছি।
কিন্তু আলটিমেটলি জায়গার কাগজ জায়গায় রয়ে গেছে, যখন নিউজ এসেছে তখন হচ্ছে যে, 'আমার সেনসেশন তৈরি করতে হবে, আমার টিআরপি বাড়াতে হবে, পত্রিকার কাটতি বাড়াতে হবে,' সব করে-টরে আমার ওই যে দুদিনের এথিকাল গাইড লাইন করে ছিলাম, ওর ভেতরে কেউ টাচও করেনি এবং করার কোনো প্রয়োজনও পড়েনি।
আমি যতটুকু জানি ইউকে-তে মিডিয়াকে মনিটর করার জন্য সাধারণ মানুষের কমপ্লেইন করার জন্য জায়গা আছে, কাউন্সিল আছে তাদের। ইভেন টিভি যখন দেখতেই হয়, চাই বা না চাই ইন্ডিয়ান চ্যানেল চোখের মাঝখানে পড়বেই, সেইখানে একটা স্ক্রল থাকে "আপনাদের কোনো অভিযোগ থাকলে ব্রডকাস্টিং কাউন্সিলকে জানান।" আমাদের এখানে কোনো ওয়াচডগ নেই।
আজকের এই আলোচনায় এসে মনে হচ্ছে যে আমরা এখানে বসেছি, আজকের এই আয়োজন অবশ্যই সাধুবাদের দাবি রাখে, কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বিডিনিউজ এটা করবে! কেন এটা করার জন্য আলাদা কোনো ইনডিপেনডেন্ট কাউন্সিল নেই? বিডিনিউজ কি এখানে বাংলাদেশের মিডিয়ার জাতির বিবেকের দায়িত্ব নিয়েছে? কেন সব মিডিয়াকে কন্ট্রোল করার জন্য কোনো কাউন্সিল থাকবে না? তারা কেন এ কোয়েশ্চেনগুলো রেইজ করবে না, কেন বিডিনিউজকে এটা আয়োজন করতে হবে, সে কাউন্সিলকে কেন লোকে গিয়ে বলবে না যে আমি অফেনডেট ফিল করছি, এটা ভুল হয়েছে, সে জিনিসটা কোথায়?
আজকে আমরা এটা বিডিনিউজে করলাম, এটা যেসব মিডিয়ার ভালো লাগবে তারা তাদের নিজস্ব আলোচনার অনুষ্ঠান করবে। সবাই আলোচনা করতে করতে ফরেনসিক রিপোর্ট আসবে, দেখা যাবে হয় মেয়েটার বয়স কম বা বেশি, কিন্তু তার যা হওয়ার হয়ে গেছে। তার ভবিষ্যত ঝরঝরে হয়ে গেছে। কী লাভ হচ্ছে?
মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু : শাকিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা তুলেছে, সেগুলির প্রতিকারের দিক আছে, সে জন্য আমরা আসব। কিন্তু বিডিনিউজই সম্ভবত একটি আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে, আত্মানুসন্ধানের জন্য যে, মিডিয়ার অর্গানাইজেশন হিসেবে আমরা আসলে কী করছি? আর একটা অভিযোগ করার জায়গা কিন্তু প্রেস কাউন্সিলে আছে।
সামিন ইয়াসার প্রিয়ম একটা রিপোর্ট করেছিল, সে শিশু সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত হয়েছে। মিডিয়ার জায়গাতে ফিরে আসার জন্য আমি তাকে প্রশ্ন করতে চাই যে, তার ওইদিনের অভিজ্ঞতা কী এবং সাংবাদিকরা এই খবরটি সংগ্রহ করতে গিয়ে ঐশীকে কীভাবে দেখেছে, তার ছবি তোলার ব্যাপারে কী আচরণ করেছে সাংবাদিকরা?
সামিন ইয়াসার প্রিয়ম : ঘটনা শুরুর পর থেকেই প্রত্যেকটা সংবাদ মাধ্যম প্রচার করে যাচ্ছে, সে একজন 'সো কল্ড' খুনি। তাকে অনেক জায়গায় প্রচার করা হয়েছে এভাবে– সে অপরাধটা সংঘটন করেছে।
আমাদের কাছে মনে হয়েছিল, তার বয়সটা জানা উচিত। কারণ পুলিশ আন্দাজের উপর নির্ভর করে তার বয়স ১৮ দেখিয়েছে। স্কুল মাধ্যম হিসেবে আমরাই প্রথম কথা বলি। কথা বলে জানতে পারি, তার ডেট অব বার্থ ১৭ আগস্ট, ১৯৯৬। সে অনুযায়ী আদালতে যেদিন পুলিশ তার রিমান্ড চায় সেদিন তার বয়স ছিল ১৭ বছর ১ দিন।
১৯৭৪ সালের আইন অনুযায়ী যদিও সেটা সম্ভব। … গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জিজ্ঞাস করি এ ব্যাপারটা। 'আমাদের কথা বল' একটা প্রোগ্রামে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, সেখানে এ ব্যাপারে তাকে কোয়েশ্চেন করি, তিনি আমাকে ১৯৭৪ সনের আইনের কথাই বলেছেন।
ইউএম হাবিবুন নিসা: আমি কাউকে বোঝাতে পারছি না। ১৯৭৪ সালের আইনের ডেফিনেশনে বলা আছে ওটা হল 'এইজ অব ক্রিমিনাল রেসপনসিবিলিটি। একটা বিষয়ে যখন আইন হয় তখন এ বিষয়ে পেছনের আইনটা রিপিল হয়ে যাবে। ফলে পেনাল কোডের ৮২, ৮৩ নাল-এন-ভয়েড হয়ে গেছে।
'৭৪ এর আইনের অন্তত ৫টি জায়গায় বলা আছে, আমরা শিশুটিকে কতক্ষণ প্রোটেকশন দিব? সেটা ১৮ বছর। ডেফিনেশনে গিয়ে ১৬ বলা হয়েছে। কারণ ওটা হলো তার 'এইজ অব ক্রিমিনাল রেসপনসিবিলিটি। …
ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী: আইনের দৃষ্টিতে যদি দেখি, গতকাল পত্রিকায় পড়েছি, ফরেনসিক তার বয়স ১৯ বছর কত মাস যেন … এটিকে কেউ চ্যালেঞ্জ করেছে কিনা?
ইউএম হাবিবুন নিসা: আমার পজিশনটা খুব পরিস্কার। সুপ্রিম কোর্টের একটা জাজমেন্ট আছে যেখানে পরিষ্কারভাবে বলেছে জন্ম নিবন্ধনটাই হতে হবে তার বয়স। … ঐশী এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে তার জন্ম নিবন্ধন থাকার কথা। কারণ জন্ম নিবন্ধনকে বিবেচনা করেই তার পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছে। তাই আমার মনে হয়, ফরেনসিকের বিষয়টি উপর কোর্টে গিয়ে টিকবে না।
আফসান চৌধুরী : পুলিশ ফরেনসিকে গিয়ে ওকে ১৯ বছর করেছে, কয় হাজার টাকা লাগে পুলিশের ওকে ২৫ বানাতে? বাংলাদেশের পুলিশের উপরে আস্থা রাখে এমন লোক পুলিশ বিভাগেও পাওয়া যাবে না।
আমার মনে হয় পুলিশ যেটা করেছে, ক্ষতিটা হবে এরপর থেকে, মানুষের ফরেনসিক সম্পর্কে ধারণা হয়ে যাবে যে এখানে চাইলে বয়স বাড়ানো যায় কমানো যায়। আপনি যে কোনো কেসে এখন যদি ২৫ বছরের মানুষও খুন করে, পুলিশের কাছে ফরেনসিক যদি বলে ওকে ১৬, তাহলে আমরা কী করব? ক্রিমিনাল রেসপনসিবিলিটির নিচে পড়ে গেলে?
বাংলাদেশের সংকটটা তো হচ্ছে যে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানে মানুষে বিশ্বাস করে না। পুলিশকে কেউ বিশ্বাস করে? পুলিশ কিছুদিন আগে একটা সার্ভে করিয়েছে, সেখানে দেখিয়েছে বেশিরভাগ মানুষ মনে করে, পুলিশ ঘুষ খায় না। এখন আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশের কোনো মানুষ এটা বিশ্বাস করবে?
আমাকে একবার টিআইবি থেকে বলল যে, পাসপোর্ট আনতে গেলে ঘুষ দিতে হয় না। যেহেতু বিদেশে থাকি, আমি পাসপোর্ট আনতে গেছি। আমি বললাম, "কত হাজার টাকা দিতে হবে?" বলল,"সাড়ে ৩ হাজার টাকা দিতে হবে সার্ভিস চার্জ।" সাড়ে তিন হাজার কেন, আগে শুনলাম ৩ হাজার টাকা।" ''না, এখন সেনাবাহিনী এটা দেখাশোনা করছে তো, এটার রেট বেড়ে গেছে।"
পুলিশ যদি বলে যে আমি ঘুষ খাই না', পুলিশ নিজে ঘুষ দিয়ে আরেকটা সার্ভে করায় আপনার ধারণা মানুষে তা বিশ্বাস করবে? পুলিশ যেটা প্রতিষ্ঠা করে দিল সেটা হচ্ছে ফরেনসিক বিভাগের উপরে আর কারও আস্থা থাকবে না। এবার পয়সা দিয়ে, যে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে ফরেনসিক বিভাগ সেইভাবে রিপোর্ট দেবে।
এ অবস্থাটা পুলিশের জন্য সংকট নয়– সংকটটা ল অ্যান্ড অর্ডারের। আমার দেশে কোনো অসুবিধা হবে না যে কোনো কিছু প্রমাণ করতে যদি ক্ষমতা থাকে। তাই যদি হয়, তবে বাচ্চাদের রক্ষা করবে কে?
আমার মতে বাংলাদেশের আইনের ভেতরে বাচ্চাদের রক্ষা করার যে পরিসরটা আছে, যেটা নিয়ে শাকিলরা কাজ করে, ওটা অত্যন্ত দুর্বল। দুর্বল বলে আমরা আইনের কাছে যাই, তাদের কাছে যাই যারা বাচ্চাদের অধিকারগুলো সবচেয়ে বেশি রক্ষা করে। কীভাবে এটা নর্মালি এক্সেপ্ট করি যে আমরা কোর্টের কাছে যাব, আর যে কোনো ধরনের পুলিশের সুবিধার কারণে ফরেনসিক রিপোর্ট চলে আসবে? বাচ্চাদের অধিকার রক্ষা করবে?
১৬ দিয়ে শুরু হয়েছিল ১৯ এসে ঠেকেছে। আর কতদিন, কবে প্রয়োজনে বাড়াবার দরকার হবে, কমাবার দরকার হবে?
ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক: আপনাদের আলোচনা শুনে বুঝছি, আমরা পুলিশের উপর নির্ভর করতে পারি না, আমরা সরকারের আইনের উপর নির্ভর করতে পারছি না, আদালতের উপর নির্ভর করতে পারছি না, সাংবাদিকদের উপর নির্ভর করতে পারছি না, দেশের কোনো সিস্টেমের উপর নির্ভর করতে পারছি না, সবাই চোর-ছ্যাচ্চড়, বদমাশ, সবাই মিথ্যা কথা বলে, ডাক্তারের উপরে নির্ভর করতে পারছি না, তাহলে আমরা কেন এখানে বসেছি?
