Published : 20 Jun 2025, 03:15 PM
ইরানের ওপর ইসরায়েলের আকস্মিক বিমান হামলার মধ্য দিয়ে গত ১৩ জুন যে যুদ্ধের শুরু হয়েছে, সেই যুদ্ধ কি আদৌ বিশ্বযুদ্ধের দিকে যেতে পারে? ইসরায়েল কর্তৃক ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা এবং তার পাল্টা জবাবে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন আক্রমণ—এই দুইয়ের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে চরম উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। এমন উত্তেজনা বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেওয়ার যে গুরুতর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তা গোটা বিশ্বের সাধারণ জনগণ এবং রাষ্ট্রগুলোকে এক বিপজ্জনক ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
যদিও এখনই এই যুদ্ধ সরাসরি বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিচ্ছে না বলে অনুমান করা যায়। তবুও এর ঢেউ আমাদের উপমহাদেশেও নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এটাও সত্য, সংঘাতের গতি প্রকৃতি যেমন উদ্বেগজনক, তেমনি কূটনৈতিক চাপ ও বৈশ্বিক চাপে সংঘাত প্রশমনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার একজন প্রভাবশালী সামরিক কর্মকর্তা, মেজর জেনারেল আপতি আলাদিনোভ, বলেছেন—‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।’ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম মিররের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলি হামলার পর ওই রুশ জেনারেল রাশিয়ার ক্রেমলিন সরকারকে আহ্বান জানান ১০ লাখ নতুন সেনা নিয়োগের জন্য।
আলাদিনোভের এই ভাষ্যে সত্যিই আতঙ্ক আছে, না কি জনমত তৈরি করে রাষ্ট্রীয় যুদ্ধপ্রস্তুতিকে যৌক্তিক করতে চাওয়ার চেষ্টা—সে বিতর্ক থাকতেই পারে। তবে এটুকু স্পষ্ট, তিনি বলেছেন:
“যুদ্ধ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। এটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের নতুন মোড়, নতুন গতি। এখন আমাদের সেনা তৈরি করতে হবে এই যুদ্ধের জন্য।”
এই কথাগুলো এক আশঙ্কার কণ্ঠস্বর—যা মনে করিয়ে দেয় বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের বহুবার উদ্ধৃত সেই বিখ্যাত মন্তব্য: “আমি জানি না তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কোন অস্ত্র দিয়ে হবে, কিন্তু চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ হবে লাঠি ও পাথর দিয়ে।”
এই কথাটি তিনি বলেন ১৯৪০-এর দশকে এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়। পরে ১৯৭২ সালে উইলিয়াম হারমান্স তার ‘আইনস্টাইন অ্যান্ড দ্য পোয়েট: ইন সার্চ অব দ্য কসমিক ম্যান’ বইয়ে উদ্ধৃত করেন এই বক্তব্যটি।
আইনস্টাইনের এই মন্তব্য কেবল একটি ভবিষ্যদ্বাণী নয়, বরং মানবজাতির প্রতি এক গভীর সতর্কবার্তা। তার ভাষ্য অনুযায়ী, যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়, তা হবে এমন ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ, যার পরিণতিতে সভ্যতা এমনভাবে ধ্বংস হবে যে মানুষ আবার আদিম যুগে ফিরে যেতে বাধ্য হবে—যেখানে অস্ত্র বলতে থাকবে কেবল লাঠি আর পাথর।
আজ, যখন ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের ধাক্কা কাঁপিয়ে দিচ্ছে পুরো অঞ্চল, যখন বড় বড় রাষ্ট্রগুলোর সামরিক অবস্থান পুনর্গঠিত হচ্ছে, তখন আইনস্টাইনের সেই নৈতিক বার্তাটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
এই কথার মধ্য দিয়ে আইনস্টাইন ১৯৪০ সালে আমাদের সতর্ক করেছিলেন পারমাণবিক যুদ্ধের চূড়ান্ত ধ্বংসাত্মক পরিণতি সম্পর্কে। তারপর পৃথিবীর ঢের বয়স বেড়েছে। আরও ভয়াবহ সব যুদ্ধাস্ত্র তৈরি হয়েছে। সত্যি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে সেটা অনুমান করতে আইনস্টাইন হওয়ার দরকার হয় না। সাধারণ মানুষও ধারণা করতে পারে, ডনাল্ড ট্রাম্প আর বেনিমিয়ান নেতানিয়াহু তো পারেনই। তারাই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থামাবেন।
সংঘাত তীব্র ও বিস্তৃত হওয়ার কিছু কারণ আমরা প্রথমে আলোচনা করি, যা মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশের এই যুদ্ধটিকে বিশ্বযুদ্ধে রূপ দিয়ে ফেলতেও পারে–
যুদ্ধের পারমাণবিক ঝুঁকি ও অনাকাক্ষিত ফলাফল
