Published : 12 Feb 2014, 05:41 PM
প্রায় প্রতিদিনের সংবাদপত্রেই ছাত্রলীগ সম্পর্কে নেতিবাচক খবর ছাপা হচ্ছে। এমন নয় যে ঘটনা ঘটছে না, তা সত্ত্বেও সংবাদমাধ্যমগুলো বানোয়াট খবর ছেপে দিচ্ছে। ছাত্রলীগ খবর তৈরি করছে এবং তা প্রকাশ পাচ্ছে। ছাত্রলীগের কাজকর্ম সরকারের জন্য বিব্রতকর হলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করার কোনো উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় না। ছাত্রলীগ একেকটি অপরাধমূলক অঘটন ঘটায়, তা নিয়ে হৈ চৈ হয় তারপর আবার নতুন আর একটি ঘটনার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর যেন কিছুই কারও করার থাকে না।
ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী-মাস্তানির অভিযোগ উঠলে অনেক সময় বলা হয়ে থাকে যে, যারা অপরাধ সংঘটিত করছে তারা প্রকৃত ছাত্রলীগার নয়, তারা অনুপ্রবেশকারী। ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারীদের কেন জায়গা দেওয়া হয়, কেন তাদের অপরাধের দায় ছাত্রলীগকে বহন করতে হয় সে প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া যায় না।
কয়েক মাস আগে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ নামে একজন সেলাই কর্মীকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ডে ছাত্রলীগের কর্মীরা জড়িত বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর, প্রথমে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের রাজনৈতিক পরিচয় আড়াল করা যায়নি। তাদের গ্রেপ্তার করে বিচার করা হয়েছে। এটাই হওয়া উচিত। উচিত কাজটি না হওয়াতেই নিন্দা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। সরকারকে বিপাকে পড়তে হয়।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে সে সরকারের সামনে রয়েছে দেশে সুশাসন নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ। মোটামুটি দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে এবং আগের মন্ত্রিসভার বিতর্কিত-সমালোচিতদের নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে যাত্রা শুরু করায় শেখ হাসিনা প্রশংসিত হয়েছেন।
তবে আলামত দেখে মনে হচ্ছে, এই নতুন সরকারের সামনে বাড়তি উপদ্রব হিসেবে দেখা দিবে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণ। আগের সরকারের আমলেও ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারকে বার বার বিব্রত হতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব ত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল এবং নিজ সংগঠনের অভ্যন্তরে মারামারি, খুনোখুনি অব্যাহত রেখে ছাত্রলীগ যেমন আলোচনায় ছিল, তেমনি সরকারের বদনামের মাত্রাও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
ছাত্রলীগ সম্ভবত প্রতিজ্ঞা করেছে যে, তারা কোনোভাবেই শেখ হাসিনার সরকারকে শান্তি-স্বস্তিতে থাকতে দেবে না। বিরোধী দলের আন্দোলন সরকাকে যতটা না চাপের মধ্যে ফেলতে সক্ষম হয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি চাপে রেখেছে নিজেদের ছাত্র সংগঠনের কিছু উচ্ছৃঙ্খল কর্মীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এবারও ছাত্রলীগ দাঁত দেখাতে শুরু করেছে।
সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বর্ধিত বেতন-ভাতা প্রত্যাহার এবং সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্স বন্ধের দাবিতে আন্দোলন করছিল। এই আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ অস্ত্র নিয়ে কেন ঝাঁপিয়ে পড়ল, সেটা কি শুধু ক্ষমতার দাপট দেখানোর জন্য, নাকি অন্য কোনো কারণে তা জানা যায়নি।
