Published : 25 Jul 2020, 08:40 PM
ঘুম যখন ভাঙলো তখন চারটা দশ বাজে। বিছানায় শুয়েই মুঠোফোন হাতে নিয়ে দেখি পাঁচটা মিসড কল। একটা ম্যাসেজ ঝুলে আছে, খুলে দেখি- 'অ্যাট প্রেস ক্লাব, হোয়ের আর ইউ?'।
লাফিয়ে উঠে বসলাম বিছানার ওপর। টলটলে পায়ে এক হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খুলে বেসিনের গিয়ে মুখ ধুলাম। রুমে এসে চেয়ারের পিঠ থেকে শার্টটা গায়ে দিয়ে দ্রুত বের হলাম রুম থেকে। ২০১২ সালের জুলাইয়ের কোন একটা দিন। তখন আমি থাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ২০৭ নাম্বার রুমে। হল গেটে এসে রিকশা করে রওয়ানা দিলাম প্রেস ক্লাবের উদ্দেশ্যে।
খুব সুন্দর একটা বিকেল। রোদের গা বেয়ে বাতাস বইছে। বৃষ্টিতে ভিজে ক্যাম্পাসের গাছগুলো সবুজ হয়ে আছে। কালো পিচের ওপর ছোপ ছোপ রোদ আর ছায়া। এর ভেতর দিয়ে রিকশাটা দুলতে দুলতে যাচ্ছে। আর আমার মনের ভেতরটা খচখচ করছে। কাজটা কি ঠিক হলো? মানুষটা আমাকে যেতে বলেছিলেন চারটায়। একজন সংসদ সদস্য একা দাঁড়িয়ে আছেন আমার অপেক্ষায়, অথচ আমি দুপুরে ভাত খেয়ে কখন ঘুমিয়ে গেছি!
রিকশা দোয়েল চত্বর পেরিয়ে হাই কোর্টে আসতেই একটু সাহস পেলাম। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কল দিয়ে বললেম, 'আপা, ভুল হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। আমি এসে গেছি, এই যে হাই কোর্টের সামনে।' ওপাশ থেকে কোন রাগ বা আভিমান শুনতে পেলাম না। রিকশা শিক্ষা ভবনের পাশে আসতেই উল্টোপথ পার হওয়ার ভাবনায় তাড়াতাড়ি ভাড়া মিটিয়ে নেমে হাঁটা শুরু করলাম।
দূর থেকেই দেখলাম প্রেস ক্লাবের গেটে বেবী মওদুদ আপা (২৩ জুন, ১৯৪৮ – ২৫ জুলাই, ২০১৪) ছোট্ট একটা ব্যাগ দুই হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন আর যে রিকশাগুলো এসে থামছে সেগুলোর দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছেন। আমি তাকে চিনি, উনি আমাকে চেনেন না, চেহারা জানেন না। এর আগে মোবাইলে কথা হয়েছে, শুধু নামটা জানেন। আমি কাছে গিয়ে বললাম, 'আপা, আমি এসেছি'। আপা বললেন, 'তুমিই সেই ছেলে! চলো, ভেতরে। তোমার কোন কষ্ট হয়নি তো আসতে?'
আমি কিছুই বলতে পারলাম না, মনের ভেতর অনুশোচনা নিয়ে তার পেছন পেছন অনুসরণ করতে লাগলাম। যেতে যেতেই বললেন, কিছুক্ষণ বাদে তার একটা মিটিং আছে আজ প্রেস ক্লাবে। এজন্যই এখানে আসতে বলেছেন। খুব সম্ভবত 'হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের' মিটিং ছিল ওটা। পরদিন পত্রিকায় তার ছবিসহ খবরটা আমি পড়েছিলাম পত্রিকায়।
সিঁড়ি বেয়ে প্রেস ক্লাবের দোতলায় উঠলাম। লাইব্রেরি রুম। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে তিনি ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করে টেবিলে রাখলেন। অন বাটন চেপে আমার দিকে ফিরে বললেন, 'কই, পেন ড্রাইভ এনেছো?' আমি পেন ড্রাইভটা উনার হাতে দিলাম। উনি ল্যাপটপ চালাতে চালাতে বললেন, 'নতুন লেখা চাও না পুরনো লেখা?' 'আপা, নতুন লেখা দিন।' উনি অনেকগুলো ফাইল ঘুরে একটা ডক ফাইলে এসে থামলেন, ফাইলটা ওপেন করলেন। কার্সর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লেখাটা এক নজর দেখে বললেন, 'এটা নিয়ে যাও, আর যা লেখা আছে সব পুরনো।'