যখন কোনো কিছুর উপর নির্ভর করতে পারি না, তাহলে আমরা এখানে খামোখা গলাবাজি করে, চেঁচামেচি করে কী করছি? সমাজ যেখানে নষ্ট, পুলিশ প্রশাসন নষ্ট, আদালত নষ্ট, বিচারক নষ্ট, বিচারকরা ঘুষ খান, তাহলে এখানে বসে গলা ফাটিয়ে কোনো লাভ আছে আমাদের? এটা একটা ফ্যাশন শোর মতো হয়ে গেল। এটা এক নম্বর কথা।
দুই নম্বর কথা হচ্ছে, ঐশীর মতো একটি মেয়ে 'ও' লেভেল পড়ছে, একটু বেশি বয়সে 'ও' লেভেল পড়ছে, সেই মেয়েটি ইয়াবা ট্যাবলেট খেলে পরে মানুষের যে পারসোনালিটি চেঞ্জ হয়, সেটা কিন্তু আমরা মোটেই চিন্তাভাবনা করছি না। সে তখন আর ১৬ বছরের নয়, সে তখন ৩৬ বছরের একটা শিশুর মতো ব্যবহার করতে পারে। এ হচ্ছে দুই নম্বর কথা।
তিন নম্বর কথা হচ্ছে, আমাদের সাইকোলজিতে একটা কথা আছে– 'আ ডিস্টার্বড চাইল্ড মিনস এ ডিসটার্বড ফ্যামিলি।' অথ্যাৎ ঐশীকে তৈরি করেছে তার পরিবার, তার সমাজ, তার বন্ধুবান্ধব, তার স্কুল। সবাই কিন্তু ঐশীকে তৈরি করেছে। ঐশী কিন্তু এখন আর ১৬-১৭ বছরের একটি মেয়ে নয়; ঐশী কিন্তু ভীষণ ম্যাচিউরড একটি মেয়ে। কেন সে ভীষণ ম্যাচিউরড একটি মেয়ে?
একটা কথা বলি, আমি যখন ইংল্যান্ডে ছিলাম, তখন একটি বাচ্চাকে দুটি ছোট ছোট বাচ্চা খুন করেছিল। সেই বাচ্চাটার বয়স ছিল সাড়ে ৩ বছর। যারা খুন করেছিল তাদের বয়স ৫ বছর কিংবা ৬ বছর এ রকম। ভুলেই গিয়েছি, অনেক বছর আগের কথা। মা বাচ্চাটিকে নিয়ে শপিং সেন্টারে গিয়েছিলেন, তারা বাচ্চাটাকে নির্জন জায়গায় নিয়ে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে তাকে মেরেছে।
সেই দুটো বাচ্চা সম্পর্কে সবকিছুই খবরের কাগজে ফলাও করে বেরিয়েছিল। তাদের পারিবারিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবন, তারা কোনো পরিবেশে বড় হয়েছে সাংবাদিকরা কিন্তু সেটা বের করেছিল। তারপর কিলার বাচ্চা দুটোকে সমাজ থেকে একদম দূরে সরিয়ে ফেলা হল।
ঐশীর যেটা হয়েছে, ঐশী কিন্তু ড্রাগস খেত, ইয়াবা ট্যাবলেট খেত। সে যথেষ্ট হাতখরচ পেত। যার পরিপ্রেক্ষিতে তার বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে ড্রাগ খেত। দুঃখের ব্যাপার, আমাদের এখানে কোনো ফরেনসিক সাইকিয়াট্রি ডেভলপ করেনি। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি, ব্রিটিশদের করে যাওয়া ১৯১২ সালের মেন্টাল হেলথ অ্যাক্ট দিয়ে আমরা চলছি। আমাদের ফরেনসিক সাইকিয়াট্রি বলে কিছু নেই।
ঐশীর মতো মেয়েরা যারা খুন করে বা খুনিদের কোনো সাইকোজিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট হয় না। সরকার কখনও প্রয়োজন মনে করে না যে এ সমস্ত খুনিদের মেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট থরোলি করা দরকার। ফরেনসিক সাইকিয়াট্রি ইম্পর্টেন্ট একটি সাবজেক্ট।
একটা কথা বলি, আমাদের সাংবাদিকরা কোত্থেকে জানবেন, তাদেরও তো সাইকোজিক্যাল কিছু ট্রেনিং দরকার। কবি শামসুর রাহমান ভাই মারা গেছেন ৫ মিনিটও হয়নি, সমস্ত পাড়া থেকে লোকজন আসছেন, কবি সাহিত্যিকরা কিছু কিছু আগে থেকেই সেখানে ছিলেন, আরও আসছেন। স্রোতের মতো মানুষ আসছে। ভাবি পাগলের মতো কাঁদছেন, চুল ছিঁড়ছেন, কী করছেন না করছেন।
সেই সময় একজন মেয়ে জার্নালিস্ট খুব হোমরা-চোমরা চেহারা তার, মুখের কাছে মাইক নিয়ে গিয়ে বলছে, 'আপনার অনুভূতির কথাটা বলুন।' আমি সেই সাংবাদিককে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম, 'গেটআউট। এখনই মারা গেছে, আর এখনই আপনি জিজ্ঞেস করছেন!' আমাদের সাংবাদিকরা এতটা ইনসেনটিটিভ কেন?
কারণ হচ্ছে মিডিয়াতে প্রতিযোগিতা, সাংঘাতিক প্রতিযোগিতা। যে মানুষটি সবচেয়ে আগে জনগণকে বা প্রথম আলোতে বা সমকালে সংবাদটা আগে দিতে পারবে, সাংবাদিক হিসেবে লাফ মেরে তার উন্নতি হবে। এই যে কম্পিটিশন, এই যে নিজেদের ভেতর রেষারেষি, খেয়োখেয়ি– এই যে প্রতিদিন একটা করে খবরের কাগজ বেরুচ্ছে আমাদের দেশে, হোয়াট ফর? কেন বের হচ্ছে?
কারণ লোকে রগরগে খবর খুব পছন্দ করে। আমি যদি পছন্দ না করতাম তাহলে সেই খবরের কাগজ কীভাবে আমাদের ঘরে আসত? সেটা বুঝতে হবে, আমরা নিজেরাও পচে গিয়েছি।
আমরা ঐশীকে বিচার করার আগে আমাদের চিন্তা করতে হবে ঐশী কিন্তু ম্যাচিউরড বিহেভিহার করেছে। কীভাবে ম্যাচিউরড বিহেভিহার করেছে? আমাদের ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিতে লেখা আছে, যে খুনি আগে থেকে প্ল্যান করে খুন করে, হি ইজ এ রিয়েল মার্ডারার– দিস ইজ নট আ ইমোশোনাল মার্ডার যে, মা বকা দিচ্ছে আমি রান্নাঘর থেকে বটি এনে মাকে মেরে ফেললাম– দ্যাট ইজ এ ইমোশোনাল মার্ডার। দিস ইজ এ প্রি-প্ল্যানড মার্ডার।
ফর দ্যা লাস্ট ফিউ উইকস সেই মেয়েটি একটা চাপড় জোগাড় করছে, দড়ি জোগাড় করছে, মেয়েটি ঘুমের ওষুধ দিচ্ছে রেগুলার মা-বাবাকে, সো দ্যাট সে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে পারে, বাইরে যেতে পারে, ফাজলামি করতে পারে, মোবাইল করতে পারে।
এখন আমাদের দেশে ইন্টারনেটে এই যে সমস্ত ভার্চুয়াল রিলেশনশিপ হচ্ছে, ফেসবুকে যে সমস্ত ভার্চুয়াল রিলেশনশিপ হচ্ছে, টেক্সট মেসেজে যে সমস্ত ভার্চুয়াল রিলেশনশিপ হচ্ছে– আমরা বড়রা কি ভালো আছি? আপনারা কয়জন ভালো আছেন চিন্তা করে দেখেন। আমি কি নরমাল আছি? আমি নিজে নরমাল নেই।
সে জন্য আমাদের কিছু আত্মসমালোচনা করতে হবে। আমাদের সিস্টেমের উপর কোনো বিশ্বাস তো নেই, আমাদের নিজেদের নিজেদের উপরও বিশ্বাস নেই। ঐশীকে ভিন্নদৃষ্টিতে দেখতে হবে। সি ওয়াজ টেকেন ড্রাগস ফর দ্য লাস্ট সেভেন ইয়ার্স। সে অতিরিক্ত টাকা-পয়সা নিত বাবা-মার কাছ থেকে যা বখে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। তার বন্ধু-বান্ধবরা ড্রাগ খেত, ইয়াবা খেত, তার ভেতর কতখানি হিংস্রতা তৈরি হয়েছে যে, ছোট্ট একটা ঐশী যে তার বাবা-মাকে ভালোবাসত ৮, ১০, ১১ বছর বয়সে, সেই ঐশী তো ছিল না, সি ওয়াজ টোটালি ট্রান্সফর্মড এন্ড চেঞ্জইজড।
সেই ঐশী থাকলে 'আমার মাকে আমি মারব!' তা আমি ঘুমের ওষুধ কিনে এসেছি দোকান থেকে, এবার আমি একটি চাপড় কিনে লুকিয়ে রেখেছি ঘরের মধ্যে, এই চাপড়টা দিয়ে আমার বাবা-মাকে হত্যা করব, আমার একটা সেকেন্ড থট আসছে না! হাউ? একমাত্র মার্ডারার যে সে হচ্ছে রিয়েল মার্ডারার।
এখন এ ক্ষেত্রে আমাকে ভাবতে হবে, যতই সে রিয়েল মার্ডারার হোক, তার বয়সটা কম। যদি ১৮ বছরের নিচে হয় বা ১৭ বছরের নিচে হয়, এটা লিগাল সিস্টেম কীভাবে দেখবে আমি জানি না। কিন্তু আমি মনে করি, আপনাদের কারও ঘরে ড্রাগ অ্যাডিক্ট কোনো ছেলে-মেয়ে নেই, যদি থাকত তাহলে সেকেন্ড থট দিতেন ঐশীর ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে।
ড্রাগ অ্যাডিক্ট ছেলেমেয়ে যে সমস্ত ফ্যামিলিতে আছে, সে সমস্ত ফ্যামিলি আমরা ডিল করি, আমরা বাবা-মাকে এ কথা বলতে শুনেছি- 'আমি ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছি আমার ছেলেটি বা মেয়েটিকে সে যেন ঘুম থেকে না ওঠে।' কত বাবা-মা তার ছেলেমেয়েকে পুলিশের কাছে তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে।
বিগত এক বছর ধরে আপনারা খবরের কাগজ পড়ে দেখুন, ছেলে বাবাকে হত্যা করছে ড্রাগসের জন্য, ছেলে মাকে হত্যা করছে ড্রাগসের জন্য, একটা বিখ্যাত চিত্রঅভিনেতার ছেলে আরেক ছেলেকে মেরেছে ড্রাগসের জন্য।
এই যে ভায়োলেন্স, এই ভায়োলেন্স একটা সাধারণ মানুষের মধ্যে হবে না। আনলেস ড্রাগস তার ব্যক্তিত্ব, মানসিকতা, মনোজাগ্রত সম্পূর্ণ বিকৃত করে না দিতে পারে। আমাদের অবশ্যই খুব সিমপ্যাথি আছে, ঐশী একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে এবং যদিও সে বেশি বয়সে 'ও' লেভেল পড়ছে, তার সংসারটি হ্যাপি ছিল না, তার বাবা-মা তাকে নিয়ে খুব একটা হ্যাপি ছিলেন না, তার পরিবেশ তাকে নিয়ে হ্যাপি ছিল না।
কিন্তু মনে রাখতে হবে রিমান্ড মানে কি চর্টার সেল, নাকি রিমান্ড মানে জিজ্ঞাসাবাদ? আমি জানি না। যদি রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ হয়, আমি গিয়ে বলি "আমি খুন করছি," তবে আমাকেও রিমান্ডে যেতে হবে। আমি সত্যি বলছি নাকি ড্রাগের ঘোরে বলছি, আমি মদ খেয়ে বলছি নাকি সুষ্ঠুভাবে বলছি, নাকি আবেগের বশে বলছি।