তবে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী হামলার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছেন। স্বল্পসময়ের নোটিশে ছাত্রছাত্রীদের হল ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা যেখানে ছাত্র সংগঠনের প্রধান কাজ হওয়া উচিত সেখানে ছাত্রলীগের কারণে দেশের একটি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে, শিক্ষার্থীদের জীবনে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা, নেমে এসেছে অন্ধকার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কবে খুলবে, ছাত্রছাত্রীরা কবে স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনে ফিরতে পারবে সেটা কেউ বলতে পারে না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের আচরণে সরকার নিশ্চয়ই স্বস্তিবোধ করছে না। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষনেতা এবং মন্ত্রী ঘটনার নিন্দা করেছেন। অপরাধীদের রেহাই না দেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। কেউ কেউ এটা বলেছেন যে, ছাত্রলীগকে এখনই সামাল দিতে না পারলে, তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে সরকারের জন্য এরা বড় সংকট তৈরি করবে।
আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন, যারা প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে হামলা করেছেন, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এখানে শিথিলতা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। তাহলে সরকার সম্পর্কে মানুষের কাছে নেতিবাচক বার্তা যাবে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অপরাধী যে দলেরই হোক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। হামলাকারীদের ধরার জন্য পুলিশ সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে। এর আগে বিশ্বজিতের ঘটনায় আমাদের মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিল, এখন এ ঘটনায় আমাদের নাক-কান কাটা গেল।
হামলাকারীদের যদি সত্যি গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাহলে এতে সরকারের মাথা নিচু হবে না কিংবা নাক-কানও কাটা যাবে না। কিন্তু সেটা যদি না হয়, সরকার সমর্থক হওয়ার কারণে তারা যদি পার পেয়ে যায়, প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে যারা সাধারণ ছাত্রদের ওপর চড়াও হয়েছে তাদের যদি আইনের হাতে সোপর্দ করা না হয় তাহলে ঘটনাটি সরকারের জন্য কলঙ্কচিহ্ন হয়ে থাকবে।
ছাত্রলীগ সম্পর্কে আওয়ামী লীগকেও অবিলম্বে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ছাত্রলীগের কার্যক্রম যদি অব্যাহতভাবে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের কারণ হতে থাকে, ছাত্রলীগের প্রধান কাজই যদি হয় সরকারকে বিব্রত করা তাহলে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলতে দেওয়া উচিত কি-না সেটা ভেবে দেখার বিষয় বৈকি! মানুষের মনে নতুন করে চরম বিরূপতা তৈরির আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্রলীগের ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যাদের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, সব ভালো অর্জন বিফলে যায়, তাদের প্রতি সহানুভূতি ও অনুকম্পা দেখানোর কোনো মানে হয় না।
শেখ হাসিনা বেশ কয়েক বছর আগে ছাত্রলীগের হাতে বই-খাতা-কলম তুলে দিয়েছিলেন। মারামারি-হানাহানিতে লিপ্ত না হয়ে, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিষয়েই নিজেদের জড়িত রাখবে– এটাই ছিল তাঁর প্রত্যাশা। বই-খাতা দিয়ে ছাত্রলীগকে তিনি নিশ্চয়ই পেশিশক্তিতে বলীয়ান দেখতে চাননি, চেয়েছিলেন জ্ঞানের শক্তিতে সাহসী এবং শিক্ষার আলোয় আলোকিত-উদ্ভাসিত দেখতে। কিন্ত শেখ হাসিনার ইচ্ছাপূরণে ব্রতী না হয়ে ছাত্রলীগ কেন ভিন্নপথে হাঁটছে, ছাত্রলীগের হাতে কেন এবং কীভাবে অস্ত্র উঠছে সেটা এখন তাকেই খতিয়ে দেখতে হবে। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত থাকলে তার লাভ না ক্ষতি সে হিসেব-নিকেশ করার সময়ও বোধহয় এসেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে কারও কারও মনে কিছুটা বিস্ময়ের জন্ম নিয়েছে। ছাত্রলীগের বাড়াবাড়িতে যেখানে তার বিরক্ত হওয়ার কথা, সেখানে তাকে যেন কিছুটা নমনীয় দেখা গেছে। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি কৃতকর্মের জন্য ছাত্রলীগ তিরস্কৃত না হয়ে পুরস্কৃত হওয়ার দিকেই যাচ্ছে!
