Published : 06 May 2010, 07:38 PM
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে যে ইতিহাস রয়েছে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা একান্ত প্রয়োজন। অনেক সময় সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে প্রভাবিত আমরা প্রকৃত ঘটনাকে ভুলে যাই কিংবা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করি। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পেছনে এই অঞ্চলের মানুষের অর্থাৎ বাঙালী জাতির দীর্ঘদিনের আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান কাজ করেছে এবং এই অনুসন্ধানের পর আন্দোলন এবং সংগ্রামের সূচনা হয়।
পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে অলীক ধারণা কাজ করেছিলো। ধারণাটা এই যে বিভাগপূর্ব ভারতবর্ষের মুসলমানদের মধ্যে এক স্বতন্ত্র আবাসভূমি বা হোমল্যান্ড অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা জেগেছিলো, তারা মনে করেছিলো যেহেতু তারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী অতএব তারা এক স্বতন্ত্র জাতি এবং একই সংস্কৃতির ধারক। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এই ধারণার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি ছিলো না। বস্তুত বিশাল ভারত ভূখণ্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুসলিম জনগোষ্ঠী কখনো এক সমসত্ত্ব বা হোমোজেনাস জাতি হিসেবে গড়ে ওঠেনি। যেমন বাঙালী মুসলমানদের কথা বলা যায়। তারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও ভাষা ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে তারা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের চেয়ে ভিন্ন। বরং ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার দিক দিয়ে বাঙালী মুসলমানরা অমুসলিম বাঙালী জনগোষ্ঠী যেমন হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছাকাছি। কিন্তু মানবিক কারণে মূলত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাঙালী মুসলমানরা পাকিস্তান সৃষ্টির ঘোর সমর্থক ছিলো। বলা যেতে পারে এই সময়কাল পর্যন্ত বাঙালী মুসলমানরা ধর্মীয় পরিচয়ে ইসলামকে তাদের দেশজ ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালী পরিচয়কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলো। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পর বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে এক নতুন চেতনা জাগ্রত হলো। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী–যার অধিকাংশই অবাঙালী–ইসলাম ও পাকিস্তানের জাতীয় সংহতির নামে বাঙালীদের উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। সে সময় ড. শহীদুল্লাহ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছিলেন: "আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালী।" ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাঁর এই ঐতিহাসিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সত্যিকার স্বরূপটি তিনি প্রকাশ করেছিলেন। এই চেতনাই বাঙালী জাতিকে একেবারে স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলো পর্যন্ত উদ্বুদ্ধ করেছিলো।
কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে, আমরা ধর্মনিরপেক্ষ এই সাংস্কৃতিক পরিচয়টিকে ফিরে পাওয়ার পরও আবার হারাতে বসেছি। বদরুদ্দীন উমর এক সময় জাতির আত্মপরিচয়ের দিক থেকে ফিরে আসাকে "বাঙালী মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন" বলে আখ্যাখিত করেছেন। আজ সে জাতির শুধু রাজনৈতিকভাবেই নয়, সাংস্কৃতিকভাবেও ইসলামিকরণ ঘটে চলেছে। আগে, এমন কি '৭৫ সালের আগেও কোনো রাজনৈতিক সভায় বা সরকারি অনুষ্ঠানগুলোতে 'বিসমিল্লাহির রহমানুর রাহিম' কিংবা কোরান তেলাওয়াত করার কোনো রেওয়াজ ছিলো না। এসবের সূচনা হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর, জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সামরিক শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা। তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য রাষ্ট্রের সামরিকীকরণ করার পর গোটা জাতি এবং সংস্কৃতির ইসলামি করণ করে। এবং বলা যেতে পারে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বানাবার প্রক্রিয়া তারা শুরু করে। আরও দুর্ভাগ্যজনক এই যে এখন আওয়ামী লীগও এই ইসলামিকরণের শিকার এবং চর্চাকারী। জনগণের ভোট এবং ক্ষমতার লোভে এখন তাই-ই করতে হচ্ছে যা সে আগে কখনো করেনি। উমরের ভাষায়, একদা যা ছিলো স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এখন সেই বাঙালী মুসলমানের দেশত্যাগের প্রক্রিয়া চলছে; তবে তা সাংস্কৃতিক অর্থে।