বাবা-মাকে মেরে ফেলা হয়েছে, তখনও মনে হয়নি, পরের দিন কি তার পরের দিন মনে হয়েছে "হায়, আমি কী কাজটি করলাম!" তখন মনে হয়েছে, তখন সে গিয়েছে। আবেগের বশে মেরে ফেলাটা একটা ভিন্ন ব্যাপার। সে ক্ষেত্রে দেশ এবং বিদেশে সব জায়গায় কিন্তু পানিশমেন্ট কম হয়। যখন দু বন্ধু মারামারি করছে, ঝগড়াঝাটি করছে হঠাৎ একজন আরেকজনকে মেরে ফেলল, তার একটা আলাদা পানিশমেন্ট।
আর যে বন্ধু বন্ধুকে মারবে বলে ৬ আগে ধরে প্ল্যান করছে তার কিন্তু অন্য ধরনের পানিশমেন্ট। সে ক্ষেত্রে অনেক ফ্যাক্টরস কনসিডারেশনে নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে চুল টানতে গেলে পুরো বডি চলে আসে ও রকম হবে।
আমি বলব, আমরা সব দিক ব্যালান্স করে আমাদের সাংবাদিক, আমাদের মিডিয়া, আমাদের সিস্টেম সবকিছু ব্যালান্স করে যাতে ঐশী মেয়েটির রি-ফরমেশন হয়, এ রকম ঘটনা আর সমাজে যাতে না ঘটে, সেগুলো আমাদের দেখতে হবে।
আমি শুধু মনে করি, ইংলিশ মিডিয়াম ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে আমাদের দেশ ও জাতি কিছুই পাবে না। যে ছেলেটিকে যে মেয়েটিকে আমার দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে না শেখাচ্ছি, তাকে নাচ-গান-আবৃত্তি, কথকতা, নাটক, বড় বড় সাহিত্য তার ভেতর না দিতে পারছি, প্রবেশ করাতে না পারছি, ততক্ষণ আমার ছেলে বা মেয়েটির কাছ থেকে আমার দেশ, আমি বা আমার জাতি কোনো কিছু এক্সপেক্ট করতে পারে না।
আমি ১১ ভাইবোনের একজন সন্তান। আমার আরও ১০টি ভাইবোন আছে। আমার মা সারাদিন রান্নাঘরে থাকতেন। মার আঁচল পর্যন্ত ছুঁতে পারিনি, মা এত ব্যস্ত থাকতেন। সকালে যখন যেতাম মা রান্নাঘরে, দুপুরবেলা যখন স্কুল থেকে এসেছি মা রান্নাঘরে, বিকালে মা রান্নাঘরে, রাতের বেলা মা রান্নাঘরে, আমার মা পিঁড়িটার উপর মাথা দিয়ে ১০ মিনিট রেস্ট নিতেন। কারণ তখন ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে আসবে নাস্তা করতে হবে।
আমার টিচার কে ছিল, মা? মা না আমার টিচার ছিল, না আমার বাবা। আমার বাবা জানতেন না কোন ক্লাসে পড়ি। আমি ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে বাবার কাছে গিয়েছি, বাবা জিজ্ঞেস করেন তুমি ক্লাসে পড়? জানতেন না ১১টা ছেলেমেয়ে কে কোথায় আছে, কিছুই জানতেন না।
কিন্তু একটা জিনিস আমাদের ছিল সেটি হচ্ছে সাহিত্য। আমাদের টিচার ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, আমাদের টিচার ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আমাদের টিচার ছিলেন তারাশঙ্কর, আমাদের টিচার ছিলেন সুকুমার রায়… এ রকম আরও অনেক। দস্যু মোহন তিনিও আমাদের টিচার ছিলেন।
আমি যেটা বলব, যে সাহিত্য থেকে বিচ্যুত হলেই ছেলেমেয়েদের ভেতরে এক ধরনের ভ্যাকিউম সৃষ্টি হয় এবং সে ভ্যাকিউমটাকে সে কীভাবে ফিল আপ করে? ফেইসবুক দিয়ে, বন্ধুবান্ধব দিয়ে, ড্রাগস দিয়ে, ইয়াবা দিয়ে এ সমস্ত দিয়ে। আমাদের সামাজিকভাবে সবদিক থেকে একটু বিচার বিবেচনা করে ঐশীর ব্যাপারে ইমোশনাল নয়, খুব ঠাণ্ডা মাথায় একটা ওপিনিয়নে আসতে হবে।
মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু : এই সূত্র ধরে একটা কথা হতে পারে। এ ধরনের শিশু অপরাধীদের ডিল করতে গিয়ে সংবাদ মাধ্যম এবং পুলিশ যে আচরণ করছে, সেটা কী ওই ক্ষেত্রে প্রতিকারে সাহায্য করছে? পরিবারকে, সমাজকে, ব্যক্তিকে বা আমাদের কী করা উচিৎ?
ফরিদা আকতার : আমি যেভাবে দেখছিলাম পুরো ব্যাপারটাকে, আমার কাছে মনে হচ্ছিল, অনেক দিন পর পেরেন্টরা হয়তো নড়েচড়ে বসবে– হোয়াট সুড বি মাই রোল অ্যাজ আ পেরেন্ট? এটা নিয়ে আমি খুব আশাবাদী ছিলাম। আসলে ঘটনাটি তাদের নড়েচড়ে বসাবে।
কিন্তু মিডিয়া এবং পুলিশের রোল যেটা করেছে, সবাইকে খুব জাজমেন্টাল করে দিয়েছে। আমি ভাবছিলাম নিশ্চয়ই আপা যেটা বলছিলেন, দুপক্ষেরই নন-জাজমেন্টাল অবস্থায় থেকে ব্যাপারটাকে বিশ্লেষণ করতে পারি। কিন্তু বিশ্লেষণের তো দরকার নেই। প্রথম থেকেই তো 'ডেভিল' বানিয়ে দিয়েছে।
কাজেই মেয়েটিকে যদি 'ডেভিল' বানানো হয়, তাহলে ওই যে পেরেন্টদের নড়েচড়ে বসার যে ব্যাপারটি বলছি, সেটি কিন্তু কাজ করবে না। সবাই ভাববে, 'না, আমার বাচ্চা তো ও রকম ডেভিল নয়।' কিন্তু আমি মা হিসেবে কী করছি, এই ব্যাপারটা এত ইম্পর্ট্যান্ট।আমি এখানে আসার আগে একটু সাগর-রুনির বাচ্চাটাকে টাচ করে যেতে চাই যেটা আফসান ভাই বলছিলেন।
আমি বাচ্চাটির কাউন্সেলিং করেছি। মেঘ আমার কাছে এসেছিল। আমি সাজেদা ফাউন্ডেশনের সঙ্গেও কাজ করি। ওখানে আমরা কাজ করেছি। বাচ্চাটি যখন আসল হাইলি-ট্রমাটিক। সে তার মা-বাবা সম্পর্কে কোনো কিচ্ছু করবে না। প্রথম দিন এল, অসম্ভব ধরনের রেস্টলেস, এক মিনিট কোথাও স্বস্তি দিচ্ছিল না। আমরা আস্তে আস্তে যখন প্রোগ্রাম শুরু করলাম, আমার সঙ্গে দুজনকে কাজ করতে বললাম, কিন্তু সিদ্ধান্ত ছিল, একবারের জন্য এ ঘটনা জিজ্ঞেস করব না। আমরা নানা কিছু করছি, কিন্তু ওই ঘটনায় যাচ্ছি না।
আস্তে আস্তে যখন আমাদের সঙ্গে ফ্রি হল, তখন ড্র করে করে বোঝানো শুরু করেছিল। কিন্তু যাদের দ্বারা খুব ডিস্টার্বড ছিল অফকোর্স র্যাব, পুলিশ এবং সাংবাদিকরা। র্যাব ওকে টেনে টেনে ট্রমা ম্যানেজমেন্ট সেন্টারে নিয়ে যেত! এটা আমার খুবই অবাক লেগেছিল।
বাচ্চাটা খুব ভালো হল মাশাল্লাহ। ওর একটা ছিল রেস্টলেস, আরেকটা ছিল স্কুলের ব্যাপারে ইন্টারেস্ট হারিয়েছে, কোনো হোমওয়ার্ক করত না। কিন্তু দেখা গেল, ট্রিটমেন্টের পরে ও সব ব্যাপারটায় ফিরে আসছে, ওর মামা খুব খুশি ছিলেন।
তারপরে এল এক বছর পরের ঘটনা। ওকে আবার এক্সপোজ করা হল। আমি নিজেও টিভিতে দেখলাম, ওর নানির কোলে বসে আছে, ওকে বারবার দেখানো হচ্ছে। তারপরে আবার আমাদের কাছে নিয়ে এল। আবার ট্রমাটিক হয়ে গেছে।
কাজেই অত্যন্ত ইম্পর্ট্যান্ট এই ব্যাপারটি যে আমি বাচ্চাকে এ রকম ক্ষেত্রে কীভাবে তাকে এক্সপোজ করব।
একটা জিনিস সব পেরেন্টদের জন্যই বলতে চাই, একটা বাচ্চা যখন ইয়াবা নেওয়া শুরু করে, যে কোনো ড্রাগ নেওয়া শুরু করে, তার আগের একটা অবস্থা থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওই অবস্থাকে আমরা বলি 'অপজিশনাল ডেভিয়েন্ট ডিজঅর্ডার'। এটা এক ধরনের আচরণগত সমস্যা। আপনারা শুনলেই বুঝবেন যে এটা খুব কমনলি ঘটে। সেটা হল কোনো কিছু মানব না, আমি ডিসিপ্লিন মানব না, আমি রাত্রিবেলা অনেক দেরিতে উঠব, আমি সকালবেলা ঘুমাতে যাব, সারারাত আমি ফেইসবুকে থাকব বা কিছু একটা করব, আমি টাইমলি ভাত খাব না, আমি টাইমলি গোসল করব না, আমি কোনো কথাই শুনব না। কিছু একটা হলেই বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। অনেকগুলো সিম্পটম আগে থাকে। তারপরেই দেখা যায় আস্তে আস্তে ড্রাগের দিকে যায়।
কাজেই এটা আরেকটি ব্যাপার, পেরেন্টদের যথেষ্ট সাবধান হওয়ার দরকার আছে। আর এই সিম্পটমগুলোই একদিন তাকে ওদিকে নিয়ে যেতে পারে। অবশ্য কিছু কিছু আছে যেটা হয়তো সিম্পটম ছাড়াও হয়। যেমন ধরেন সে পিয়ার প্রেসারে পড়ে গেল যে তার বন্ধুবান্ধবরা তাকে বলছে, সে কিউরিওসিটির জন্য সে গেল, সেটাও হয়। আবার একটা বড় কারণ আমাদের নিজেদের ঘাড়ে পড়ে, সেটা হল, ডিসফাংশনাল ফ্যামিলির ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে এটা দেখা যায়। কাজেই আমরা যদি আগেই ফ্যামিলিটাকে ডিসফাংশনাল করে রাখি, তাহলে বাচ্চারা এ ধরনের ব্যাপারে যাবেই।
আরেকটি বিষয় রিমান্ড। আপা অবশ্য বলেছেন, রিমান্ড মানেই কি টর্চার সেল? আমরা জানি না। যদি ওদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের রিমান্ড হয়ে থাকে, সেলটা ও রকম হয়ে থাকে তাহলে বাচ্চাটার কিন্তু ট্রমা ডেভেলপ করার কথা। ৫ দিন ছিল না আপা? যথেষ্ট ভালো ট্রমা ডেভেলপ করার কথা। এটা তার পরবর্তী লাইফের জন্য খুবই ডিসটার্বিং।
কাজেই এগুলো দেখার দরকার আছে। বিচার প্রসেসের পরে, যে বিচারের প্রসেস থেকে তার মধ্যে কি ডেভেলপ করেছে এবং ওর শাস্তি যাই হোক আমি জানি না, সেটা আমরা এখন কেউ জানি না। কিন্তু আপা দেখার একটু দরকার আছে, ওর চিকিৎসা লাগবে কিনা, কাউন্সেলিং লাগবে কি না। কারণ আমরা তাকে যতটুকু শাস্তি দিচ্ছি এটাকে প্লাস প্লাস করে দিচ্ছি। আরও অনেক বেশি তার উপর দিয়ে যাচ্ছে। …
আরেকটি জিনিস দেখেন যে, টাকা দেওয়া হত তার হাতে। আপা যেটা বলেছেন, টাকা চেয়ে নিত, কিন্তু আমি বলব টাকা দিত কেন? এক লাখ হোক বা ১০ হাজারই হোক, এত দেবে কেন তারা?
