Published : 01 Jul 2023, 07:54 PM
সরকার পতনে বিএনপি যে ‘এক দফা আন্দোলন’ শুরু করার কথা বলছে, সেই আন্দোলনের ধরন ‘ভিন্ন রকম’ হবে বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেছেন, “তারুণ্য সমাবেশ হচ্ছে, সামনে আমাদের পদযাত্রার কর্মসূচি শুরু হবে। আমরা আশা করি যে, একদফাতে আমরা আন্দোলন শুরু করব। অর্থাৎ আমাদের যে ১০ দফা, অন্যান্য যুগপৎ আন্দোলনকারী দলগুলো আছে- তাদের দফাগুলো মিলিয়ে একটা দফায় আন্দোলনে যাব…
“সেটা হচ্ছে যে, এই অবৈধ সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং নতুন নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠান… এগুলোকে নিয়ে আমরা একটা জায়গায় আসছি… সেটা হচ্ছে যে, মূলত এই সরকারের পদত্যাগ। সেটা নিঃসন্দেহে গত আন্দোলনগুলোর চাইতে ধরনও হবে একটু ভিন্ন এবং জনগণের সম্পৃক্ততাও বাড়বে।”
শনিবার বিকালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়কালে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, “একটা ব্যাপারে আমরা নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, আমাদের এই আন্দোলন প্রথম থেকেই যেটা শুরু করেছি সেটা হচ্ছে যে- জনগণকে সম্পৃক্ত করে আন্দোলন। এই আন্দোলনে জনগণের অনেক বেশি সম্পৃক্ততা আসবে।
“আমি বিশ্বাস করি, এই আন্দোলনের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে সরকার বাধ্য হবে নতি স্বীকার করে পদত্যাগ করে একটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে।”
এক দফার আন্দোলনে হরতাল-অবরোধের মত কর্মসূচি থাকবে কি না? এ প্রশ্নের উত্তরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমরা আগেই বলেছি, আমরা হরতাল-অবরোধের মত কোনো কর্মসূচি সচেতনভাবে চাচ্ছি না। আমাদের ভায়োলেন্সে যাওয়ার প্রশ্নই উঠতে পারে না।
“সরকার যদি কোনোভাবে ওইসব দিকে ঠেলে দেয় তা সরকারের দায়। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনটা করছি, শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনে আমরা চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে চাই।”
‘উন্নয়ন বিভ্রম’
মির্জা ফখরুল বলেন, “এই সরকারের সবচেয়ে বড় অপরাধ যে, জনগণকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা। কয়েকটা বইও বেরিয়েছে যে, বাংলাদেশের উন্নয়নের যে একটা ব্যাপার বারবার বলা হচ্ছে, এটা আসলে উন্নয়ন বিভ্রম। এটা মানুষকে বোকা বানানো হয়, প্রতারণা করা হয়- যা পরিসংখ্যানের তথ্যের মধ্যে অনেক কিছু সরবারহ করা হয়, যে তথ্যগুলো সঠিক নয়। এটা আজ থেকে নয়, এই সরকার আসার পর থেকেই।
“আপনাদের মনে আছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ে তখন মন্ত্রী ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। তার নির্দেশে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, সেখানে নির্দেশ দেওয়া ছিল- তার সঙ্গে কথা না বলে কোনো কিছু দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ উনারা যেটা বলবেন, সেটাই পরিসংখ্যান ব্যুরোতে দিতে হবে। যার ফলে এই গ্রোথ রেট (প্রবৃদ্ধির হার), ইনকাম বলেন, প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট-ফরেন ইনভেস্টমেন্ট বলেন- সব ক্ষেত্রেই আপনি যদি গভীরে যান এবং অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলেন, তাহলে দেখবেন যে- প্রতিদিনেই আপনাকে ভ্রান্ত ধারণা দেওয়া হচ্ছে, ভুল ধারণা দেওয়া হচ্ছে।”
বিএনপি আমলের এই কৃষি প্রতিমন্ত্রী বলেন, “এতোই যদি উন্নয়ন হয়ে থাকে, কৃষি ক্ষেত্রে যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে থাকে- তাহলে আজকে কেন, প্রতি বছর প্রায় ৫৪ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি হয়?
