Published : 20 Jun 2025, 10:34 PM
‘আমার যমুনার জল দেখতে কালো/ স্নান করিতে লাগে ভালো’–এই লোকসঙ্গীতটি শুনেছি ফজলুর রহমান বাবুর কণ্ঠে। গানটা মনে গেঁথে থাকলেও আজ আলোচনা গান নিয়ে নয়। আপাতত আমাদের কথা নদীর জল নিয়ে। পরে আসব অন্য এক ‘কালো জল’ প্রসঙ্গে—যেটা আদতে কালো টাকা নামে পরিচিত।
যমুনার জলের মতোই কালো বুড়িগঙ্গার জল। কিন্তু পার্থক্য আছে—যমুনার কালো পানিতে স্নান উপভোগ্য হলেও, বুড়িগঙ্গায় নামা মানেই চর্মরোগের ভয়। একই রঙের পানি, অথচ একটির কালো স্বাস্থ্যকর, অন্যটির কালো দূষিত।
এই বৈপরীত্যেই লুকিয়ে আছে আজকের কথার সূত্র। পানিই জীবন, কিন্তু সেই পানিই আবার মরণের কারণ হয়ে উঠতে পারে। টাকার ক্ষেত্রেও তাই। অর্থ ছাড়া আধুনিক জীবনের এক দিনও চলে না—জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার প্রয়োজন। তবু অর্থের উৎস যদি হয় অন্ধকার, তবে সেই টাকাই হয়ে উঠতে পারে বিপজ্জনক।
যেমন, মনে আছে কি পুলিশ কর্মকর্তার কন্যা ঐশীর কথা? মা-বাবা দুজনেই সরকারি চাকুরিজীবী ছিলেন। ব্যস্ততায় সন্তানের দিকে মনোযোগ দিতে পারেননি। যতদিনে খেয়াল করলেন, ততদিনে মেয়েটি মাদকাসক্ত। আর একসময় সেই কন্যার হাতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন মা-বাবা—নৃশংস এক ঘটনায়।
এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না, ঐশীর পরিবার কালো টাকার বলি হয়েছিল কিনা। কিন্তু কালো টাকার ছায়া যে সমাজে নানাভাবে বিরাজমান, তার প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। আর এই কালো টাকার অন্যতম উৎস হিসেবেই তো আমরা জানি কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে, যার মধ্যে পুলিশ অন্যতম।
টাকার বাহ্যিক রং থাকে বৈচিত্র্যময়—সবুজ, নীল, লালচে। কিন্তু তার উৎস যদি হয় অন্ধকার, তবে সেই টাকাই ‘কালো টাকা’। অন্ধকার গলি দিয়ে আসা উপার্জন, ঘুষ, পাচার বা কর ফাঁকি—সবই কালো অর্থনীতির উপাদান। আর সেই অর্থনীতিই গড়ে তোলে এমন সমাজ, যেখানে জল বুড়িগঙ্গার জলের মতোই কালো—কিন্তু পানযোগ্য নয়, প্রাণনাশী।
যদিও কালো টাকা নামে যা পরিচিত, রাজস্ব বোর্ডের কাছে সেটি ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ ছাড়া কিছুই নয়। অর্থাৎ, কর দেওয়া হয়নি এমন আয়কে বা আয়কর ফাইলে লুকানো সম্পদকে তারা অপ্রদর্শিত আয় ও সম্পদ বলে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সম্পদ বা আয় কিভাবে অর্জিত হয়েছে—সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যারা কর ফাঁকি দিয়ে এই অর্থ জমায়, তারা কি সৎ উপায়ে উপার্জন করেছে? সন্দেহ থেকে যায়ই। তাই ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ নামের আড়ালে কালো টাকার কুপরিচয় লুকানো হয়।
একটা কৌতুক মনে পড়ে—এক চোর ঈদে কোরবানি দিয়েছে। ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোরবানির পশু সৎ পথে নিয়েছো তো?’ চোর বলল, ‘না, এটা চুরি করা’। ইমাম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘তাহলে তো তোমার পাপ হয়েছে’। চোর বলল, ‘পাপ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কোরবানি দেওয়ায় তো পূণ্যও হলো। পাপ-পূণ্যে কাটাকাটি করে ফাও গোস্ত খাইলাম।’ ইমাম সাহে লা জবাব।
আমরা সাধারণ জনগণ কালো টাকার মালিকদের বিরুদ্ধে এমন ‘লা জবাব’ হয়ে আছি। তারা অবৈধ উপায়ে কিংবা কর ফাঁকি দেওয়া অর্থ দিয়ে কলকারখানা স্থাপন করলে, কিছু মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়। দেশের অর্থনীতিতে সেটা ভূমিকা রাখে। এতে করে, কালো টাকা উপার্জনের পথ খারাপ হলেও অর্থনীতির দৃষ্টিতে ওই কর্মসংস্থান তৈরি প্রশংসা পায়।
অনেকটা ঘুষের টাকার একটি অংশ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দান করলে, যেমন বাহবা পাওয়া যায় তেমন আরকি। যদিও সাধারণ মুসল্লি কিংবা অন্যরা জানেন না, জানতেও চান না দানকারীর টাকার উৎস কী। অর্থনীতিতে কালো টাকা যেন ভূমিকা রাখতে পারে সেজন্য বরাবরই সরকারগুলো বাজেটে এটা সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে। এ পর্যন্ত ২২ বার এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