আরেকটি জিনিস আমার মনে হয়েছে, যখন ব্যাপারটা এত তীব্র হল তখন উনারা কি করেছেন? সেল ফোন উইথড্র করেছেন, দারোয়ানকে বলেছেন ও যেনো এখান থেকে বেরোতে না পারে, বাসায় আটকে রেখেছেন, এটা কি কোনো ট্রিটমেন্ট নাকি? উনাদের তো ট্রিটমেন্ট চিন্তা করতে হত। উনারা আইদার আপার কাছে নিয়ে যেতে পারত বা উনারা আমাদের কাছে আনতে পারত।
এখানে আরও একটি বড় দায়িত্ব আছে বোধহয় স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিগুলোর। স্কুল কাউন্সেলর যদি থাকত তাহলে অনেক আগেই হয়তো ডিরেইল্ড কিছু কিছু বিহেভিহার চোখে পড়ত টিচারদের এবং কাউন্সেলরের কাছে যেত। ইউনিভার্সিটি লেভেলে সব লেভেলে এটা দরকার হয়ে গেছে। কিছু কিছু ইউনিভার্সিটি রিয়ালাইজ করছে, যেমন আফসান ভাই ব্র্যাকের সঙ্গে আছেন, আমি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করছি। একটা গ্রুপ ডেভেলপ করছে ওরা। এখন আবার গ্রিন ইউনিভার্সিটি নিল, নর্থ সাউথ একজনকে নিয়েছে। একটু ডেভেলপ করছে ব্যাপারটি।
কিন্তু আমাদের তো দরকার হচ্ছে, ডিরেইলড হলে তাকে আসলে হেলপ করা। ইনস্টিড অব শাস্তি, তাই না? কাজেই আমরা টাইমলি যদি হেলপটা না প্রোভাইড করি তাহলে আস্তে আস্তে এই পর্যায়ে চলে আসবে। যখন 'ডেভিল' মনে হবে তাকে।
বেবী মওদুদ: এই সূত্রে বলি। আমার বন্ধুবান্ধব যারা আসত সকলেই প্রায় সিগারেট খেত। আমার সামনে বসেই খেত। একবার বোধহয় মঞ্জু তুমি আমার বাসায় ছিলে, তোমার সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল, তখন রাত সাড়ে ১০টা হবে, আমরা ভাত খাচ্ছি, ও ভাত খেয়ে সিগারেট খাবে।
ও শুনে আমার ছেলে বলে, 'আমি নিয়ে আসছি মামা টাকা দেন।' ও সিগারেট আনতে গেছে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আওয়াজ। আমরা সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখি দারোয়ান তো গেট বন্ধ করে দিয়েছে। গেট সে পার হওয়ার সময় উঁচু উঁচু শিকগুলো থাকে সেটা ঢুকে গিয়েছিল।
মঞ্জু তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমি শুনলাম যে সিগারেট একটু একটু করে খাওয়া ধরেছে। আমি বললাম "বাবা, সিগারেট খেতে ইচ্ছা করলে আমার সামনে বসে খাবা, আমার কাছে পয়সা আছে আমি দেব, কিন্তু লুকিয়ে-চুরিয়ে খাবা না, বা কারও কাছ থেকে চেয়ে খাবা না। কেননা কেউ এসে যদি বলে আপনার ছেলেকে সিগারেট খেতে দেখলাম, সেটা আমার কাছে খারাপ লাগবে।" তারপর থেকে সে আমার কাছে পয়সা চেয়েই সিগারেট খেত।
সে অনেক সময় বেলা ২টা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে, যখন সে কলেজে গেল আড়াইটা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে, তিনটা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে! আমি একটু টেনশনে পড়লাম। কী ব্যাপার ড্রাগসের মধ্যে গেল, নাকি কী এসব ব্যাপার? আমি তাকে জিজ্ঞাস করলাম, "তুমি এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলা, তোমার কি শরীর খারাপ হয়েছে?" তখন সে আমাকে একটা একটা করে শোনাল, "তুমি মনে করছ আমি ড্রাগ খেয়েছি, আমি যদি ড্রাগ খাই, আমার মধ্যে এই এই জিনিস পাবা, তখন বুঝবা আমি ড্রাগ খেয়েছি। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেও। তার আগে আমাকে জিজ্ঞাস করবা না। আমি অত খারাপ না।"
একটা জিনিস আমি তার মধ্যে কালচারটা ঢোকাতে পেরেছি। ওর মধ্যে একটা জিনিস ছিল, সে ভালো গল্প লিখে। লন্ডনে একটা টেলিভিশনে ভালো চাকরি করে। আপা যেটা বললেন, শিশুদের মনে ছোটবেলা থেকে কালচার, বইপড়া, গান শোনার কালচারটা যদি ঢোকাতে পারি তাহলে কিন্তু সে এত খারাপ হতে পারে না।
মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু : একটু সংশোধন। আমি ছিলাম। বিষয়টা আমি জানিও। তবে অভির ওই সিগারেটের বিষয়টার সঙ্গে আমি জড়িত নই। কারণ আমি আজীবন অধূমপায়ী …
ড্রাগস ট্রিটমেন্টের জন্য আপনার বলছেন তা ঠিক আছে। কিন্তু আমরা বলতে চাচ্ছি, আমরা মিডিয়া এবং পুলিশ এটিকে হেলপ করছি না ক্ষতি করছি?
শেবা তাসমিন হক: আমি স্কুল-কলেজের আলোকে বলব, কিন্তু তার আগে আমি মিডিয়া এবং সংবাদপত্রের কর্মীরা যে কাজগুলো করছে, এটা আমি দেখছি এভাবে যে, ওরা বুঝি রুটিন ওয়ার্ক করছে। মানে ওরা আট-দশটা মানুষের বেলায় যা করছে, ঐশীকে সেভাবেই হ্যান্ডেল করছে। ঐশী যে একটা ছোট বাচ্চা, সেটা তারা কনসিডার করছে না। কারণ ওটা কনসিডার করতে গেলে তাদের অন্য ট্রেইলে যেতে হবে। দ্য ওয়ান্ট টু গো সেইম ট্রেইল। সব সময় কমফোর্টেবল ফিল করে ওই ট্রেনে হাঁটতে, সে জন্য তারা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে না।
আপনারা অনেকেই অনেক বেশি প্রাজ্ঞ্। আমি যদি কিছু বলি, ধৃষ্টতা মাফ করবেন। আপা একটু বলেছিলেন, ইংলিশ মিডিয়ামের বাচ্চারা আমাদের বাংলা সংস্কৃতির কিছুই জানে না। সেটা কিন্তু পুরোপুরি সত্য নয়। সব স্কুল-কলেজের কথা জানি না, আমরা এমন বেশ স্কুল-কলেজের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, সেগুলো কিন্তু বাংলা চর্চা করে।
সমস্যাটা হল, এক হাতে তো তালি বাজে না। স্কুল শুধু দায়িত্ব নেবে, পেরেন্টস কী করবেন? পেরেন্টস কেন বাসায় একটা বই কেনে দেন না? এখন গিফট চান– কম্পিউটার চলে আসছে, প্লে স্টেশন চলে আসছে। বাচ্চারা যদি সারাক্ষণ ওগুলোর মধ্যে থাকে তো বই পড়বে কখন? পেরেন্টসেরও তো দায়িত্ব আছে।
পেরেন্টরা অনেক সময় আমাদের কাছে আসেন। আমাদের পায়ে পড়ে যান। বলেন, "কীভাবে আমরা বাচ্চাকে মানুষ করব, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আমার বাচ্চা ড্রাগস খাচ্ছে, আমার সিগারেট খাচ্ছে।" আরে বাবা, তোমাদেরও তো একটু দায়িত্ব আছে। বলেন, "আমরা তো ইংলিশ পারি না, সেজন্য সব দায়িত্ব আপনাদের, আপনারাই সব করেন। আমরা ইংলিশ বলতে পারি না।"
সো হোয়াট? ইংলিশে বলার দরকার নেই, ইংলিশের দায়িত্ব আমরাই নিলাম, আমরা শিখিয়ে দেব। তোমরা খালি মানুষ হওয়ার দায়িত্বটা নাও। তোমরা মানুষ হওয়াটা শিখিয়ে দাও। তোমরা বই দিচ্ছ না, কম্পিউটার দিয়ে বসিয়ে রাখছো। আজকাল বাচ্চারা বই পড়ে?
আমরা কিন্তু প্রত্যেকটা হলিডেতে– রমজান হলিডে বলেন, ঈদ হলিডে বলেন, উইন্টার ভ্যাকেশন, সামার ভ্যাকেশন প্রত্যেকটাতে বইয়ের একটা লিস্ট দিয়ে দিই যে, আপনারা এই ছুটিতে এই বইগুলো পড়াবেন। একটাও পেরেন্ট যদি এই বইগুলো কিনে দেন! একটা পেরেন্টও কিনে দেন না। বাংলা বইগুলো বিশেষ করে দিই। বিকজ আমরা চাই স্টুডেন্টরা জানুক।
হ্যাঁ, আপা ঠিকই বলেছেন, ইংলিশ মিডিয়ামের বাচ্চারা বাংলা বলতে পারে না। বাংলা বলতে গেলে, বাংলা পরীক্ষা দিতে গেলে তারা বিরক্ত বোধ করে। তারা বাংলায় কথাও বলবে না। বিকজ ইংলিশ তো মাধ্যম, সেজন্য তাদের অলওয়েজ বলি 'স্পিক ইন ইংলিশ স্পিক ইন ইংলিশ, ডোন্ট স্পিক ইন বাংলা, ডোন্ট স্পিক ইন বাংলা।'
ওটা বলতে বলতে এমন একটা অবস্থা চলে আসে, ওদের সঙ্গে বাংলা মিডিয়ামের ছেলেমেয়েদের কম্পেয়ার করলে, বাংলা মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরা ওদের সঙ্গে মিশতে ভয় পায়, কমপ্লেক্স চলে আসে, ইংলিশ মিডিয়াম মিক্স করে না। বাংলা মিডিয়াম ও ইংলিশ মিডিয়াম যদি মিক্স করত তাহলে ওদের এক্সচেঞ্জ অব ভিউস, আইডিয়াস হত। বাংলা মিডিয়ামের স্টুডেন্টরা যে বাংলা পড়ছে সে বাংলাগুলো ওদের কাছে আসত। ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্টরা যে ইংলিশ পড়ছে সে ইংলিশগুলো ওদের কাছে যেত।
এগুলো কিন্তু হচ্ছে না। কারণ দুটো দলে ভাগ হয়ে গেছে। আজকাল সোসাইটিতে ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্টরা এক জায়গায় থাকে। বাংলা মিডিয়ামের স্টুডেন্টরা এক জায়গায় থাকে। হোয়াই? এরা দুটো একসঙ্গে চলুক না কেন। কেন প্যারালালি চলতে পারে না? এটাও একটা বিরাট বিষয়, আমাদের সমাজের অবক্ষয়, মূল্যবোধের অবক্ষয়, স্টুডেন্টদের অবক্ষয়।
পেরেন্টিংয়েও বিরাট একটা সমস্যা। পেরেন্টরা তাদের কাছ থেকে সময় কিনে নেন। একজন বললেন না ১ লাখ টাকা, টাকা দিয়ে সময়টা কিনে নেন। দে বোথ আর ওয়ার্কিং। সো তারা চলে যান।। বাসা খালি, ড্রাইভারের কাছে থাকছে, বুয়ার কাছে থাকছে, টাকা নিয়ে তারা কোথায় যাচ্ছে, কোন রসাতলে যাচ্ছে সেই খোঁজ নেই। একদম লাস্ট মোমেন্টে এসে, "টিচার আমাদের বাঁচান, আমার বাচ্চা তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে''– তখন আমরা কী করব?