“মরিচের দাম বেড়েছে, আদার দাম তো একদিনে ২০০ টাকা কেজিতে বেড়ে গেছে। এরকম প্রত্যেকটা আইটেমের দাম বেড়েই চলেছে। দেশটাকে তারা মূলত আমদানিনির্ভর করে ফেলেছে। এর কারণ হচ্ছে একটাই, আমদানি করতে গেলে যে কমিশন পাওয়া যায়, যে লাভটা হয়- এটাই হচ্ছে প্রধান বিষয়।”
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “এই সরকারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লুট করা। আমি বলি যে, বর্গিদের মত। বাংলাদেশে বর্তমানে যে অবৈধ সরকার ক্ষমতায় চেপে বসে আছে, তাদের আচরণ পুরোপুরি বর্গিদের মতো। আসবে, লুট করে নিয়ে চলে যাবে। সমস্ত জায়গায় চুরি, সমস্ত জায়গায় দুর্নীতি.. এটাকে তারা উন্নয়ন বলে। সেজন্য ওরা বাগাড়ম্বর করে কথা বলে।”
সরকার মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে মন্তব্য করে ফখরুল বলেন, “যখন অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে, ধসে পড়ছে, যখন অর্থনৈতিক বিপর্যয় শুরু হয়েছে, যখন জনগণ তাদের দুঃখের কথাগুলো বলতে শুরু করেছে, ইনফ্লেশন এমন একটা পর্যায়ে পড়ে গেছে যে- মানু্ষের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকছে না; তখন সরকার উল্টো কথা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। এতে কোনো লাভ হচ্ছে না।
“কিছুদিন আগে ইন্টান্যাশনাল মিডিয়াতে এসেছিল, সেই উন্নয়নের স্বপ্ন, যেগুলো তারা (সরকার) দেখাচ্ছিল- সেগুলো মরীচিকায় পরিণত হয়েছে। সেজন্য আমরা মনে করি যে, এনাফ ইজ এনাফ… এখনও সময় আছে এই সরকার পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা দিয়ে চলে যাওয়া উচিত। এটা তাদের জন্য ভালো হবে, দেশের জন্য মঙ্গল হবে।”
‘সংকট উত্তরণ সরকারের হাতেই’
নির্দলীয় সরকারের নিয়ম সংবিধানে সংযোজন ‘সরকারের দায়িত্ব’ মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। এটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার উপর।
“সরকারের জনগণের প্রতি যদি ভালোবাসা থেকে থাকে, দেশের প্রতি যদি কোনো প্রেম থাকে- তাহলে নিঃসন্দেহে তাদের দায়িত্ব হচ্ছে যে, এই রাজনৈতিক সংকটটা মোকাবেলা করার জন্য তাদের সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।”
ফখরুল বলেন, “আলোচনা করেই তারা একটা পথ বের করতে পারে। এটা অতীতে বাংলাদেশে হয়েছে তো, দুইবার-তিনবার-চারবার হয়েছে। এটা খুব কঠিন কাজ না।… প্রয়োজনীয় সংশোধনী করতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করতে হবে- তাহলে একটা পথ তৈরি হবে।”
‘যুগপৎ আন্দোলন, জোটবদ্ধ না’
জামায়াতে ইসলামীকে বিএনপির ‘বি-টিম’ হিসেবে বর্ণনা করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক কাদের শনিবার যে বিবৃতি দিয়েছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মির্জা ফখরুল বলেন, “এগুলো বাজে কথা। তারা ইচ্ছা করে এসব কথা বলে। আমরা এসব কথার উত্তর দিতে চাই না। জনগণই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের কথাগুলোর উত্তর দিয়ে দেবে।
“এবার যে জনগণকে সম্পৃক্ত করে আন্দোলনটা শুরু হয়েছে- তাকে ভ্রান্ত দিকে নিয়ে যাওয়া, আবার একটা ইস্যু তৈরি করে সেটাকে অন্যদিকে দিয়ে যাওয়া, ইস্যু পরিবর্তন করা, এসবের কোনো সুযোগ এবার তারা পাবে না।”
জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির অবস্থান কী– এ প্রশ্নের উত্তরে ফখরুল বলেন, “জামায়াত একটা রাজনৈতিক দল, অনেক বছর ধরে রাজনীতি করছে, জাতীয় পার্টিও রাজনৈতিক দল। যদিও এখন জামায়াতের নিবন্ধন নেই। আমি ঠাকুগাঁওয়ে যে কথাটা বলেছিলাম যে, জামায়াতে ইসলামী একটা রাজনৈতিক দল, সে তার নিজস্ব ধারায় রাজনীতি করছে।