আমি দেখলাম মাউসের ওপর বেবী আপার হাত কাঁপছে। বললাম, 'আপা আমাকে দিন, আমিই পেন ড্রাইভে করে নিয়ে নিচ্ছি।' উনি বললেন, 'না, আমার ল্যাপটপ কাউকে ধরতে দেই না, অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র থাকে।' বেবী আপা আমার হাত থেকে পেন ড্রাইভটা নিয়ে কাঁপা হাতে নিজেই সেটা সংযুক্ত করলেন। ফাইলটা কপি করে পেন ড্রাইভে নিলেন। একবার বন্ধ করে আবার খুলে দেখলেন ফাইল সত্যিই গিয়েছে কিনা। আমি পেছনে দাঁড়িয়ে এসব দেখচ্ছিলাম। উনি বললেন, 'আর কোন পেন ড্রাইভ আছে সঙ্গে?' আমি আরেকটা পেন ড্রাইভ তার হাতে দিলাম। উনি আবার আগের মতো লেখাটা এই পেন ড্রাইভেও দিয়ে বললেন, 'অনেক সময় লেখা মিস হয়ে যায়, তাই দুই জায়গায় নেওয়া ভালো।'
আমি বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় আপা পেছন থেকে ডেকে বললেন, 'এই তোমার নামটা যেন কী?' উনি আমাকে দাঁড় করিয়ে মুঠোফোনে আমার নামটা সেভ করলেন। বেবী মওদুদ আপা মারা যাওয়ার পরেও কয়েক বছর তার নাম্বার আমার মুঠোফোনে সেভ করা ছিল, যতদিন ওই মুঠোফোনটা আমি ব্যবহার করেছি ততদিন। মুঠোফোনের কন্টাক্ট লিস্টে 'বাবা' (আমার বাবা) শব্দটার পরই তার নামটা ছিল, ইংরেজিতে 'বেবী আপা'। প্রায়ই বাবাকে কল দেওয়ার জন্য কন্টাক্ট লিস্ট খুললেই দ্বিতীয় নামটা 'বেবী আপা' ভেসে উঠতো স্ক্রিনে। তাকে এতো সহজে ভুলি কি করে!
আমি লেখা নিয়ে প্রেস ক্লাব থেকে বেরিয়ে আবার ক্যাম্পাসের রিকশায় উঠলাম। তখন আমি ছাত্রলীগের কর্মী। কবিতা লিখি, রাজনীতি করি। শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হল হলের সহ সভাপতি ছিলাম। কেন্দ্রীয় কমিটিতে তখনও পদ পাইনি। ছাত্রলীগের প্রকাশনা 'মাতৃভূমি' ১৫ অগাস্ট শোক দিবস সংখ্যায় কাজ করি তখন। পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছি কয়েক বছর।
ছাত্রলীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম আমাকে এই কাজে উৎসাহ দিয়েছিলেন। 'মাতৃভূমির' তখনকার সম্পাদক ও পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জয়দেব নন্দী বেবী আপার মোবাইল নাম্বারটা দিয়েছিলেন আমাকে, লেখা আনার জন্য। সে বছরই আমি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা বিভাগে সম্পাদকীয় পদ পাই।
বেবী মওদুদ আপা আজীবন ছাত্রলীগ, বিশেষ করে ছাত্রলীগের প্রকাশনা 'মাতৃভূমির' শুভাকাঙ্খী ছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনিও তো ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ও রোকেয়া হল ছাত্রী সংসদের সাহিত্য সম্পাদক। যার কারণে আমাদের চাঞ্চল্যটা ধরতে পারতেন তিনি। 'মাতৃভূমির' জন্য কার কার লেখা নেওয়া যেতে পারে ইত্যাদি উপদেশ নির্দেশনা তিনি দিতেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা 'বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি দু'বার মাত্র' শিরোনামে চমৎকার একটি লেখার খোঁজ তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। পত্রিকাটির জন্য যখন সবার লেখা যোগাড় হয়ে যেতো, প্রচ্ছদ-বানান-মেক আপ-প্রেসের নানা খুঁটিনাটি কাজগুলো শেষ হয়ে আসতো, তখনও বাকি থাকতো কেবল একজনের লেখা- শেখ হাসিনা। এই দায়িত্বটা সানন্দে পালন করতেন বেবী মওদুদ আপা। সময়ে অসময়ে তাকে খালি ফোন দিতাম, ওপাশ থেকে বেবী আপা বলতেন- 'মাজহার, লেখা পেয়ে যাবা, পেয়ে যাবা'। শেষ পর্যন্ত ম্যাটার প্রেসে যাবার হয়তো ঘণ্টা খানেক আগে শেখ হাসিনার লেখাটি পেতাম আমরা।