আপা বলেছেন কাউন্সেলিং। এখন কিন্তু শুরু হয়ে গেছে বিভিন্ন স্কুলে। আমাদের স্কুলেই তো ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট আছেন। সমস্যা কোথায়? ওই আবার পেরেন্টস। তারা মনে করেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে যাব, আমার বাচ্চা কি পাগল? দে ডোন্ট ওয়ান্ট গো টু দেম। আমার স্কুলে তো সাইকোলজিস্ট এসি রুমে বসেই থাকেন। নাথিং টু ডু।
কারা যাচ্ছে? আমরা টিচাররা যাচ্ছি। প্রিন্সিপ্যাল ডেকে বলছেন,"এই তোমাদের জন্য রাখছি নাকি এটা? ওটা তো রেখেছি বাচ্চাদের জন্য।" আমরা বলি, 'বাচ্চারা না গেলে মহিলাটা বসে বসে কী করবে, আমরাই যাই। আমরাই সুযোগটা অ্যাভেইল করি।' এই হচ্ছে পেরেন্টদের সমস্যা।
ওই আপা বললেন লুকিয়ে রাখে। কতক্ষণ তুমি লুকিয়ে রাখতে পারবে? এক সময় না এক সময় এটা তো প্রকাশ পাবেই। সো হোয়াই নট এটা প্রতিকার শুরু কর, ফ্রম দ্য ভেরি বিগিনিং কেন টাকা দিচ্ছ। টাকা যখন বেশি চাচ্ছে এনকোয়ারি কর, হোয়াই, তুমি এত টাকা নিচ্ছ কেন? তারপর জিজ্ঞেস কর, তোমার ফ্রেন্ড সার্কেল কারা কারা? কাদের সঙ্গে তুমি মিশছো?
ঐশীর সঙ্গে ঐশীর পেরেন্টদের বিরাট দূরত্ব রয়ে গেছে। কতটা এক্সেটেন্টে গেলে পরে একটা মেয়ের বাবা-মায়ের উপর এত আক্রোশ থাকতে পারে, এত রাগ থাকতে পারে! তাহলে পেরেন্ট কী করেছিল, কী করেছে ঐশীকে যে ঐশী এত রাগ হয়েছে?
আপনি কি আমার উপরে এখনও রাগ, রাগ তো নয়, কিন্তু আপনার ক্ষতি করলে তারপরে না আপনি আমার উপরে রাগ করবেন। সো দ্য হ্যাড ডান। এত ক্ষতি করেছে ঐশীর, যার কারণে ঐশী বাবা-মার উপরে রাগ বা বিরক্ত। একটা খুন করা পর্যন্ত চিন্তা করতে পারে, ভাবতে পারে কোন লেভেলে গেল? কোন লেভেলে গেলে একটা বাচ্চা এ কাজটি করতে পারে?
সুতরাং ঐশীকে আমাদের ওইভাবেই হ্যান্ডেল করতে হবে। ওইভাবে দেখতে হবে। সবচেয়ে বড় যেটা করতে হবে, সামাজিক ব্যবস্থাটা আমাদের চেঞ্জ করতে হবে। আমাদের মন-মানসিকতা, আমাদের সবকিছু চেঞ্জ করে ঐশীদের মতো ভিকটিম পিউপিলদের রক্ষা করতেই হবে। তা না হলে সমাজ, বাংলাদেশ কোথায় যে যাবে উই ডোন্ট নো।
বাংলাদেশ কী করছে, আমাদের কালচার কী করছে? পাশ্চাত্য কালচারের যত রকমের খারাপ জিনিসগুলো নিচ্ছে। বাট দে আর নট টেকিং এনি ভালো থিংক। যেমন স্বাস্থ্য সংক্রামক নয়, সংক্রামক কি? ব্যাধি। আমরা ব্যাধিটাকে নিচ্ছি, স্বাস্থ্যটাকে নিচ্ছি না। পাশ্চাত্যের ওয়ার্ল্ডে কি ভালো জিনিস নেই? খারাপ খারাপ জিনিসগুলো নিচ্ছি। আর তাতে আমাদের পেরেন্টরা…
আমরা যখন মানুষ হয়েছি, বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারতাম না। আর ঐশীর মতো অবস্থা হলে এক চড় দিয়ে থামিয়ে দিত। এত টাকা কেন দেব তোর হাতে? তখন তো ওইরকম ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ওই কনটেক্সটে যদি এখন আমরা চিন্তা করি, আমরা যখন মানুষ হয়েছি তখন আমরা বাবা-মায়ের সঙ্গে এ রকম করতাম। এখন কেন আমাদের বাচ্চারা এমন করছে?
বিকজ সেই জমানা বদলে গেছে। সেই জমানা থেকে এখন এমন একটা জমানা এসেছে, এই জমানার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিজেদেরও মেন্টালিটি বদলাতে হবে। মেন্টালিটি বদলাতে হলে আমাদের বাচ্চাদের সেভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে। আমরা কেন পারব না? মানুষ ইচ্ছা করলে কী না পারে।
পেরেন্টরা চাচ্ছেন না, পেরেন্টরা সময় দিচ্ছেন না বাচ্চাদের। পেরেন্টদের জন্য ড্রাগসের দিকে যাচ্ছে, বন্ধুদের জন্য যাচ্ছে। তুমি যদি কোয়ালিটি টাইম দাও তোমার বাচ্চাকে, তাহলে সেই বাচ্চা কেন অন্যদিকে মোড় নিবে? পেরেন্টরা গোয়িং টু পার্টিস এট নাইট, গোয়িং টু দ্য শপিং। বাচ্চাকে স্কুলে ড্রপ করে শপিং-এ যাচ্ছেন। আমাদের স্কুলে এসে পেরেন্টরা জিজ্ঞেস করছেন– "আমাকে একটু ডে-শিফটে দেওয়া যায় না?" বিকজ ওই সময় দোকানগুলো খোলে, ডে-শিফটে দিলে পরে বাচ্চাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে তারপর তারা শপিং-এ যাবেন।
ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক: একটা পয়েন্ট, এটা হচ্ছে যে, পেরেন্টরা কিন্তু অনেকখানি দায়ী। যে সমস্ত বাবা-মা পুরনো ঢাকায় থাকেন, তাদের বাচ্চারা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে। বাচ্চা যখন বাড়িতে ফিরে বাংলা বলতে চায় বা ঢাকাইয়া বলতে চায়, বাবা-মা তখন বলেন, 'খবরদার! হাজার হাজার টাকা খরচ করে তোমাকে ইংলিশ শিখিয়েছি, বাড়ি এসে বাংলা বলবা?' তাহলে পাড়া-প্রতিবেশি আসবে হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে, বাচ্চা ইংরেজি বলছে, চাট্টিখানি কথা নাকি!
বাবা-মায়ের অনেক বেশি দোষ। ২-৩ বছর আগে একটি ১৬ বছরের মেয়েকে নিয়ে এসেছে তার বাবা। কাঁদতে কাঁদতে বলে 'আমার মেয়ে মডার্ন হতে চায়। ডাক্তার সাব একে ঠেকান।' মেয়ে পড়ছে ইংলিশ মিডিয়ামে। সে আমার সামনে বাবাকে শাটআপ হেনতেন বলছে।
এই যে বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের কালচারাল গ্যাপ হয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝছে যখন সন্তান বড় হচ্ছে। সন্তানের ১৮ বছর হচ্ছে, তার আগে কিন্তু বাবা-মা বুঝতে পারেন না। তারা ক্রেডিট নেন আমার বাচ্চা ইংরেজি বলছে। সব বাচ্চারা বাংলা বলছে, তারা গরিব বাংলা স্কুলে পড়ে, আমার ছেলে ইংরেজি স্কুলে পড়ে।
এটা কিন্তু শুধু এখানে থেমে নেই। আপনি যে কোনো ইউনিভার্সিটিতে যান, সেখানে দেখবেন ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট আর বাংলা ডিপার্টমেন্টের মধ্যে অনেক ফারাক। ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের টিচারদের ইগো অত্যন্ত হাই। বাংলা পড়ায় যারা তাদের সঙ্গে বেশি সম্পর্ক নেই। তারা বসে বসে মার্কেজ থেকে শুরু করে যত মডার্ন রাইটার আছে, পয়েট আছে তাদের কথা আলোচনা করছেন। আমি দেখেছি, ইংলিশ চিটাররা বসছেন একটা কর্নারে; সব ইংলিশ ইউনিভার্সিটির টিচাররা সেখানে। আর যেগুলো অপরা বপরা, বাংলা, ভূগোল, ইতিহাস তারা একদিকে।
অর্থাৎ এই যে গ্যাপ। এই ল্যাঙ্গুয়েজ কিন্তু আমাদের সাম্রাজ্যবাদী এই সব বিহেভিহার শেখাচ্ছে। আপনি অবাক হয়ে যাবেন যে, ইংলিশ মিডিয়ামে যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা পড়ে ওখানকার টিচাররা কিন্তু অত্যন্ত হাই-ব্রাও। কিন্তু এটা সমাজের একদিকে দেখলে চলবে না। সবদিকেই এই অভিশপ্ত পরিবেশ হচ্ছে।
দর্শকদের প্রশ্ন: একটা প্রশ্ন, আপনাদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে মানে কার্যক্রম শুরুর পূর্বে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় কিনা?