“আমাদের মূল কথাটা হচ্ছে যে, সরকারের বিরুদ্ধে যারাই আন্দোলন করবে- তাদেরকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত, সেই কাজ তারা নিজেরা করবে। আমরা যুগপৎভাবে আন্দোলন করছি, আমরা জোটবদ্ধ আন্দোলন করছি না। প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দল, যারা মনে করে যে- এই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা উচিত, তারা করতে পারে, এটা স্বাভাবিক। কমিউনিস্ট পার্টি তারা নিজস্ব জায়গা থেকে আন্দোলন করছে, বাসদ তাদের নিজস্ব জায়গা থেকে আন্দোলন করছে, জামায়াতে ইসলাম তারা নিজস্ব জায়গা থেকে আন্দোলন করছে…. এখন আরও অনেক দল যারা যুগপৎ আন্দোলনে নেই, কিন্তু তারা আন্দোলন করছে- আমরা সকলকে তাদের ওয়েলকাম জানিয়েছি।”
জাতিসংঘের শান্তি মিশনের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে ফখরুল বলেন, “আমরা মনে করি যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সমস্ত কথা বলে ডাইভারশন করা, রাজনৈতিক সংকট থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে লাভ হবে না। এবার আমাদের লক্ষ্য স্থির, জনগণের লক্ষ্য স্থির… এটাই আন্দোলন… এই অবৈধ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে।”
‘সরকারই চায়- ডানপন্থিদের উত্থান হোক’
ফ্রান্সের ঘটনাবলী এবং ইউরোপে ডানপন্থিদের উত্থানের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, “যখনই গণতন্ত্র ঠিক মতো চলতে না পারে, তখনই এসব সমস্যা দেখা দেয়। পশ্চিমা বিশ্বকে ভিন্নভাবে দেখতে হবে, আমাদের দেশকে ভিন্নভাবে দেখতে হবে। কারণ পশ্চিমা বিশ্বে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক…। আমাদের এখানে সেটা নাই।
“তারপরে যেটা এখানে যদি গণতন্ত্রকে স্পেস দেওয়া না হয়, নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, মানুষ যদি তার গণতান্ত্রিক অধিকার না পায়- তাহলে স্বাভাবিকভাবে ডানপন্থি, উগ্রপন্থি, ফান্ডামেটালিস্ট, জঙ্গিবাদ এগুলোর উত্থান তো হবেই। সেকথাগুলো আমরা বার বার বলছি।”
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আজকে আন্তর্জাতিক বিশ্ব ও আমরা কেউই এখানে জঙ্গিবাদের উত্থান চাই না, আমরা কেউই এখানে ডানপন্থিদের চূড়ান্ত রূপের কাছে যেতে চাই না। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে যে মূল বিষয়টা ছিল- আমরা সত্যিকার অর্থেই উদারপন্থি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।
“সেটার পেছনে সবচেয়ে বড় বাধা গণতন্ত্রের স্পেস নেই। মানুষ যখন কোনো রাস্তা পাবে না, মানুষ যখন সরকার পরিবর্তনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট দিয়ে পরিবর্তন করতে না পারবে; তখন তো সে ভিন্ন দিকে যাবেই। সেই রাস্তা তৈরি করে দিচ্ছে এই অবৈধ সরকার। তারা দেশে এমন একটা অবস্থা তৈরি করেছে যে, মনে হচ্ছে তারা চায়- একটা ডানপন্থি উত্থান হোক। তারা ঠেলে ওদিকে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করি, যারা আমরা গণতন্ত্রের বিশ্বাস করি- তারা আমরা এখানে নিঃসন্দেহে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই।”
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন, সদস্য সচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, সদস্য শায়রুল কবির খান ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক কামরুজ্জামান রতন উপস্থিত ছিলেন।