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের বর্ধিত ফি বাতিল হওয়ায় ছাত্রলীগ বিজয় মিছিল করেছিল, সেখানে হামলা হয়েছে, ছাত্রলীগ প্রতিবাদ করেছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, যতজনের হাতে অস্ত্র দেখা গেছে, তারা সবাই ছাত্রলীগের নয়। ছাত্রলীগের যারা তাদের আমরা ইতোমধ্যেই বহিষ্কার করেছি। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ছাত্রলীগের প্রতি এক ধরনের প্রশ্রয়ের মনোভাব আছে বলে যদি কেউ মনে করেন, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। ছাত্রলীগের আনন্দ মিছিলে কারা হামলা করেছিল? যদি ছাত্রশিবির 'অনুপ্রবেশকারী' হিসেবে ছাত্রলীগের ওপর হামলা চালিয়ে থাকে তাহলে তো ছাত্রশিবিরকেই তাড়া করার কথা। একজন ছাত্রশিবির কর্মীকেও ধরা গেল না? ছাত্রশিবিরের হামলা ঠেকাতে ছাত্রলীগ অস্ত্রহাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তাড়া করল কেন?
সংবাদপত্রে কমপক্ষে ছয় জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর ছবি ছাপা হয়েছে, যাদের হাতে অস্ত্র দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অস্ত্রহাতে সবাই ছাত্রলীগ কর্মী নয়। যে কয়জন ছাত্রলীগ কর্মীর হাতেই অস্ত্র থাক না কেন, প্রশ্ন হল, তারা অস্ত্র পেল কোথায়? কে তাদের অস্ত্র দিল? অন্য যাদের হাতে অস্ত্র ছিল তাদের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক পরিচয় কী?
অস্ত্রধারী ছয় জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর নাম-পরিচয় পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। অথচ ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে মাত্র দুজনকে। বাকি চার জনকে কেন বহিষ্কার করা হল না? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, বেআইনি অস্ত্রবহনের শাস্তি কি শুধু সংগঠন থেকে বহিষ্কার? সংগঠন থেকে বহিষ্কার তো অনেকের কাছেই একটি লোকদেখানো ব্যাপার বলে মনে হয়। এটা গুরুপাপে লঘুদণ্ড।
অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা প্রধানমন্ত্রী বললেও বাস্তবে কারও বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে তার কোনোটিতেই ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী কোনো নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়নি। ছাত্রলীগের কেউ অপরাধ করলে সে অপরাধ যদি মার্জনীয় হয়, তাহলে দেশে অপরাধের মাত্রা বাড়তেই থাকবে।
জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী একদিকে বলেছেন 'সন্ত্রাসী সন্ত্রাসীই, সন্ত্রাসীদের বরদাশত করা হবে না'– অন্যদিকে এটাও বলেছেন যে, 'আত্মরক্ষার অধিকার সবার আছে।' রাজশাহীতে জামায়াত-শিবিরের নাশকতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত ছাত্রলীগের ১৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু এ ব্যাপারে কেউ কোনো কথা বলেনি। যখন ছাত্রলীগের ছেলেরা সেখানে যেতে পারে না, তাদের রগ কেটে দেওয়া হয়, পত্রিকায় এটা লেখা হয় না। কোনো মানবাধিকার সংস্থাও পাশে গিয়ে দাঁড়ায় না। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, 'আমাদের ছেলেদের কি জীবন বাঁচাবার অধিকার নেই?'
