Published : 09 Dec 2023, 08:02 AM
কৃষি ও মাছ চাষ, ব্যাংকে স্থায়ী আমানতসহ নানা খাত থেকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ঢাকা-১৩ দলের প্রার্থী জাহাঙ্গীর কবির নানকের আয় বেড়েই চলেছে। শেষবার ২০১৪ সালের নির্বাচনের তুলনায় তার আয় বেড়েছে ১৪ গুণেরও বেশি।
নানকের জমিজমা দেশের এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এর কিছু আছে ঢাকায়, কিছু তার নিজ জেলা বরিশালে, আছে কক্সবাজারেও।
তিনি সম্পদের যে হিসাব দেখিয়েছেন, তার মধ্যে জমির একটি বড় অংশ ও মাছের খামারটি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।
বিপুল পরিমাণ ঋণও আছে আওয়ামী লীগ নেতার। এই ঋণের মধ্যে একটি বড় অঙ্ক নেওয়া হয়েছে ব্যাংক থেকে, আবার স্বজনদের কাছ থেকেও ধার করেছেন তিনি।
নানক ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পান, জেতেনও। ২০১৪ সালে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
তবে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে তার আসনে একটি বাসায় ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের যে সময়ের রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া স্টিফেন ব্লুম বার্নিকাটের উপস্থিতিতে ইট পাটকেল ছোড়ার ঘটনায় সমালোচনার মুখে আর মনোনয়ন পাননি।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রতীক তুলে দেয় সাদেক খানের হাতে। তিনিও নির্বাচিত হন। তবে বর্তমান সংসদ সদস্য মনোনয়ন পাননি, ফিরে এসেছেন নানক।
নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামা নানকের এক দশক আগের সঙ্গে বর্তমানের আয় ও সম্পদের তুলনার সুযোগ এনে দিয়েছে।
আয় কত?
মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা পড়া হলফনামা অনুযায়ী কৃষি ও মৎস্য চাষ, আইন পেশা, বাড়ি বা দোকান ভাড়া, স্থায়ী আমানত ও সঞ্চয় হিসাবের লভ্যাংশ মিলিয়ে নানকের বছরে আয় সাকূল্যে ১ কোটি ৭৬ লাখ ৫৭ হাজার ২০০ টাকা।
১০ বছর আগের হলফনামায় আয় দেখানো হয় ১২ লাখ ৬ হাজার ৫৮৭ টাকা। আয়ের খাতগুলো ছিল কৃষি, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংক আমানত ও চাকরি। অর্থাৎ বেড়েছে ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
এই আয় বৃদ্ধির ব্যাখ্যা অবশ্য হলফনামায় দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। ফলে কোন খাতে কত আয় আর কোন খাতে বেড়েছে, সে বিষয়ে তথ্য মেলেনি।
সম্পদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখানে সেখানে
নানক তার স্থাবর সম্পদের যে হিসাব দিয়েছেন, তার একেকটি একেক এলাকায়। এই সম্পদের একটি বড় অংশ পেয়েছেন পরিবার থেকে।
উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি বরিশালে কৃষিজমি পেয়েছেন ১৯২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। তার মৎস্য খামারটির মালিকও হয়েছেন তিনি একইভাবে।
অকৃষি জমির মধ্যে ঢাকার উত্তরায় আছে ৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ যেটির ক্রয় মূল্য দেখিয়েছে ২২ লাখ ৪ হাজার ৬০০ টাকা।
মোহাম্মদপুরে হেবাসূত্রে (দান) পেয়েছেন ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ জমি, বরিশালে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন ১১ দশমিক ৬১ শতাংশ ও ২৯ দশমিক ০৪ শতাংশের আরও দুটি জমি।
আওয়ামী লীগ নেতার ১৬ দশমিক ৩১ শতাংশ জমি আছে জমি আছে কক্সবাজারের চকোরিয়াতেও।
সব মিলিয়ে তিনি ৬৯ দশমিক ০৮ শতাংশ অকৃষি জমির মালিক।
ঢাকায় একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাটেরও মালিক নানক।
এর মধ্যে উত্তরায় আছে ৬ তলার একটি ভবন, একই এলাকায় ৫২০ দশমিক ৪৫ বর্গ মিটারের একটি ফ্ল্যাটও রয়েছে, যার মূল্য ৪ কোটি ৪২ লাখ ১২ হাজার ১৪৭ টাকা।
মোহাম্মদপুরে আছে ৮ তলা একটি ভবন, আছে ২৭৫ দশমিক ৩৩ বর্গ মিটারের একটি ফ্ল্যাটও।
বরিশালেও একটি বাড়ি আছে নানকের, যেটির মূল্য দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ২৯ লাখ ৭৯ হাজার ২৭৬ টাকা।
একই জেলায় একটি এক তলা টিনশেড বাড়ির মূল্য দেখানো হয়েছে ১৪ লাখ ৯২ হাজার ১৯৩ টাকা।
দশম নির্বাচনের হলফনামায় নানক ৩০ শতাংশ কৃষি জমি, ৪৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ অকৃষি জমি ও ১ কোটি ৩০ লাখ ২০ হাজার ৬০০ টাকার বাড়ি দেখিয়েছিলেন।
অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে তার স্থাবর সম্পদের পরিমাণ অনেক বেড়েছে।
অস্থাবর সম্পদ
নানকের এবার হাতে নগদ দেখিয়েছেন ২ লাখ ৯৫ হাজার ৫৬৪ টাকা। বিদেশি মুদ্রার মধ্যে আছে ৭৯৯ মার্কিন ডলার।
আওয়ামী লীগের প্রার্থীর শেয়ারে বিনিয়োগ ২ কোটি ১৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা, ব্যাংকে স্থায়ী আমানত ৮৮ লাখ ৯৬ হাজার ৯৪৪ টাকা আর ব্যাংকে জমা ৫০ লাখ ৪৬ হাজার ৯০০ টাকা।
৭০ লাখ ৬৩ হাজার টাকার একটি ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি, ৬ ভরি সোনার গহনা, ৫০ হাজার টাকা মূল্যের গৃহস্থালী ইলেকট্রনিক সামগ্রী, ৫০ হাজার টাকার আসবাবপত্র এবং লাইসেন্স করা দুটি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে তার।
১০ বছর আগে তিনি নগদ টাকা দেখিয়েছিলেন ১১ লাখ ৪৩ হাজার ১২৩ টাকা। সে সময় তার স্বর্ণ ছিল ১০ ভরি।
তখন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ছিল ৬৯ লাখ ৭২ হাজার ৮৫ টাকা। ৬৩ লাখ ৬ হাজার ১৯৪ টাকার বাস, ট্রাক বা মোটর গাড়ি এবং মোটর সাইকেলও ছিল। আরও ছিল এক লাখ টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী।
সম্পদশালী নানকের স্ত্রীও
আওয়ামী লীগ নেতার স্ত্রী সৈয়দা আরজুমান বানু নার্গিসের নামেও আছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ। আছে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকাও।
হলফনামা অনুযায়ী, তার হাতে নগদ আছে ৭৪ লাখ ৯৫ হাজার ৭৩৪ টাকা, ব্যাংকে আছে আরও ৯৮ লাখ ৫৪ হাজার ৫৩৯ টাকা।
তার নামে শেয়ার কেনা ৪৬ লাখ ৪৯ হাজার ২০৮ টাকার, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আছে ৪৫ লাখ টাকার এবং ১ কোটি ৭৯ লাখ ৬৫ হাজার ৪৪১ টাকা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ করা।
১৪ লাখ ১৫ হাজার ৭০২ টাকার একটি গাড়ি, ৪০ ভরি স্বর্ণ, ৪ লাখ ২০ হাজার টাকার গৃহস্থালী ইলেক্ট্রনি সামগ্রী ও সাড়ে ৪ লাখ টাকার আসবাবপত্রও রয়েছে তার।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগের হলফনামায় নানকের স্ত্রীর হাতে নগদ দেখানো হয় ৮১ লাখ ৯৫ হাজার ৯০৯ টাকা। সে সময় ব্যাংকে জমা দেখানো হয় ৭৯ লাখ ৪৩ হাজার ৭ টাকা।
তখন শেয়ারে বিনিয়োগ ছিল ১ কোটি ৪৪ লাখ ৩২ হাজার ৫৩৭ টাকার, স্থায়ী আমানত ছিল ১ কোটি ৬০ লাখ ২২ হাজার ৭২৬ টাকার।
৩০ তোলা স্বর্ণ ও ৭ লাখ টাকার ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী ও আসবাবপত্রও দেখানো হয় ১০ বছর আগের হলফনামায়।
নানকের স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদের মধ্যে আছে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ অকৃষি জমি, ঢাকার গ্রিনরোডে ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার একটি অ্যাপার্টমেন্ট।
১০ বছর আগেও স্ত্রীর নামে এই পরিমাণ অস্থাবর সম্পদ দেখান আওয়ামী লীগ নেতা।
আছে বিপুল ঋণও
বহু সম্পদের পাশাপাশি বড় অঙ্কের ঋণও নিয়েছেন নানক।
এর মধ্যে স্যাম স্পিনিং লিমিটেড নামের একটি কোম্পানির নামে অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান শাখা থেকে নেওয়া হয়েছে ২৬ কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগ নেতা ব্যাংক থেকে বাড়ি নির্মাণ ও গাড়ির কেনার জন্য ঋণ নিয়েছেন ২ কোটি ৮৬ লাখ ১৯ হাজার ৫৯১ টাকা। এছাড়া স্ত্রীর কাছ থেকে ৮৮ লাখ, মেয়ের কাছ থেকে ১ কোটি ৫৩ লাখ ২০ হাজার টাকা ধার করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা।
তার বাড়ির নির্মাণ সামগ্রী ক্রয় বাবদ ব্যবসায়িক দায় আছে আরও ৩৩ লাখ ৮৭ হাজার ৯১৮ টাকা।
অর্থাৎ নানকের মোট দেনা ৫ কোটি ৬১ হাজার ২৭ লাখ ৫০৯ টাকা।
১০ বছর আগে দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সময় নানকের দেনা ছিল আড়াই কোটি টাকা, যেটি তিনি বাড়ি বানানোর জন্য ব্যাংক থেকে নিয়েছিলেন।
সব মামলা থেকে মুক্ত
বিরোধী দলের রাজনীতি করার সময় নানকের বিরুদ্ধে নানা সময় মামলা হয় মোট ১৪টি। এর মধ্যে ১৩টি থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন। একটি মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করার কথা হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।