শেবা তাসমিন হক: জাতীয় সঙ্গীত, সুরা ফাতেহা ট্রান্সলেশন, ট্রান্সলেশনটা বাংলায় নয়, ট্রান্সলেশনটা ইংলিশে– প্রত্যেকদিন অ্যাসেম্বলিতে গাওয়া হয়। জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা এগুলো। তারপর আপনার একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, বিজয় দিবস এগুলো পালন করা হয়।
ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি : কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আমি দেখেছি, নিশ্চয়ই অনেকের অভিজ্ঞতা আছে যে এত গাদাগাদি করে বাচ্চারা ওখানে বসে। সেখানে ফ্যান থাকে না, এসি থাকে কোথাও কোথাও, কোনো মাঠ নেই, কিছুই নেই। আমার নিজের অভিজ্ঞতা আছে আমাদের বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে। আসলে আমাদের ভালো পরিবেশটা দেওয়াটা কিন্তু জরুরি। একটা শিশুর যেমন নিউট্রিশন প্রয়োজন তার পুষ্টির জন্য– তার মানসিক নিউট্রেশনও কিন্তু প্রয়োজন আছে।
মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু : একটু আগে কথাটা উঠেছিল, যে রিমান্ডে থাকলে পরে পুলিশ মিডিয়াকে বলতে থাকে যে সে এসব স্বীকারোক্তি করেছে। এই মেয়েটি বন্ধুদের সঙ্গে সারারাত এই করত ওই করত, ১ লাখ টাকা ইত্যাদি ইত্যাদি, সাংবাদিকরা রিমান্ডে থাকার ঘটনা পুলিশের কাছে কতটুকু বিশ্বাস করবে? আর সাংবাদিকরা রগরগে স্টোরি কেন করে?
আফসান চৌধুরী: বিষয়টা হচ্ছে যে, আমাদের দেশে অজ্ঞতার চর্চাটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আমাদের নিজেদের ভাবনায় যেটা আসে, সেটা আমরা বলতে ভালোবাসি এবং যেটা আমরা অলরেডি ধরে নিচ্ছি যে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল মানে খারাপ। এতক্ষণ কথা হল, বিশেষ করে উনার কথাতেই বোঝা যাচ্ছে– ইংরেজি মিডিয়াম বাংলা পড়ায় না, ইংরেজি মিডিয়াম এই করে না।
আমি তো ইউনিভার্সিটিতে পড়াই, একাধিক ইউনিভার্সিটি, বিদেশি ইউনিভার্সিটিতেও পড়িয়েছি। আমার মনে হয় না, আমি এ রকম বাংলা মিডিয়ামের কোনো ছেলেমেয়ে পাব যারা ওখানে পড়াশোনা করে। পড়াশোনাটা পারিবারিক এবং সাংস্কৃতিক চর্চা।
তো আমরা এ ইমোনাইজিং যেটা করি ইংরেজি মিডিয়াম মানে ড্রাগ-অ্যাডিক্ট। আমার ইউনিভার্সিটিতে ৯০ পার্সেন্ট বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রী। কারণ ইংরেজি মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রীরা তো দেশি ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চায় না। ড্রাগ অ্যাডিকশনটা ইজ ভেরি হাই। ইয়াবা অ্যাডিকশন ইজ ভেরি হাই। ইয়াবা অ্যাডিকশন মেয়েদের মধ্যে বেশি। কারণ ইয়াবা খেলে বোঝা যায় না।
আমি যখন লিখেছি, আমাকে লিখেছে আপনি একটা খুনির পক্ষ কেন নিচ্ছেন। তার মানে হচ্ছে ঐশী খুনি হয়ে গেছে। পুলিশ কী করছে, পুলিশ, এই যে ও খুনি হয়ে গেছে, ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ে, পার্টি করে, দেয়ারফোর ও খারাপ। অতএব তাকে যেটা বললেন, বিভূতিভূষণ পড়ে না, এত বড় পাপ করার পর তাকে তো আর ক্ষমা করা যায় না।
ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক: আই অবজেক্ট। ইটস এ ভিসিয়াস স্টেটমেন্ট। আমি সেটা বলেছি না। ইউ হ্যাভ টু থিংক অ্যাবাউট ফর্টি ইয়ার্স অ্যাগো হোয়াট হ্যাপেন্ড ইন দ্য সোসাইটি। আই এম নট টকিং অ্যাবাউট টু থাউজেন্ড ইলেভেন, আই এম টকিং অ্যাবাউট নাইনটিন থার্টি, ফর্টি সেভেন, ফর্টি এইট, ফিফটি। আমি কি এখনকার সমাজ সম্পর্কে বলছি? এখানে কাউকে খোঁটা দেওয়ার জন্য বসিনি। আমরা এখানে আমাদের অ্যাংজাইটি এক্সপ্রেস করার জন্য বসেছি। ও যা পড়েছে তা আমি পড়িনি। তাই বলে ও খারাপ নাকি …।
আফসান চৌধুরী: যে জিনিসটা এসেছে, ইংরেজি মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রীরা সবাই খারাপ। ওরা ড্রাগ নেয়, এটা প্রত্যেকটা নিউজে এসেছে। বিষয়টা হচ্ছে কি, পুলিশ তো এটাই ধরে, পুলিশ তো আমাদের মতো মানুষ। পুলিশ যে খবরগুলো পৌঁছে দিচ্ছে সেটা হচ্ছে যেটা মানুষ জানতে চায়। মিডিয়া কী জানতে চায়? মিডিয়া রগরগে জিনিসই জানতে চায়। মিডিয়া কী করছে, এমন একটা পাঠকের কাছে পৌঁছেছে খবরগুলো …
মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু : আফসান ভাই, পুলিশের সুবিধা হয় সে কথাটায় …
আফসান চৌধুরী: ক্রাইম রিপোর্টিং করলে আপনার পুলিশ সোর্স লাগবে। কিন্তু আপনি যদি সীমাটা না রাখেন আমি পুলিশের সোর্সকে এ কথাগুলো বলতে দেব কি দেব না– মিলিটারি সোর্স যেমন– হ্যাঁ, আমি সেটা– তাহলে সেই জিনিসটা করতে গেলে কী করতে আপনাকে?
আপনার কিছু গাইডলাইন থাকতে হবে যেটা আপনাকে মানতে হবে। গাইডলাইন যদি একজনও ভাঙে তাহলে আপনি এটা মানবেন না। আমার মনে আছে আমি যখন বিবিসির সাংবাদিক ছিলাম, আমাদের একটা স্টোরি এল, যে এরশাদকে বিচার করা হবে ওই চিটাগাং মার্ডার কেসে, যে ক্যু হয়েছিল মেজর মঞ্জুর যে মার্ডার কেস। আমি লন্ডনকে জিজ্ঞাস করলাম, 'লন্ডন, কী বলব?' লন্ডন বলল,"যতক্ষণ না কনফারমেশন পাই আমরা দেব না।" সো ইউ ওয়েটেড। কিন্তু তারপর কী হলো– সোর্স কিন্তু 'লন্ডন তুমি দাওনি কেন আমি তোমাকে বলছি।'
সো প্রেসারটা কিন্তু উইদ ভেরি ডিপ অন জার্নালিস্ট। কিন্তু পুলিশ কী করে? পুলিশ ইউজ করে। পুলিশ ভাবে যে সাংবাদিকরা তো খবরের জন্য বুভুক্ষু হয়ে রয়েছে, ওকে যদি দিয়ে দিই, ও ওটা পৌঁছে যাবে– এটা হয়েছে সংকট। আমাদের মিডিয়ার মধ্যে যে সংকট ডিমান্ড এন্ড সাপ্লাইয়ের একটি বিষয়। আমরা যদি এটাকে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে না দেখি, ইন্ডাস্ট্রির একটা রেগুলেটর থাকে, রেগুলেটরের আইন কিন্তু ভাঙা যায়। কিন্তু রেগুলেটর তো থাকে। আমরা তো মিডিয়াকে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে দেখছি না।
মিডিয়ায় যারা ইনভেস্ট করে, টেলিভিশনে বিশেষ করে, আপনি যদি নামগুলো দেখেন ৯৯ পারসেন্ট, ৩ টা ছাড়া প্রত্যেকটা লস খাচ্ছে। তার মালিক ছাড়া। তার মালিক একেবারে ভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে। সে টেলিভিশনে অ্যাস্টাব্লিশ করছে কারণ সে একটু ইজ্জত চায়। সে ইজ্জতটা কাকে কাকে দেবে, টক শো করবে অথবা সে বিনোদন করবে অথবা নিউজ করবে। নিউজ করতে গেলে অত নিউজ পাবে কোথায়? বাংলাদেশে এমন তো কোনো নিউজ জেনারেট হয় না। সো একই নিউজের জন্য সবাই কমপিট করছে।
যদি মিডিয়ার গাইডলাইন না থাকে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল গাইডলাইন না থাকে– তো ভাঙবেই, আজকেই হোক কালকেই হোক। পুলিশ ইউজ করে, পুলিশ একটু নার্ভাস থাকে সবসময়। পুলিশ খুব দ্রুত কিন্তু তথ্যটা পেয়ে যায়। তথ্য পাওয়ার পরে পুলিশের উপর তখন রাজনৈতিক চাপটা হয়– এটা ধরতে পারবে না, এটা বলতে পারবে না।
সাগর-রুনি ইজ দ্য ক্লাসিক্যাল একসাম্পল। কারণ পুলিশকে তো নিজেকেও বাঁচতে হবে। সাংবাদিক মারার পরে সাংবাদিকদের চোখে নিজেদের একটু শুদ্ধ করার প্রচেষ্টা দেওয়া হচ্ছে এ ঐশী প্রোগ্রাম। না ভাই, তুমি আমার সঙ্গে আছো, তুমি আমার বন্ধু।
সাগর-রুনির সময় আমি তখন বিডিনিউজে কাজ করি, কয়েকজনেই আমার কাছে খবর নিয়েছে যে ভাই, আপনাদের আগে থেকেই বলে দিতে চাই, 'আমরা এগুলো এগুলো জানছি, আমরা এগুলো কিন্তু বলতে পারতেছি না।' সো ওয়ানস ইউ হ্যাজ অ্যাসটাবলিশ দ্য কালচার, দ্যাট ল এন্ড ওর্ডার জিনিসটা রাজনৈতিক বিষয়; পুলিশের ইনভেস্টিগেশন বিষয়টা রাজনৈতিক বিষয়– তখন তো ইনফরমেশনের ব্ল্যাক মার্কেটটা তৈরি হবে।
পুলিশের দোষটা কী? পুলিশের চাকরি রাখতে হবে না? পুলিশ যদি বলে যে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিকে ধরে ফেলব– দেখা গেল ৪৮ ঘণ্টার পরে খুনি ধরছে না বা এক সপ্তাহ, এক মাস পরেও– তখন পুলিশের কী হয়? পুলিশের উপর ট্রিমেন্ডাস প্রেশার তৈরি হয়। তখন এই প্রেশারটাকে সামলাবার জন্য পুলিশ এ কর্মকাণ্ডগুলো করে।
আমি স্ট্রিট রিপোর্টিং যখন করেছি, আমি দেখেছি, পুলিশ কী পরিমাণ ভয় পায় উল্টোদিক থেকে যখন লোক আসে। ভয়ে কাঁপতে থাকে। কিন্তু পুলিশের তো কিছু করার নেই। ওকে ধরতেই হবে, পেটাতেই হবে, মারতেই হবে।
এই সকল সমস্যাটাই শুরু হয় যখন আমাদের আইন-শৃঙ্খলাটাকে আমরা দুর্বল করে ফেলি। আমাদের ল এন্ড অর্ডার সিস্টেম ইজ ভেরি উইক। আমাদের রুল অব ইজ ইভেন উইকার। আমরা চাই, ইমেজ যেটা আমাদের মাথায় আছে, ওই ইমেজটাকে প্রতিষ্ঠা করতে। তো পুলিশ ওই ইমেজটাকে সহায়তা করে পার পেয়ে যাচ্ছে। পুলিশ ইজ ভেরি হ্যাপি। পুলিশের কোনো অসুবিধা আছে? পুলিশ দেখাবে যে একে খারাপ, সবাই তো দেখতে চায় একে খারাপ হিসেবে।
ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক: ইয়াবা ট্যাবলেট ছেলেরা বেশি খায়। ইউনিভার্সিটির ইংলিশের টিচার আমার কাছে আসে যে সে ইয়াবা ট্যাবলেট খায়। সে এখান থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। মেয়েরা যেটা খায় সেটা ঘুমের ওষুধ যেটা বিনা প্রেসক্রিপশনে দোকানে কিনতে পাওয়া যায়।
বেবী মওদুদ: এখানে আমরা দেখি যে যখন থেকে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো খবর দেওয়া শুরু করেছে, বিটিভি ছিল একমাত্র আগে। বিটিভির পরে যখন বেসরকারি টিভি চ্যানেল পানির মতো হু হু করে এসে গেল। তখন মনে হয়েছে যেন, কমপিটিশন শুরু হয়ে গেছে। কে কত রগরগে নিউজ দিতে পারে। কে কত দ্রুত আসল খবরটা দিতে পারবে, সত্য খবরটা দিতে পারবে।
সত্য খবর দেয় না তা একেবারে নয়। কিন্তু কিছু কিছু খবর এমন দিয়ে দেয় যেটা সমাজে বলেন, রাষ্ট্রে বলেন, বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। এই যেমন রানা প্লাজার সময় আপনারা দেখেছিলেন যে, রেশমাকে যখন উদ্ধার করে নিয়ে আসা হল, তখন একটি চ্যানেলের যিনি নিউজের ইন-চার্জ, যিনি সবচেয়ে দায়িত্বশীল সেই ব্যক্তি তিনি বলছেন যে "রেশমাকে তো খুব ফ্রেশ দেখাচ্ছে।"
আমি নিজে রেশমার গায়ে হাত দিয়ে দেখেছি, ঠিক তার এক ঘণ্টার মধ্যে নিজে আমি ব্যক্তিগতভাবে গিয়ে। রেশমার গায়ে হাত দিয়ে দেখেছি, কত খসখসে হয়ে গেছে চামড়া। খালি মাথা ঘোরাচ্ছে, খালি মাথা ঘোরাচ্ছে, এত আলো দেখার পর, ১৭-২০ দিন পর যদি কেউ আলো দেখে, কেউ যদি বাতাসের স্পর্শ পায়, তাহলে তার অবস্থা কেমন হয়, আপনারা চিন্তা করেন?