জীবন বাঁচাবার অধিকার সবার আছে। আত্মরক্ষার অধিকারও সবারই আছে। তবে একজনের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যজনের অধিকার হরণ করা যায় না। একজন বাঁচার জন্য অন্যজনকে মারতে পারে না। তাছাড়া যে কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজে আইন-কানুন মেনে চলাই রীতি। জামায়াত-শিবির হিংসাশ্রয়ী রাজনীতি করে, তারা খুন ও রগ কাটায় পারদর্শী। জামায়াত-শিবিরের এই রাজনীতির কেউ প্রশংসা করে না। তারা যখন ছাত্রলীগ বা অন্য গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল সংগঠনের কর্মীদের হত্যা করে কিংবা রগ কাটে তার খবর পত্রিকায় ছাপা হয় না কিংবা তার নিন্দা-প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদপত্রে লেখা হয় না– সেটাও ঠিক নয়।
ছাত্র শিবির কেমন রাজনীতি করে সেটা সবার জানা। ছাত্র শিবির যা করবে, সেটা ছাত্রলীগও করবে– এটা কারও কাছেই প্রত্যাশিত নয়। ছাত্র শিবিরকে মোকাবেলা করতে হবে আদর্শিকভাবে এবং একই সঙ্গে প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে। ছাত্র শিবিরকে ঠাণ্ডা করার জন্য যদি ছাত্রলীগকে বেআইনি অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয় তাহলে ছাত্র শিবিরের সঙ্গে তাদের পার্থক্য থাকে কি? তাছাড়া এটা স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায়ে পড়ে। সন্ত্রাস দিয়ে সন্ত্রাস মোকাবেলা বা দমন করা যায় না। সন্ত্রাসীকে মোকাবেলার জন্য যদি নতুন সন্ত্রাসীর জন্ম দিতে হয় তাহলে দেশের মধ্যে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হবে।
ছাত্র শিবির যে সহিংস ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চর্চা করে তার বিপরীতে ছাত্রলীগ যদি শান্তিপূর্ণ উপায়ে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার প্রসার ঘটাতে সচেষ্ট হয়, তাহলে সবাই ছাত্রলীগের প্রশংসা করবে। ছাত্রলীগ একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ, সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ আমাদের দেশের অতীতের সব গণতান্ত্রিক সংগ্রামে ছাত্রলীগের উজ্জ্বল ভূমিকার কথা অস্বীকার করা যাবে না।
গত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে ছাত্রলীগের ঐতিহ্যে কালি মাখার জন্য যারা তৎপর তাদের বিরুদ্ধে সংগঠনটি দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে। ছাত্রলীগের যারা মুরুব্বী তারাও সংগঠনটির সদস্যদের ত্যাগের-দেশপ্রেমের আদর্শে উজ্জীবিত না করে সংকীর্ণ স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। ছাত্রলীগের অপকর্ম বা অপরাধমূলক কাজের খবর যখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় তখন এই সংগঠনটির যারা শুভাকাঙ্ক্ষী তারা পীড়িত বোধ করেন।
অথচ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে অনাচারের বিরুদ্ধে, অনিয়মের বিরুদ্ধে, সাধারণ মানুষের স্বার্থে কোনো কাজে অংশ নিলে এই সংগঠনের শুভার্থীদের বুক গর্বে ফুলে ওঠার কথা। দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যে জুলুম-অত্যাচারের খবর শোনা যায়, তার বিরুদ্ধে কেন ছাত্রলীগকে দাঁড়াতে দেখা যায় না? হিন্দুদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় রক্ষায় কেন ছাত্রলীগ সক্রিয় নয়? উগ্র ধর্মবাদী দল ও সংগঠনগুলো যখন দেশে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তখন কেন ছাত্রলীগকে সত্য প্রচারে উদ্যোগী হতে দেখা যায় না?
ছাত্রলীগ কোন পথে চলবে সেটা তাদের যেমন ঠিক করতে হবে, তেমনি তাদের মুরুব্বীদেরও তাদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। ছাত্রলীগের জন্য মাথা নিচু হবে কিংবা নাক, কান কাটা যাবে– এই অবস্থা নিশ্চয়ই প্রতিকারহীনভাবে চলতে দেওয়া যায় না।