আমার কবিতার বই বেবী আপাকে দিয়েছিলাম। কবিতা লিখি এটা জেনে তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। অনেকদিন তার বাসায় গিয়েছি। ধানমণ্ডি দশ নাম্বার রোডের দশ নাম্বার বাড়ি। ম্যাগাজিন প্রকাশ হবার পর তার বাসায় গিয়েছিলাম 'মাতৃভূমি' নিয়ে। ড্রইং রুমে বসেই বুঝেছিলাম ছোট বাসা, ছিমছাম। পানির গ্লাস থেকে শুরু করে বিছানার চাদর, জানালার পর্দা কোথাও অহং নেই, চাকচিক্য নেই। আসবাবপত্রগুলো পুরনো।
দুই দেয়ালে দুইটা শেলফভর্তি বই। খুব বেশি সাফসুতরো নয়, আবার ধুলোও লেগে নেই। বোঝা যাচ্ছে বইগুলো নিয়মিত নাড়াচাড়া করা হয়। বইয়ের ভারে শেলফ দুইটা কুঁজো হয়ে আছে। শেলফের ওপরেও বই, বইয়ের ওপরে বই। কাত হয়ে, চিত হয়ে, উল্টো হয়ে, ভাঁজ হয়ে নানা ভঙ্গিমায় এদিক ওদিক বই পড়ে রয়েছে। টি-টেবিলেও বই আর কাগজপত্র ভরে রয়েছে, যেন আলতো নাড়া খেলেই টুপটাপ করে নিচে পড়া শুরু করবে।
সেদিন আপা কালো রঙের একটা ইজি চেয়ারে বসে দুলেদুলে গল্প করছিলেন আমাদের সঙ্গে। আমরা বলতে- নবেন্দু সাহা নব, মালেজ সাজু ও আমি। আপার সাদা-পাকা চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে ওড়ছিলো, পরনে রুপালি-কালো চিকন পাড়ের সাদা শাড়ি। আমরা চা খাচ্ছিলাম আর 'মতৃভূমি' নিয়ে কথা বলছিলাম। এতো সিগ্ধ, শান্ত, নির্মল, নির্লোভ একটা চেহারার মানুষ আমাদের বেবী আপা। নব দা সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলেন, বললেন, 'আপা, আপনার সঙ্গে আমরা একটা ছবি তুলবো'। আপা বললেন, 'কেন? ছবি কেন? ছবি দরকার নেই।'
আমি ভেবেছিলাম আরেকবার অনুরোধ করলে হয়তো তাকে রাজি করানো যাবে। কিন্তু না, না তো না-ই। ছবি তুলতেই দিলেন না। বললেন, 'আমার সঙ্গে ছবি তুলে কী হবে! ওসবে কিচ্ছু হবে না।' আমি বললাম, 'আপা, আপনার সঙ্গে আমাদের একটা স্মৃতি থাকতো!।' বেবী আপা সেই কোমল মুখখানা তুলে বললেন, 'ছবির স্মৃতি দরকার নেই মাজহার, আমার কথা মনে রেখো, ওতেই চলবে।'
বেবী আপা প্রায়ই ফোন করে বলতেন, 'আজ অমুক জায়গায় অনুষ্ঠান আছে, সময় পেলে এসো, কিছু শিখতে পারবে।' কখনও বই ও লেখকের নাম মনে করে জিজ্ঞেস করতেন বইটা পড়েছো? বেশিরভাগ সময় দেখা যেতো আমি পড়িনি। উনি বলতেন, 'আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও, কিন্তু বই ফেরত দিতে হবে।' এভাবে দেখা গেলো তাঁর কাছ থেকে বই এনে পড়ে আবার ফেরত দেওয়ার একটা অভ্যেস তৈরি হয়েছিলো। আজ বোধ করি, উনি বিষয়টাতে মজা পেতেন। কারণ বই ফেরত দেওয়ার সময় বই নিয়ে কিছুটা আলোচনা হতো। উনি খুব ভেবে কথা বলতেন, শুনতেন এবং অনেক তথ্য দিতেন। মাঝে মাঝে আফসোস করতেন, 'তোমরা (ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা) তো বই পড়তে চাও না, বইয়ের সঙ্গে দূরত্ব থাকলে মানুষের সঙ্গেও সম্পর্কহীন হয়ে পড়বে। মাঠের রাজনীতির পাশাপাশি পাঠের রাজনীতিও দরকার।' ছাত্রলীগকে বই পড়তে উৎসাহিত করা অন্তত আমার দেখা ওই সময়ের একমাত্র মানুষ তিনি।
২০১৪ সালে 'মাতৃভূমি' অগাস্ট শোক দিবস সংখ্যার কাজ শুরু করেছিলাম জুলাইয়ে। কিন্তু সে মাসের ২৫ তারিখে আমাদের ছেড়ে চলে যান নিরাভরণ নিরহংকার মানুষটি। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁকে পেয়েও যেন হারিয়ে ফেললাম, তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার-জানার সুযোগ তৈরি হয়েছিলো আমার। সাংবাদিক, লেখক, নারী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও সাবেক সংসদ সদস্য বেবী মওদুদকে আজ খুব মনে পড়ে, তাকে প্রণতি জানাই।