তো দোষ তো আমাদের। আমাদের প্রশিক্ষণ নেই, আমাদের শিক্ষা নেই, আমাদের এডিটর বা মালিক বলেন, এই তোমার নিউজ যেন আজকে হিট করে, এ ধরনের নিউজ দিবা। সবাই লাইন খুঁজি আমরা, অনেক সময় নিজেরা বানিয়েও ছেড়ে দিই। তারপর যদি লেগে গেল তো লেগে গেল, এমনও হয়।
আমি নিজে দেখেছি অনেক সময় কী করব এমন ছেড়ে দিয়েছি যে, এটা হতে পারে– ঠিকই হয়েছে। এ রকমও হয়। টেলিভিশনে সবাই চেহারা দেখাতে চায়, পুলিশের সবাই কথা বলতে চায়, পলিটিশিয়ানারা সবাই কথা বলতে চায়। বাইরের লোকজন বলেন, সবাই কথা বলতে চায়।
কিন্তু আমার তো প্রশিক্ষণ নেই, আমি গিয়ে হয়তো সামনে মাইক ধরে বলি। সে হয়তো বলছে, 'কী বলব?' 'আপনার যা ইচ্ছা বলেন।' তো সে যা ইচ্ছা বলে। অফিসে এসে যে খবরগুলো পায় সেগুলো ক্যাচি অংশ সে শুনিয়ে দেয়।
কিন্তু আমরা তো কিছু কিছু কাজ করেছি। বিবিসিতে যখন কাজ করেছি, দুই মিনিটের মধ্যে একটা রিপোর্ট দিতে হবে। সেই রিপোর্টটায় হয়তো আমি পাঁচজনের ইন্টারভিউ নিয়ে এসেছি, আমার প্রশিক্ষণ আছে যে ১০ জনের নিবা দরকার হলে, ১০ জনের মধ্যে থেকে কোনটা ভালো সেখান থেকে ২টা চয়েস করবা। আমার কাজের জন্য ২০ জনকে ইন্টারভিউ নিব, কিন্তু দেব হয়তো আমি দুজনের। কারণ দিবই বা কখন, আমার নিজেরও তো কথা বলতে হবে।
কিন্তু এখন পত্রিকা বলেন, টেলিভিশন বলেন, খালি কে কত বেশি প্রচার দিতে পারবে। এখন এটা পণ্য হয়ে গেছে। খবর বলেন, গণমাধ্যমের কাজ বলেন সবই এখন ব্যবসা হয়ে গেছে।
মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু : আমরা ঐশীর কথা সর্বক্ষণ বললাম, কিন্তু শুরু করেছিলাম তার চেয়েও কমবয়সী একটি মেয়ে, সে হয়তো কোন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে না, সে ওই বাড়ির গৃহপরিচারিকা। সুমি খাদিজা, তার ক্ষেত্রে ১৭-১৮-ও তো প্রশ্ন উঠছে না, রিমান্ডে চলে গেল। কী অবজারভেশন হবে এটার?
ইউএম হাবিবুন নিসা: আমি আগে তো আগেই বলেছি, রিমান্ড ইস্যুটা আমি বলেছি, আমি ক্লিয়ার করি, আমি একটা ছোট্ট গল্প বলতে চাই– এ আচরণটা পুলিশ, গণমাধ্যম এবং হয়তো অনেকেরই আমাদের ফসল। এটি আমি বলতে চাই আমাদের ইয়াং জেনারেশন অন্যান্য যারা আছেন, এরশাদ শিকদারের গল্পটা। আমি সব জায়গায় এটি বলি আজকেও খুব সংক্ষেপে বলব।
১৩ বছর বয়সে এরশাদ শিকদারকে প্রথম ছোট্ট একটা ছিনতাইয়ে পুলিশ তাকে অ্রারেস্ট করল। তারপর ৪৮ বছর বয়স পর্যন্ত এরশাদ শিকদার পুলিশ কাস্টডিতে গেছে আর আসছে, গেছে আর আসছে। তার সঙ্গে আমরা কে না ছিলাম? রাজনীতিবিদরা ছিলাম, সমাজপতিরা ছিলাম, ল ইয়ার ছিল, পুলিশ ছিল।
হাজার হাজার অর্থনীতির চোখ থেকে বিশ্লেষণ করি এরশাদ শিকদারের জীবন– ১৩ থেকে ৪৮– আমরা কত কত কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছি এরশাদ শিকদারের বিরুদ্ধে, পক্ষে এবং সৌজন্যে কখনও কখনও। সেই এরশাদ শিকদারকে ধরে এনে শেষ পর্যন্ত আমরা ফাঁসি দিয়েছি। ১৩ বছর বয়সে যদি এরশাদ শিকদারের পাশে এনাদের মতো কেউ দাঁড়াত, স্টেট যদি সত্যিকার অর্থে কাস্টডি হত– তাহলে এরশাদ শিকদার আর হত না।
আপা যে বলছিলেন না, যে ধীরস্থিরভাবে ঐশী চাকু এনেছে, এই এনেছে, এই এনেছে, কেন এনেছে? কেন এনেছে এগুলো বিশ্লেষণ করা জরুরি, ঐশী নয়।
ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি : পুলিশের সংখ্যা কিন্তু দেশের জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম এবং এই যে বিষয়গুলো, এ ঘটনাটাই যদি আমরা উল্লেখ করি, আমরা মা-বাবাকে, আমরা জানি না এখনও খুনি কে? এখনও তাদের কাজ সমাপ্ত হয়নি। একজন আইনজীবী হিসেবে আমি এখনই বলতে পারি না কে খুনি। যেদিন মামলার তদন্ত সমাপ্ত হবে, তদন্ত রিপোর্ট আসবে সেদিন আমরা ওই সিদ্ধান্তে যেতে পারি।
কিন্তু আমাদের এই যে পুলিশ বিভাগ কিংবা যারা তদন্ত করে থাকেন, তাদের কিন্তু দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে এবং পূর্বের ঘটনাটিকে কখনওই আমরা কিন্তু সামনের দিকের ঘটনার জন্য অনুসরণ করে থাকি না। ল অ্যান্য অর্ডার সিচুয়েশনটি কিন্তু তখনই সফল হবে যখন চর্চার মাধ্যমে সেটিকে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।
আমি শুধু একটি কথাই বলতে চাই, যেদিন ঐশী গ্রেপ্তার হল ঠিক তার পরের দিন খুব ভালো একটি জাতীয় দৈনিক যেটি আমি নিজেও পড়ে থাকি, প্রতি সকালে পড়ি, লিখল যে ঐশী, তারপর 'ই' প্রত্যয় যোগ করল– ঐশীই খুনি। খুব ভালো একটি পত্রিকা, সে তার প্রথমে হেডলাইন করল– 'ঐশীই খুনি'। ওই পত্রিকা সেটি করতে পারে কিনা? কোট না, পত্রিকার হেডিং।
আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি ওখানে নিচে কোনো পুলিশের নাম ছিল না, কিন্তু পত্রিকাটি ওভাবে হেডিং করেছে। যদি এটি পুলিশেরও কোট হয়ে থাকে, আর পত্রিকাটি যদি সেখানে না লিখে– এটা কিন্তু এক ধরনের প্রতারণা তার পাঠকের সঙ্গে।
সুতরাং এ দায়িত্ববোধ থেকে নীতিমালার কথাটি এসেছে, আমি আফসান ভাইয়ের কথার সূত্র ধরেই বলতে চাই– নীতিমালা কিন্ত শুধু কোনো ব্যক্তি, কোনো রাষ্ট্র বা সমাজ এককভাবে তৈরি করে না। প্রতিটি নীতিমালার ক্ষেত্রে কিন্তু ওই বিষয়ে যারা সংশ্লিষ্ট, অভিজ্ঞ পরামর্শক তাদেরকে নিয়ে তৈরি করা হয়।
সুতরাং আমার মনে হয় এখন আমাদের সময় এসেছে, এসব থেকে বেরিয়ে এসে নীতিমালা তৈরি করা– গণমাধ্যম কতটুকু প্রচার করতে পারবে, ইভেন তদন্ত কর্মকর্তা, তদন্ত চলাকালীন সময়ে কতটুকু প্রকাশ করতে পারবে, কতটুকু পারবে না সেই বিষয়টি আমাদের কিন্তু সমাজ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। আমাদের এখান থেকেই শিক্ষা নিতে হবে।
ফরিদা আকতার : আমি পুলিশের রোল এবং বিচার এটা নিয়ে খুব ছোট্ট একটা স্টোরি বলতে চাই। একবার আমি আমেরিকা গেছি, তখন দেখি টেলিভিশনে খুব হট একটা নিউজ আসছে বার বার। নিউজটা ছিল– একটা ছেলে ইউনিভার্সিটিতে যখন কেউ ছিল না, তখন সে লাইব্রেরিতে গিয়ে আরেকটি ছেলেকে মেরে ফেলেছে, কোনো কারণ ছাড়াই।
তখন পুলিশ প্রথমে দেখল ন্যাচারেলি ওর ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে কিনা। সব ঘেঁটে দেখা গেল অসম্ভব ভালো একটা ছেলে। তার খুন করার কোনো মোটিভ নেই, কিচ্ছু নেই, কোনো কিছু প্রুভ করে না যে ও খুনি হতে পারে। কিন্তু নিজে থেকে কনফার্মলি বলছে, "আমি খুনি।"
এখন পুলিশ আর এটা ঘাঁটল না। সাইকোলজিস্টদের হাতে এটা দিয়ে দিল যে এটা কেন হতে পারে। সাইকোলজিস্টরা দেখল, বাচ্চাটা আসলে অ্যাডাপডেট একটি ছেলে। ছেলেটির মা-বাবা দুজনেই জাজ এবং যথেষ্ট ভালো একটি ফ্যামিলির ছেলে। কিন্তু এই মা-বাবা দুজনেই জানে না যে কাদের বাচ্চাকে ওরা অ্যাডাপ্ট করেছে। কারণ ওরা একটি হোম থেকে তাকে নিয়েছে এবং হোম পরিচিতিটা বলেনি।
কিন্তু পুলিশ যখন গিয়ে খুঁজে বের করল, ও একটা সিরিয়াল কিলারের ছেলে। সাইকোলজিস্টরা এখান থেকে যেটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করছিল– জেনেটিক্যালি ক্রাইম জিনিসটা আমাদের জিনের মাধ্যমে বাহিত হতে পারে। এই কথাটা ওখানে ছিল। কিন্তু দেখেন পুলিশের রোলটা দেখেন।