প্রতি বছরই আমরা দেখছি বাজেট বইয়ের প্রচ্ছদ হয় ধবধবে সাদা। কিন্তু এর ভেতরে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার মত কালো নীতি, সরকারের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে। আবার, সেই সরকার যদি হয় গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী দেশকে পরিবর্তন করায় অঙ্গীকারাবদ্ধ, তাহলে সমালোচনাটা আরো কঠোরভাবে আসাটাই স্বাভাবিক।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আবাসন খাতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়ে এমন সমালোচনার মুখেই পড়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে তিনি সিদ্ধান্তটি পুনির্বিবেচনা করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। রাজস্ব বোর্ডে সূত্রে জানা যাচ্ছে, আগামী ২২ জুন যে বাজেট অনুমোদন পাবে তাতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল হচ্ছে।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে খুব বেশি ফায়দা হয় না। কয়লা ধুলে যেমন ময়লা যায় না, ঠিক তেমনি কালো টাকা উপার্জনকারীরাও তাদের টাকা সাদা করতে চান না। তাদের মানসিকতাও কয়লার মত। ২০২৩ সালে একটি জাতীয় পত্রিকার প্রতিবেদন দেখছি, স্বাধীনতার পর ৪০ বছর ধরে ২১ বার সুযোগের বিপরীতে কালো টাকা সাদা হয়েছে মাত্র ৪৭ হাজার কোটি টাকার মত।
এরপরও বার বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রাখা সমাজে এই বার্তা দেয় যে, তুমি যতই দুর্নীতি কর আমি বৈধ করে দেব। এর প্রভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে তৈরি হয় ভয়াবহ রকম পরিস্থিতি। গেল সরকারের দেড় দশকে আমরা দেখেছি মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমেছিল। এতে সমাজে তৈরি হয়েছে তীব্র বৈষম্য। কিছু ব্যবসায়িক অলিগার্ক তৈরি হয়েছিল, যারা ব্যাংক লুটপাট করে বিদেশে পাচার করেছে।
বাংলাদেশে কালো টাকার সমস্যাটা এখানেই। এই ধরনের টাকাকে অর্থনীতির মূল স্রোতে আনতে সরকার সুযোগ দেয়। কিন্তু তা কাজে না লাগিয়ে অর্থ দেশের বাইরে পাঠাতেই বেশি পছন্দ করে উপার্জনকারীরা। ভারতেও আমাদের মত কালো টাকার সমস্যা তীব্র। কিন্তু সেখানে পাচারের পরিমাণ কম। ফলে তাদের অর্থনীতি আমাদের মত পঙ্গু দশায় পড়ে না।
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরা একটি জনমত জরিপ প্রকাশ করছে, যেখানে বলা হচ্ছে সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঘুষ ও দুর্নীতিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কৃর্তপক্ষ-বিআরটিএ। এরপরই আছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা তথা পুলিশ, পাসপোর্ট ও ভূমি অফিস।
তার মানে, কালো টাকার প্রধান উৎস মুখগুলো সরকারের অজানা নয়। সেই পথগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয় না। এবারও আগের পথেই অন্তবর্তী সরকার হাঁটছে দেখে পরিবর্তনের আশা করা মানুষ দেখে হতাশ হয়েছে। বর্তমান সরকারের যেহেতু রাজনৈতিক টানাপোড়েন নেই, উচিত ছিল বাজেটে এমন কিছু নীতি দিয়ে যাওয়া যাতে কালো টাকা তৈরির পথ বন্ধ হয়।
পাশাপাশি বৈষম্য কমিয়ে আনতে ধনীদের থেকে বেশি বেশি কর আদায় করার উদ্যোগ বাজেটে থাকা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমরা দেখছি, করযোগ্য কম আয়ের চাকুরিজীবীদের ওপর বেশি চাপ দেওয়া হয়েছে। অথচ সম্পদের কর ওই অর্থে আহামরি বাড়ানো হয়নি। এবারই সুযোগ ছিল বৈষম্যকে বিলোপ করার বাজেট ঘোষণার। কিন্তু বাজেট বইয়ের প্রচ্ছদে তা থাকলেও ভেতরে নেই।
আমরা আশা করছি, শেষ পর্যন্ত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে না। বরং নির্বাচনের আগ পর্যন্ত যতটুকু সময় এই সরকার পাচ্ছে, সরকারি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কালো টাকা উৎপাদনের পথ বন্ধ করতে সব ধরনের কৌশলগত প্রক্রিয়া রেখে যাবে। পরবর্তী সরকারগুলো যেন তা অনুসরণ করতে পারে। না করলে যেন ধিক্কৃত হয়। এতে সত্যিকার অর্থে একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যেতে পারবে দেশ।