পশ্চিমা ধারণা অনুযায়ী, ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছানোর (যেমন, ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, যা অস্ত্র-গ্রেডের কাছাকাছি) আগেই তা পুরো বিশ্বের জন্য নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এই কারণেই ইসরায়েল ইরানের নাতানজ ও ফোর্দোয়ের মতো পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালিয়েছে। হামলার ফলে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ইসরায়েলকে ‘কঠোর শাস্তি’ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। এরই অংশ হিসেবে তেল আবিব ও হাইফার মতো ইসরায়েলি শহরে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে চলমান সংঘাতকে আরও জটিল ও বিস্তৃত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
যদি ইরানের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে সেটি ইরানকে তার পারমাণবিক কর্মসূচি আরও দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলতে পারে। একইসঙ্গে, ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার মতো চরম প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে—যা বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহের স্রোত বিঘ্নিত করতে পারে এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিকে এই সংঘাতে জড়িয়ে ফেলতে পারে।
এই যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতির মধ্যে রয়েছে ইরান ও ইসরায়েল—উভয় দেশের বেসামরিক জনগণের মধ্যে ব্যাপক হতাহত, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর ওপর পাল্টাপাল্টি হামলা এবং এর ফলে সৃষ্ট অসম প্রতিক্রিয়া। এমন পরিস্থিতি দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধকে আরও বিস্তৃত করে তুলতে পারে, যার পরিণতিতে গোটা অঞ্চলই অস্থির হয়ে উঠতে পারে।
আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সম্পৃক্ততা
ইরানের দুর্বল ও ছিন্নমূল প্রক্সি নেটওয়ার্ক—যেমন হিজবুল্লাহ ও হুথি বিদ্রোহীরা—তাদের পরোক্ষ কার্যকারিতা হারাতে বসায়, ইসরায়েলকে ইরানের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে নামতে উৎসাহিত করেছে। এই পরিস্থিতিতে হুথিরা লোহিত সাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোর বাণিজ্যিক ও সামরিক জাহাজে হামলা জোরদার করতে পারে। পাশাপাশি, ইরাক ও সিরিয়ায় অবস্থানরত ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের নতুন করে সংগঠিত করে মার্কিন ও ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুতে হামলায় ব্যবহার করা হতে পারে, যা সংঘাতের ভৌগোলিক বিস্তার এবং তীব্রতা বহুগুণ বাড়িয়ে তুলতে পারে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপ অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি আরব—যদিও ঐতিহ্যগতভাবে, বিশেষ করে সুন্নি-শিয়া বিরোধের কারণে ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বী—ইতোমধ্যে তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যদি সংঘাতের বিস্তৃত পরিসরে আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর সামরিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, তবে ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব একপর্যায়ে বহুপাক্ষিক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রূপ নিতে পারে, যার প্রভাব হবে বৈশ্বিক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জটিল সম্পৃক্ততা
ইসরায়েলের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা কৌশলগত জোটের ভিত্তিতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তার এক অসামান্য সব উপহার দিয়েছে, দিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে আকাশপথে আক্রমণ ঠেকানোর ক্ষমতাসম্পন্ন টি-এইচ-এ-এ-ডি (THAAD) ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যার প্রতিধ্বনি প্রতিফলিত হয় মধ্যপ্রাচ্যের নীল জলরাশিতে মার্কিন নৌবাহিনীর সক্রিয় উপস্থিতিতে। আরব সাগরে ইউএসএস কার্ল ভিনসেনের অবস্থান যেন তার শক্তির প্রতীক; কিন্তু ১৬ জুন দক্ষিণ চীন সাগর থেকে আরব সাগরে অভিযানে যাওয়া ইউএসএস নিমিৎজ এক গভীর সংকেত বহন করে—মার্কিন সামরিক প্রস্তুতি আরও জোরদার হচ্ছে, সম্ভাব্য বড় ধরনের সংঘাতের আগাম সতর্কবার্তা।
এই প্রেক্ষাপটে, যদি ইরান উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি যেমন কাতার বা কুয়েতে অবস্থিত স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানে, কিংবা সরাসরি মার্কিন বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হবে কঠোর প্রতিক্রিয়ায় যেতে। এই প্রতিক্রিয়া শুধুমাত্র যুদ্ধে উত্তেজনা বৃদ্ধি করবে না, বরং একসময় পূর্ণমাত্রিক আন্তর্জাতিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে, যার পরিণতি বহন করতে হবে পৃথিবীর সব অঞ্চলকে।