আপাকে ছোট্ট দুটো সাজেশন দিতে চাই। সাইকোলজিস্টরা বসে থাকবে না যদি টিচাররা বাচ্চাদেরকে পাঠায়। আর অ্যাকোর্ডিং টু সিআরসি, পেরেন্টদেরও রাইট আছে পেরেন্টিং প্রোগাম পাওয়ার। কিন্তু কে অ্যারেঞ্জ করছে পেরেন্টিং প্রোগামে? স্কুলে শুধু পেরেন্টস মিটিং ডাকা হয় বাচ্চাদের রেকর্ড দেখানোর জন্য।
শেবা তাসমিন হক: আমরা তো সাইকোলজিস্ট রেখেছি। যখনই কোনো সমস্যা হচ্ছে তখনই টিচাররা রেফার করে দিচ্ছি তুমি ওখানে যাও। কিন্তু স্টুডেন্টরা যখন বাসায় গিয়ে বলছে, মিস তো আমাকে এখানে যেতে বলছে। তখনই পেরেন্টরা এসে বলছেন, আমার বাচ্চা কি পাগল, আপনারা কেন ওকে ওখানে রেফার করেছেন? পেরেন্টরা আমাদের সহযোগিতা করছেন না।
ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক: পেরেন্টদের কাউন্সেলিং দরকার। আপনাদের কি মনে আছে ইডেন কলেজে পরপর কয়েকটা আত্মহত্যা হয়েছিল– তখন আমরা সেখানে গিয়ে বলেছি, আপনারা দয়া করে সাইকোলজিস্ট আনান, কাউন্সেলিং করান। তারা সাইকোলজিস্ট এনেছিল, কাউন্সেলিং করানোয় ওখানে বিগত দুই বছরে কোনো আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি। নইলে কিন্তু আত্মহত্যা নেশার মতো। ও আত্মহত্যা করেছে, আমিও করব, আমিও করব। তো সেইটা আমরা ঠেকিয়েছি।
মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু : শাকিল এমন কিছু বলেন যেন আমরা সমাপ্তির দিকে যেতে পারি।।
শাকিল ফয়জুল্লাহ : সংক্ষেপে আমি আমার কথাগুলো বলার চেষ্টা করি। আজকের বিষয়বস্তুর কারণে কিংবা ঐশী কোনো প্রিভিলেজড ফ্যামিলি থেকে এসেছে বোধহয় আমরা ঐশীদের নিয়ে কথা বলি, সুমিদের নিয়ে আমরা কথা বলি না। সবসময় যেটা হয়– যারা প্রিভিলেজড ফ্যামিলির– আগে যেমন সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের সময়– যেহেতু তারা মিডিয়ার লোক, ইন-আ-ওয়ে তারা প্রিভিলেজড– সো এ কারণে তাদেরকে নিয়েও কথা হয়েছে।
আমি একটা ছোট্ট উদাহরণ দিতে চাই যে, এর আগে আপনারা টিভির কল্যাণে দেখেছেন যে বোমা মিজান বলে একজন ছিল, জেএমবির। তাকে যখন ধরা হল তখন সব জায়গায় লাইভ দেখানো হল। সে কীভাবে বোমা মারছে, কোনদিক থেকে মারছে, কতটুকু ধোঁয়া উড়ছে এবং সাংবাদিকরা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব নিয়ে দেখাল, খুব মজা পেয়েছিলাম দেখে।
তারপরে সবচেয়ে লজ্জা পেয়েছিলাম যেটা দেখে, তার দুই দিন পরে ফলোআপ রিপোর্টে দেখাল তার স্ত্রী তার দুই বাচ্চা ঢাকা মেডিকেলে প্রিজন সেলে আছে। সেখানে তার ৪ বছরের বাচ্চাকে সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করছে, "তোমার কাছে কেমন লাগে, তোমার বাবা যে বোমা বানায়?" এটা কতটুকু এথিকাল?
এটা তো আমরা মানি না, আমরা বোমা মিজানের ছেলের কথা কেউ কোনোদিন বলি না, আমরা ঐশীদের কথা বলি, আমরা মেঘদের কথা বলি। কিন্তু সেও বাচ্চা, এরাও বাচ্চা আমরা কোনো বাচ্চার কথা বলি না।
সো আমাদেরকে এই জিনিসটা মাথায় রাখতে হবে যে সুমিও একটা বাচ্চা, সুমিকে নিয়েও তো আমরা কথা বলতে পারতাম। সুমিকে নিয়ে আমরা কথা বলি না। আমরা বলেছি ঐশীকে নিয়ে, সুমি কী দোষ করেছে? সে গরিব বলে, সে কাজের মেয়ে বলে? এজন্য সে শিশু নয়, তার কোনো পরিচয় নেই?
আই অ্যাম সরি আই অ্যাম নট টু অ্যাকসেপ্ট দ্যাট। তারপরে আমি বলতে চাই যে আমি স্ট্রংলি অপোজ করি লিগ্যাল পয়েন্ট অব ভিউ থেকে এবং নিজের ব্যক্তিগত পয়েন্ট অব ভিউ থেকে– যতক্ষণ পর্যন্ত না তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হচ্ছে তাকে আমি মার্ডারার বলব না। এটা ভায়োলেট করা হচ্ছে তার রাইটসকে এবং তাকে হিউমিলিয়েট করা হচ্ছে। দায়িত্ববান মানুষ এটা কোনো দিন কখনও করতে পারেন না।
আইনও তাই বলে এটা করা উচিত নয়। এ জিনিসটা আমি সম্পূর্ণভাবে অপোজ করি। তার বিরুদ্ধে যত কিছু লেখা হয়েছে, কত রগরগে ঘটনা লেখা হয়েছে, ইয়াবা খেত, কত কিছু খেত–আমি নিজে তাকে ইয়াবা খেতে দেখেছি? আপনি দেখেছেন? আপনারা কেউ দেখেছেন? তাহলে আমরা কেন বলব সে ইয়াবা খেত? আমরা কি দেখেছি সে তার বাবার কাছ থেকে ১ লক্ষ টাকা নিয়েছে? আর ১ লক্ষ টাকার নেওয়ার রসিদ আমরা পেয়েছি? তাহলে কেন আমরা বলছি সে ১ লক্ষ টাকা নিয়েছে?
যে কোনো জায়গা থেকে এটা আসতে পারে। ইট ইজ নট প্রুভড ইয়েট। এটা হল ইনফরমেশন যেটার বেসিসে আমরা তাকে ক্যারেক্টারাইজ করতে পারি না, আমরা তাকে ডেভিল বানাতে পারি না, তাকে ডেমোনাইজ করতে পারি না। সো দিস ইজ রং।
আপনারা সবাই আমার থেকে প্রাজ্ঞ। আপনাদের কাছ থেকে আমার অনেক কিছু শেখার আছে। কিন্তু আমি ছোট বলে আমার কাছে যেটুকু ভুল মনে হয়েছে সেটুকু আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
তারপরে যে বিষয়টা আছে সেটা হচ্ছে আফসান ভাই কিছুক্ষণ আগে বলেছিলেন, মিডিয়া এবং জাজ মানে জাস্টিজ সিস্টেম এরা হচ্ছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আফসান ভাই খুবই শ্রদ্ধার একজন মানুষ। তার আঙুল ধরেই আমি মিডিয়াতে এসেছিলাম। আমি এ জায়গায় আপনার সঙ্গে অপোজ করি। জাজমেন্টের কথা আমি জানি না। কিন্তু মিডিয়া বোধহয় অনেক বেশি ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। তাদের একটু মাটিতে নেমে আসার সময় এসেছে।
আমি এখানে অপোজ করছি কেন? কারণ হচ্ছে, মিডিয়া যখন ঐশীকে নিয়ে রিপোর্ট করছে, বোমা মিজানের ছেলেকে ইন্টারভিউ করছে কিংবা মেঘকে ইন্টারভিউ করছে তখন সে কি কোনোদিন এক সেকেন্ডের জন্য ভাবে যে, তার ছেলেকে যদি ইন্টারভিউ করত, তার কেমন লাগত? তার বোনের মেয়েকে যদি ইন্টারভিউ করত এ রকমভাবে, তার কেমন লাগত? তার ভাইয়ের সন্তানকে যদি এমন করত, তার কেমন লাগত?
মিডিয়া ভাবে তারা অনেক বেশি ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছে। আমার কাছে মনে হয়, নৈতিকতার বিষয়টি ওই আমাদের রুলস প্রসিডিং এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, এগুলোর ভেতরে সবচেয়ে বড় নৈতিকতার কথাটি থাকা উচিত– নিজের সন্তান বা নিজের পরিবারের সবচেয়ে আদরের শিশুটিকে যেভাবে দেখলে আপনার কষ্ট হবে, সেভাবে করে কোনো শিশুকে কোনোদিন দেখাবেন না, সেভাবে কোনো শিশুকে তার জন্য ওই রকম কোনো লেখা লিখবেন না।
আমার মনে হয়, মিডিয়ার জন্য নৈতিকতার যে সংজ্ঞা এটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলে যথেষ্ট। এর বাইরে আর কোনো কিছুর দরকার হয় না। এজন্য তাদেরকে মাটিতে নেমে আসা উচিত।
আফসান চৌধুরী: আই থিং, ইউ গট মি রঙ। আমি যেটা বলেছি, যে সাংবাদিক ও বিচারকদের কোনোভাবেই প্রভাবিত হওয়া যাবে না। তাদেরকে প্রভাবিত হওয়া যাবে না। সব কিছুর ঊর্ধে্ব থাকতে হবে। রিচারক যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে ব্যাটারে আমি ফাঁসি দিমুই– তাইলে তো সব শেষ হয়ে গেল।
ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি : বিচারক যদি ভুল করে তাহলে উপরের কোর্টে যাওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু সাংবাদিকরা যদি ভুল করে ফেলে তবে শুধরানোর সুযোগ থাকে না।
আফসান চৌধুরী: এই কারণে বলছি সাংবাদিক আর বিচারককে মানুষ থেকে একটু আলাদা থাকা দরকার। সাংবাদিকরা যদি পাবলিক ইস্যুগুলো আছে নিজেকে তার অংশ মনে করে তবে তা তার রিপোর্টে চলে আসবে। তাহলে সেই রিপোর্টিংটা ঠিক হবে না।