Published : 03 Jul 2025, 02:42 PM
সরকারের ‘টেলিকম নেটওয়ার্ক ও লাইসেন্সিং রিফর্ম পলিসি-২০২৫’ ‘তড়িঘড়ি করে ঘোষণা’ করার সিদ্ধান্তে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে বিএনপি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীর এই নীতিমালা নিয়ে দলের আপত্তির কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “আমরা এই মুহূর্তে এই ধরনের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি।
“খসড়া নীতিমালাটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এতে কিছু গুরুতর সমস্যা রয়েছে, যা টেলিকম খাতে সমতাভিত্তিক ও টেকসই উন্নয়ন বাধা হতে পারে।”
মির্জা ফখরুলের মতে, এটা ছোট ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ করবে।
সরকারের প্রতি আহ্বান রেখে তিনি বলেন, এসএমই, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, গ্রাহক সংগঠনসহ সব পক্ষকে নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করার পর যেন এই ধরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা চুড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সেই সাথে এই প্রস্তাবিত নীতিমালার একটি পূর্ণাঙ্গ আর্থিক ও সামাজিক পরিনামও বিশ্লেষণ করা হোক। বিশেষ করে এসএমই ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সম্ভাব্য ক্ষতি, কর্মসংস্থান হ্রাস এবং অর্থনীতির ওপর প্রভাব বিবেচনায় রেখে তা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ফখরুল।
তার ভাষায়, “এই ধরনের জাতীয় পর্যায়ের টেলিকম নীতি প্রণয়নে অবশ্যই সতর্কতা, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে নিতে হবে। সামনে জাতীয় নির্বাচন থাকায়, তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।”
বেলা আড়াইটায় বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের প্রধান নির্বাহী চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন টেলিকম নীতিমালার খসড়া ঘোষণা করার কথা।
তার প্রায় দুই ঘণ্টা আগে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিএনপির আপত্তির কথা তুলে ধরেন দলের মহাসচিব।
২০১০ সালে টেলিযোগাযোগ খাতে ন্যাশনওয়াইড টেলিকম ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স দেওয়া হয়।
এসব লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে সেসময় আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছিল। ওই কোম্পানিগুলো টেলিকম অবকাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় ফাইবার অপটিক কেবল স্থাপনের অনুমোদন পায়।
এর আগে পর্যন্ত মোবাইল অপারেটরগুলো নিজেরাই ফাইবার কেবল বসিয়ে নিজেদের মত নেটওয়ার্ক বিস্তার করতে পারত। এনটিটিএন কোম্পানিগুলো এই লাইসেন্স পাওয়ার পর মোবাইল অপারেটরগুলো সেই ক্ষমতা হারায়, শুরু হয় এক নতুন টানাপোড়েন।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এনটিটিএন ও মোবাইল অপারেটরগুলোর মধ্যে পুরনো সেই টানাপোড়েনে নতুন মাত্রা দেখা দেয়।
মার্চে মোবাইল অপারেটরগুলোকে ডার্ক ফাইবার ও ডিডব্লিউডএম প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেন প্রধান উপদেষ্টার তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। এরপর একটি খসড়া নীতিমালা প্রকাশ করে সরকার।
খসড়া নীতিমালার সম্ভাব্য সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের দিক তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “একাধিক সেবাখাতে মালিকানা রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে বড় মোবাইল অপারেটররা একাধিক খাতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এতে প্রতিযোগিতা কমে যাবে এবং ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে পড়বে।”
এসএমই খাত আর্থিক সংকটে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ডি-রেগুলেশনের (নিয়ন্ত্রণ শিথিল) পরে এসএমই, বিশেষ করে স্থানীয় আইএসপি বা ছোট টেলিকম অপারেটরদের সম্পদ ও দায়বদ্ধতা নিয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকায় তারা বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়তে পারে।