আরেকদিকে, ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামোর ওপর সম্ভাব্য একটি যৌথ মার্কিন-ইসরায়েলি হামলা দেশটির প্রতিরক্ষা কাঠামোতে অচেনা ধাক্কা দিতে পারে। তবে এই আঘাত একতরফা হবে না। ইরানের সামরিক শক্তি দুর্বল হলে, তার ক্ষোভ আরও বাড়বে, যা সেখানকার রাজনৈতিক ও সামরিক অস্থিরতাকে তীব্র করবে। একইসঙ্গে, সিরিয়া, লেবানন, সৌদি আরব, এমনকি তুরস্ক ও পাকিস্তানসহ আঞ্চলিক এবং রাশিয়া, চীনসহ বৈশ্বিক শক্তিরা এই সংকটে প্রবলভাবে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলবে। এক সময়, দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধে লুকিয়ে থাকা আগুন বহুপাক্ষিক ও বিশ্বব্যাপী স্নায়ুযুদ্ধের ছায়ায় গা ঢাকা দিতে পারে—যেখানে কোনও একক লড়াই নয়, বরং একটি নতুন বিশ্ব সংঘাতের ছায়া আমাদের সামনে দাঁড়াবে।
রাশিয়া ও চীনের ভূমিকা
রাশিয়া ও চীন ইরানের মিত্র শক্তি, যারা উভয়ই ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করেছে এবং নিজেদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেদের অস্থান নিশ্চিত করেছে। রাশিয়া লাভবান হতে পারে যদি তেলের দাম বৃদ্ধি পায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ ইউরোপ (বিশেষ করে ইউক্রেইন) থেকে মধ্যপ্রচ্যের দিকে ফেরানো যায়। অন্যদিকে, চীন তাদের প্রভাব বাড়াতে আঞ্চলিক শক্তিগুলো এবং মুসলিম বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করছে। এই কারণে রাশিয়া ও চীনের প্রত্যক্ষ সংঘাতে জড়িত হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে, যেহেতু উভয় পরাশক্তিই ইরানের মিত্র, তাই ইরানের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হলে তারা শক্তিশালী অস্ত্র, প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে ইরানকে সহায়তা করতে পারে, হয়তো কিছুটা করছেও, তবে তারা প্রকাশ্য হয়ে পড়লে পরিস্থিতিকে আরও জটিল হয়ে যাবে।
যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে এই যুদ্ধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে, তাহলে তা রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং সংঘাতকে বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রক্সি যুদ্ধে রূপান্তরিত করতে পারে। যদিও তখনও এই সংঘাতকে বিশ্বযুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হচ্ছে মনে হলেও, এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধ প্রশমিত হওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়ে গেছে–
আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা
ইরান-ইসরায়েলের এই যুদ্ধ প্রাথমিকভাবে একটি দ্বিপাক্ষিক সংঘর্ষ, যা ইসরায়েল ও ইরানের দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনার ফল। ফলে এই যুদ্ধে বিশ্ব শক্তিগুলোর সরাসরি জড়িয়ে পড়ার আগ্রহ কারোরই নেই। উভয় পক্ষই কিছু সংযম প্রদর্শন করেছে; ইরান ইসরায়েলের হামলার সীমিত প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। ইসরায়েল কর্তৃক ইরানের সামরিক লক্ষ্যবস্তু ও অবকাঠামোর ওপর নির্দিষ্ট করে বিমান আক্রমণ চালানোর ফলে ইসরায়েলের সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়ানোর ইচ্ছার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। যদিও ইসরায়েল-ইরানের মিসাইল হামলার মাধ্যমে তেল আবিব ও হাইফায় পাল্টা জবাব দেওয়ায় ইসরায়েল আরও কঠোর বিমান হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ইরানকে সতর্ক করে দিয়েছে এবারের বিমান হামলার লক্ষ্য হবে ইরানের অর্থনৈতিক অবকাঠামো।
সৌদি আরব, কাতার ও তুরস্কসহ অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো সরাসরি সম্পৃক্ততা এড়াতে পছন্দ করে এবং উত্তেজনা কমানোর জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে পারে।
