Published : 02 Jul 2025, 05:58 PM
গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগ উচ্চ লবণসহিষ্ণু গমের নতুন জাত ‘জিএইউ গম ১’ উদ্ভাবন করেছে।
কৃষিতত্ত্ব বিভাগের কৃষি বিজ্ঞানী অধ্যাপক এম ময়নুল হক এবং অধ্যাপক মো. মসিউল ইসলামের নেতৃত্বে সফল গবেষণার মাধ্যমে নতুন গমের জাত উদ্ভাবন হয়।
বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আকব্বাস উদ্দিন এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নতমানের গমের জাতটি লবণাক্ততা সহনশীল, উচ্চফলনশীল ও অধিক প্রোটিনসমৃদ্ধ। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট উদ্ভাবিত জাতের সংখ্যা ৯১টিতে পৌঁছাল; যা বাংলাদেশের কৃষিতে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।
অধ্যাপক মো. মসিউল ইসলাম বলেন, “আমাদের দীর্ঘদিনের গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতার ফল ‘জিএইউ গম ১’ উদ্ভাবন। দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও লবণাক্ত এলাকায় ফসল উৎপাদনের যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যেই আমরা এই গমের জাতটি উদ্ভাবনে কাজ শুরু করি।
“এই জাতটি লবণাক্ত পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে এবং তুলনামূলকভাবে অধিক ফলন দেয় যা কৃষকের জন্য যেমন লাভজনক, তেমনি দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।”
গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন গবেষণা ও ফলন পরীক্ষার পর ২০২১ থেকে ২০২৩ সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষকের মাঠে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে লবণাক্ত সহিষ্ণু ও উচ্চ ফলনশীল হিসেবে প্রমাণিত হয়। পরবর্তীতে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির সার্বিক তত্ত্বাবধানে দেশের ছয়টি স্থানে মাঠ মূল্যায়নে প্রস্তাবিত ফলন পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফলাফলের সুপারিশের প্রেক্ষিতে জাতীয় বীজ বোর্ড গত ১৭ জুন ‘জিএইউ গম ১’ এর ছাড়পত্র দেয়।
এ গমে বিদ্যমান অধিক প্রোটিন শরীর গঠন ও মেরামত, শক্তি সরবরাহ, ইমিউন সিস্টেমের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে রোগ প্রতিরোধে অধিক সহায়তা করে থাকে। অন্যদিকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ‘গ্লুটেনিন’ থাকায় এটি উচ্চ প্রোটিন ও লো ফ্যাট হওয়ায় সহজে শরীরে শোষিত হতে পারে।
‘জিএইউ গম ১’ এর ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যসম্বলিত ল্যাব টেস্টে প্রমাণিত হয় যে এটি সাধারণ গম থেকে ভিন্ন গুণসম্পন্ন। এই গমের দানা তামাটে, চকচকে এবং তুলনামূলক কম সময়ের মধ্যে পরিপক্ব হয়। আমন মৌসুমে ধান কাটার পর বীজ বপন করলে ৯৫ থেকে ১০০ দিনে উৎপাদন পাওয়া যায়, ফলে অল্প সময়ে অধিক ফলন পেয়ে কৃষকরা লাভবান হতে পারেন।
অন্যদিকে এ গমের গাছের আকার বড়, কাণ্ড মোটা ও গুটির সংখ্যা বেশি হওয়ায় এটি থেকে অধিক পরিমাণ খড় পাওয়া যায়, ফলে গবাদি পশুর খাদ্য চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
গবেষকরা বলছেন, উৎকৃষ্টমানের এ জাতের ফলন হেক্টর প্রতি স্বাভাবিক মাটিতে ৪ দশমিক ৫ টন এবং লবণাক্ত মাটিতে ৩ দশমিক ৭৫ টন ফলন পাওয়া সম্ভব। যা একে অন্যান্য জাতের গম থেকে বিশেষ স্থানে নিয়ে গিয়েছে। উন্নত এ ইনব্রেড জাতটি বিভিন্ন রোগ যেমন ব্লাস্ট, রস্ট ইত্যাদির রোগ প্রতিরোধক সম্পন্ন হবার কারণে সাধারণ জাতের তুলনায় গড়ে ১০-১৫ শতাংশ বেশি ফলন দিতে সক্ষম। এ কারণে বাংলাদেশের মতো কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে এর উপযোগিতা অনেক। আবার এটি লবণ সহনশীল হওয়ায় মানব শরীরে সোডিয়াম ক্লোরাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে কার্যকরভাবে পানি ও পুষ্টি শোষণ করতে পারে। এছাড়া জলবায়ু সহনশীলতা ও রোগ-পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকায় এটি দেশের বৈচিত্র্যময় পরিবেশে চাষের জন্য উপযোগী ও লাভজনক একটি জাত।
অধ্যাপক মসিউল বলেন, “আমরা আশা করি, ‘জিএইউ গম ১’ দ্রুত মাঠ পর্যায়ে বিস্তার লাভ করবে এবং দেশের বিভিন্ন লবণাক্ত অঞ্চলে গম চাষে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। আমরা এ অর্জনকে কৃষকের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে দেখছি।’’
এ প্রসঙ্গে গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জি কে এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “নতুন জিএইউ গমের এ জাতের উদ্ভাবন এটি শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয় বরং বাংলাদেশের কৃষি খাতের জন্য একটি বড় অর্জন। আমাদের দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও লবণাক্ত মাটিযুক্ত এলাকায় কৃষি উৎপাদন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে থাকে।
“সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের গবেষকরা নিরলস পরিশ্রম করে এমন একটি জাত উদ্ভাবন করেছেন, যা লবণাক্ত পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে এবং অধিক ফলন দিতে সক্ষম।”
নতুন এ জাতটিকে দেশের টেকসই কৃষির প্রতীক উল্লেখ করে উপাচার্য বলেন, “এর মাধ্যমে কৃষকেরা আগের চেয়ে বেশি লাভবান হবেন এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথে আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে।’’
তিনি এই উদ্ভাবনের পেছনে শ্রম দেওয়া গবেষণা দল, ল্যাব এবং মাঠপর্যায়ের বিজ্ঞানীদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।