“বিদেশি মালিকানার সীমা নিয়ে অস্পষ্টতা আছে, যা বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে পারে এবং এ খাতের স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করতে পারে। ক্রস-ওনারশিপের ফাঁকফোকরে বড় কোম্পানিগুলো আরও বাজার দখল করে নিতে পারে।”
‘বড় মোবাইল অপারেটরদের প্রতি পক্ষপাত’
নীতমালায় ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান-আইএসপি লাইসেন্স একীভূত করা বিষয়টি তুলে ধরে মির্জা ফখরুল মনে করেন, এতে করে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো সুবিধা পাবে।
তার মতে, নেটওয়ার্ক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান-এনএসপি লাইসেন্সের স্পেকট্রামের ওপর নির্ভরতা বড় কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে রাখবে। ফিক্সড টেলিকম লাইসেন্স খোলা থাকলেও সারাদেশে সেবা দিতে হবে এবং উচ্চমান বজায় রাখাতে হবে, যা ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান-এসএমইদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, “বড় মোবাইল কোম্পানিকে এন্টারপ্রাইজ ব্রডব্যান্ড বাজারে প্রবেশ করতে দিলে ছোট কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে এবং একচেটিয়া পরিবেশ তৈরি হবে, যা দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপরেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
“শুধু তাই নয়, নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বড় কোম্পানির সুবিধা বজায় রাখা হয়েছে, যা প্রতিযোগিতা নয় বরং আধিপত্য বাড়বে।”
‘নতুন প্রযুক্তির বিষয়ে দিকনির্দেশনা নেই’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড বা নতুন ডিজিটাল সেবা নিয়ে নীতিমালায় কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই, যা বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করতে পারে।”
‘বিবাদ ও অসাম্যের শঙ্কা’
নীতিমালায় এন্টারপ্রাইজ সার্ভিসের সীমা অস্পষ্ট দাবি করে মির্জা ফখরুল বলেন, “মোবাইল অপারেটরদের ফাইবার-ভিত্তিক ব্যবসা সংযোগ সেবা কোথায় সীমাবদ্ধ তা নীতিমালায় স্পষ্ট নয়। ফলে বিবাদ ও অসাম্য তৈরি হতে পারে।”
তিনি বলেন “বিএনপি বিশ্বাস করে, সবার জন্য উপকার বয়ে আনে, এমন নীতিই গ্রহণযোগ্য।
“ডিজিটাল সংযুক্তির মাধ্যমে সমতাভিত্তিক উন্নয়ন এবং জাতীয়ি ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অঙ্গীকারেই আমরা কাজ করে যাব।”
‘নীতিমালায় গ্রামীণ মানুষের সুফল থাকতে হবে’
নতুন টেলিকম নেটওয়ার্ক নীতিমালা প্রণয়ণে সরকার কারো মতামত নেয়নি বলে দাবি করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান।
সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই এই নীতিমালার বিষয়ে দেশবাসীর কাছে বিএনপির মতামত তুলে ধরার কথা বলেন তিনি।
মঈন খান বলেন, “আমরা আধুনিক প্রযুক্তির বিস্তার চাই। বিএনপি চায়, প্রযুক্তি সামনের দিকে যাবে, কিন্তু তার সুফলটা যেন জনগণ পায়।
“এখানে বড় মোবাইল অপারেটর, তারা একটা বিরাট সুবিধা পাবে। আার যারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বড় রকমের বিনিয়োগ করতে পারবে, তারা একটা সুবিধা পাবে।”
গণতান্ত্রিক সমাজে সাধারণ মানুষ যাতে সুফল পায় সুবিধার লক্ষ্য তা হওয়া উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা যতটুকু জানি, প্রস্তাবিত নীতিমালায় এই লক্ষ্যটি অনুপস্থিত। আমরা এমন নীতিমালা করব, যে নীতিমালার সুফল দেশের মানুষ পায়।”
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়া গুরুত্ব তুলে ধরে বিএনপির এই নেতা বলেন, যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এখন পৃথিবীতে আলোড়ন তুলেছে তার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে যদি না পৌঁছায় তাহলে তো এ নীতিমালায় জনগণের লাভ হবে না।