মার্কিন রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে ‘চিরস্থায়ী যুদ্ধ’ এড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন, যা ইসরায়েলকে রক্ষামূলক সমর্থনের বাইরে মার্কিন সম্পৃক্ততা সীমিত করতে পারে। তার প্রশাসন ইরান যেন মার্কিন বাহিনীকে সরাসরি লক্ষ্যবস্তু না করে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে, যা সংঘাতকে নিয়ন্ত্রণে রাখার যে চেষ্টা হচ্ছে তার একটি প্রমাণ। তবে, অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য এবং ইসরায়েলের প্রতি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক মৈত্রী সত্ত্বেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনের অতিরিক্ত সামরিক শক্তি মোতায়েন করে আসছে ইসরায়েলের সমর্থনে। এই পরিস্থিতিতে, ডনাল্ড ট্রাম্প নিজেও তার রিপাবলিকান দলের পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছেন না, আর ডেমোক্র্যাটরা স্পষ্টভাবে এই নীতির বিরোধিতা করছেন।
অন্যদিকে, মার্কিন জনমতের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী জড়িত থাকার ব্যাপারে বিরূপ ভাব রয়েছে, যা রাজনৈতিক নেতাদের জন্য চাপ তৈরি করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সরকারের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ যে, কিভাবে জাতীয় নিরাপত্তা এবং নির্বাচনি ভোটারদের মনোভাবের মধ্যে সমন্বয় করা যায়। এছাড়া, বিশ্বব্যাপী চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ায়, মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের সামরিক সংঘাতে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এর ফলে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপ নিতে বেশি আগ্রহী, যেন বৃহৎ কোনও সংঘাত এড়ানো যায় এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ভয় থেকে দেশকে রক্ষা করা যায়।
ইরানের দুর্বলতা
ইরানের অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে, এবং এর প্রক্সি নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়ে পড়েছে, যেমন নাসরাল্লাহর হত্যার পর হিজবুল্লাহর সক্ষমতা কমে যাওয়ায় মার্কিন-সমর্থিত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া সিরিয়ার আসাদের পতনের পর হিজবুল্লাহকে পুনর্গঠন করা ইরানের জন্য বিশেষভাবে কঠিন হয়ে উঠেছে। ইরানের নেতৃত্ব সম্ভবত অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বা আরও ধ্বংস এড়াতে চলমান যুদ্ধ থেকে একটি ‘প্রত্যাহারের পথ’ খুঁজতে শুরু করেছে।
ইসরায়েলের আকস্মিক হামলার পর ইরানের মাপা বক্তব্য এবং পারমাণবিক আলোচনায় ফিরে আসার ইচ্ছা নির্দেশ করে যে, শর্তসমূহ মেনে নিলে তারা উত্তেজনা কমানোর জন্য একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে আগ্রহী।
সংযমের জন্য বৈশ্বিক আহ্বান
জাতিসংঘ এবং পারমাণবিক শক্তি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা (আইএইএএ) পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার নিন্দা জানিয়ে উত্তেজনা কমানোর আহ্বান জানিয়েছে, যা একটি বিস্তৃত যুদ্ধ রোধের জন্য আন্তর্জাতিক চাপের প্রতিফলন।
ইউরোপীয় শক্তিগুলো, যারা জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ, তারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে এবং বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোকে এই যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ার জন্য কূটনৈতিক আলোচনা চালাচ্ছেন। কারণ, একটি বিস্তৃত সংঘাত ইউরোপের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়; তেলের বাজারের অস্থিরতা এবং সরবরাহের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাব্যতা যাচাই
একটি বিশ্বযুদ্ধের জন্য প্রয়োজন হবে একাধিক বড় শক্তি ও তাদের মিত্রদের অস্বাভাবিক একত্র হওয়া এবং নাটকীয়ভাবে পরিস্থিতির অবনতি। যেমন:
যদি ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়, তবে তেলের দাম বারেলে ১০০ মার্কিন ডলারের ওপর উঠে যাবে, যার ফলে বিশ্ব অর্থনীতি ভয়ানক চাপের মুখে পড়বে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা এমনকি চীনের সামরিক হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত হতে পারে। কারণ এই পরাশক্তিসহ অধিকাংশ দেশের অর্থনীতি উপসাগরীয় তেলের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। রাশিয়া এই বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে ন্যাটোর সঙ্গে উত্তেজনা বাড়াতে পারে।
যুদ্ধ সরাসরি মার্কিন-ইরান সংঘাতে রূপ নেবে তখনই, যদি ইরান মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটি বা মার্কিন সম্পদে হামলা চালায়; এতে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে টেনে আনা হবে এবং রাশিয়া ও চীন ইরানকে সামরিক সমর্থন দিতে উৎসাহিত হতে পারে, যা সংঘাতকে বৃহৎ শক্তির প্রক্সি যুদ্ধে পরিণত করবে। তাই এই পরাশক্তিগুলো সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক ভূমিকাকে প্রথম পছন্দ হিসেবে দেখবে।
পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধি—যদি ইসরায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের জন্য একটি ‘মরিয়া চেষ্টা’ করে, তবে তা মার্কিন-ইসরায়েলি অক্ষশক্তিকে ইরানের সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে আক্রমণ করার বৈধতা দিতে পারে। যা পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলবে এবং অন্যান্য শক্তিগুলোকে অযথা এই যুদ্ধে টানবে। তবে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ১৩ জুনের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা চাপের মধ্যে রয়েছে এবং দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র পুনর্নির্মাণ কঠিন হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ থেকে বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। সংঘাত বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা নিম্ন থেকে মাঝারি (১০ থেকে ২০ শতাংশ)। তবে, যদি এই যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হয়, তাহলে তা সারা বিশ্বের জন্য এক ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে এবং বিশ্বকে পারমাণবিক ঝুঁকি, জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিতিশীলতা, বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইত্যাদির মাধ্যমে যুদ্ধের সম্প্রসারণের সম্ভাবনা নির্ধারণ করবে।
তবে অনেক কারণ রয়েছে, যে কারণগুলো বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাকে কমিয়ে দেয়। ইসরায়েল ও ইরান উভয় দেশেরই সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ এড়ানোর জন্য অভ্যন্তরীণ চাপেরও মুখোমুখি তারা।
ইসরায়েল ব্যতীত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যুদ্ধের বিস্তার ঘটানোর চেয়ে যুদ্ধকে সীমিত রাখাটাকেই অগ্রাধিকার দেয়।
রাশিয়া ও চীন প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার চেয়ে পরোক্ষ প্রভাব বজায় রাখলেই বেশি লাভবান হবে, ফলে যুদ্ধে তাদের সরাসরি অংশগ্রহণের কারণ নেই।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একে অপরের ওপর নির্ভরশীল, তাই বিশ্ব অর্থনীতির বিপর্যয় এড়াতে যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ করা, বন্ধ করতে না পারলে সীমিত রাখা সবার জন্যই ফলদায়ক।
তবে বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি বাড়বে, আগেই বলেছি যদি ইরানের প্রতিশোধমূলক আক্রমণে মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন ঘাঁটিসমূহ এবং আঞ্চলিক উপসাগরীয় দেশগুলো জড়িত হয়, তাহলে এই যুদ্ধ আর শুধু দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে এবং অন্যান্য অনেক দেশ ও পরাশক্তির জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ইসরায়েল যদি ইরানে শাসন পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে আক্রমণ চালায়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা স্থায়ী রূপ নিতে পারে, যা সাধারণ নাগরিকের দুর্ভোগের কারণ হবে।
এই যুদ্ধে বেসামরিক জনজীবনকে লক্ষ্যবস্তু করলে উভয় দেশের জন্য ভয়াবহ কৌশলগত ক্ষতি সৃষ্টি হবে, যা উভয়পক্ষকে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে এবং যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে চরম বিভ্রান্তি ও গরমিল সৃষ্টি করতে পারে।
সবশেষে বলে রাখা ভালো ইরান-ইসরায়েল সংঘাত একটি বিপজ্জনক ফ্ল্যাশপয়েন্ট, যার ফলে এই দুই দেশের যুদ্ধ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলবে। তবে এই সংঘাত বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। যদি না দ্রুত কোনো চরম পদক্ষেপের কারণে যুদ্ধের উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়—যেমন হরমুজ প্রণালী বন্ধ, সরাসরি মার্কিন-ইরান সংঘাত, বা পারমাণবিক ব্রেকআউট—তখন এই আশঙ্কা বাড়তে পারে। সংঘাতটি সম্ভবত একটি টিট-ফর-ট্যাট হামলার সিরিজ হিসেবে থাকবে, যার কারণে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে এবং উত্তেজনা কমিয়ে আনা যাবে। তবে, এখনও মধ্যপ্রাচ্যে একটি সম্প্রসারিত আঞ্চলিক যুদ্ধের ঝুঁকি বিদ্যমান। আন্তর্জাতিক চাপ, মার্কিন সংযম, এবং ইরানের দুর্বলতা সংঘাতের বৈশ্বিক প্রভাব সীমিত করার মূল কারণ। ইরানের পরবর্তী পদক্ষেপ, ট্রাম্পের অধীনে মার্কিন নীতি এবং রাশিয়া ও চীনের সম্পৃক্ততা ভবিষ্যতের ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।