Published : 27 Oct 2022, 03:17 PM
খুলনার দাকোপের ৩২ ও ৩৩ নম্বর পোল্ডারে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি বেড়িবাঁধ পুনর্নিমাণ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পরপরই সেগুলো ধসে যাচ্ছে। এ প্রকল্পের কাজ ‘মানসম্মত’ হয়নি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রকল্পটিতে নদী শাসনের কাজ না করে বেড়িবাঁধ পুনর্নিমাণ করায় মেগাপ্রকল্পের নামে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হয়েছে।
নদীর তীরে পাথর-সিমেন্টের ব্লক ফেলে দ্রুত ভাঙনকবলিত স্থান মেরামতসহ টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তারা।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, বাঁধের ধস ঠেকাতে নদীশাসনের নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সংস্থাটি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম জানান, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এ প্রকল্পের আওতায় খুলনার দাকোপের ৩২ নম্বর পোল্ডারে ৪৯ দশমিক ৬৬ কিলোমিটার এবং ৩৩ নম্বর পোল্ডারে প্রায় ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়েছে। বাঁধ নির্মাণ ছাড়াও প্রকল্পের আওতায় ৩২ নম্বর পোল্ডারে ১৫ কালভার্ট ও স্লুইসগেট নির্মাণ, ৩ দশমিক ৩০০ কিলোমিটার বাঁধের ঢাল সংরক্ষণ, ১৭ কিলোমিটার খাল খনন এবং দুই কিলোমিটার নদীশাসন করা হয়েছে।
৩৩ নম্বর পোল্ডারেও বাঁধনির্মাণের পাশাপাশি ৬২ কিলোমিটার খাল খনন, ২১ কালভার্ট ও স্লুইসগেট, চার কিলোমিটার ঢাল সংরক্ষণ এবং ১ দশমিক ৩০০ কিলোমিটার নদীশাসন করা হয়েছে।
আশরাফুল বলেন, “ওই প্রকল্পের সমীক্ষা করা হয়েছিল ২০১২-১৩ অর্থবছরে। ওই সময়ের নদীর গতিপ্রকৃতির সঙ্গে বর্তমানের কোনো মিল নেই। নদীর স্রোত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, যে কারণে নতুন নতুন এলাকায় ভাঙন বাড়ছে।”
“এ ছাড়া নতুন করে আরও সাত কিলোমিটার এলাকায় নদীর তীর সংরক্ষণের জন্য ১৫২ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ভাঙনকবলিত এলাকায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চলছে।”
তবে এ বেড়িবাঁধ পুনর্নিমাণ প্রকল্পের কাজ ‘মানসম্মত’ হয়নি- স্থানীয়দের এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
স্থানীয়রা জানান, ২০১৭ সালে শুরু হওয়া বাঁধ দুটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে গত ৩০ জুন। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার পরপরই পানির চাপ বাড়তেই ভাঙছে বাঁধ। ৩২ নম্বর পোল্ডারের একাধিক জায়গা ধসে গেছে। ঝুঁকিতে রয়েছে আরও এলাকা। ৩৩ নম্বর পোল্ডারের বাজুয়া ইউনিয়নের চুনকুড়ি খেয়াঘাটের পাশে ১০০ মিটার বাঁধ ধসে দোকানসহ বেশকিছু ঘর নদীতে ভেসে গেছে।
এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ভারি বৃষ্টি ও উঁচু জোয়ারের প্রভাবে স্থানীয় নদ-নদীতে জোয়ারের পানি স্বাভাবিক অপেক্ষা তিন থেকে চার ফুট বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার ৩১ নং পোল্ডারের খলিশা, পানখালী জাবেরের খেয়াঘাটের পাশে, ঝালবুনিয়া, বটবুনিয়া, কামিনীবাসিয়া, গড়খালীতেও ভাঙন দেখা দিয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ কাজ পেলেও কাজ করেছেন তাদের নিয়োগ করা দেশীয় উপ-ঠিকাদাররা। অধিকাংশ স্থানে পুরোনো বাঁধের ওপর মাটি ফেলে কাজ শেষ করা হয়েছে। কাজের মনিটরিং ব্যবস্থাও ছিল দুর্বল।
কামারখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পঞ্চানন কুমার মণ্ডল বলেন, “নদীর গতি-প্রকৃতি না বুঝে- খরস্রোতা নদীগুলো শাসন না করে বাঁধ নির্মাণ করায় তা টেকসই হচ্ছে না। যে কারণে এ প্রকল্প এলাকাবাসীর তেমন কাজে আসছে না। বরং মেগাপ্রকল্পের নামে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হয়েছে।”
পঞ্চানন বলেন, “বাঁধের সুফল পেতে অবশ্যই কংক্রিটের ব্লক ফেলে নদীরতীর সংরক্ষণ করতে হবে। পুরো পোল্ডার এলাকায় তীর সংরক্ষণ না করলে দুর্যোগপ্রবণ ওই এলাকার বাঁধ টেকসই হবে না।”
উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প (সিইআইপি-১) এর প্রকল্প পরিচালক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম জানান, খুলনাসহ উপকূলীয় ছয় জেলার টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য এ প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৩ সালে। বিশ্বব্যাংক এ বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পে (সিইআইপি, ফেজ-১) অর্থায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার ২৮০ কোটি টাকা দিয়ে ১৭টি বাঁধ (পোল্ডার) নির্মাণ করা হয়েছে। এতে উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমবে।
প্রকল্পের কাজের ‘মান’ নিয়ে প্রশ্নে তিনি ব্যস্ততার অজুহাতে কথা না বলে এড়িয়ে যান। পরে আরও কয়েক দফা ফোন দেয়া হলেও তিনি আর রিসিভ করেননি।
সুতারখালী ও কামারখোলায় ভাঙন আতঙ্ক
এদিকে বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দেওয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন দাকোপ উপজেলায় সুতারখালী ও কামারখোলা ইউনিয়নের বাসিন্দারা। ঢাকী, শিবসা, সুতারখালী ও ভদ্রা নদীবেষ্টিত ইউনিয়ন দুটিতে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের বাস।
কামারখোলার গুনারী গ্রামের আদিত্য নারায়ণ সরদার বলেন, এখানে এখন আর বড় ঘূর্ণিঝড়ের প্রয়োজন হয় না। অমাবস্যার জোয়ারে পানির চাপ একটু বাড়লে মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
একই এলাকার নকুল চন্দ্র মণ্ডল বলেন, “বেড়িবাঁধের কাজ শুরুর সময় নদীশাসনের দাবিতে আমরা আন্দোলন করেছি। পানি উন্নয়ন বোর্ড আমাদের কথা শোনেনি। কারণ বাঁধ ভাঙলে ঠিকাদার-পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের আয় বাড়ে। আর দুর্ভোগ বাড়ে আমাদের।”
সুতারখালী পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি নিরেন্দু মণ্ডল বলেন, “বেড়িবাঁধের কাজ হয়েছে যাচ্ছেতাই। পুরানো বাঁধের দুপাশে মাটি দিয়ে কোনোরকমে কাজ করা হয়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচের পর এখন সেই টাকা পানিতে যাচ্ছে।
সুতারখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাসুম আলী ফকির জানান, নদীভাঙনে সুতারখালী ও কামারখোলা ইউনিয়নের তিন শতাধিক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। নদী শাসনের কাজ না করে বাঁধ নির্মাণ করায় ভাঙন বেড়েছে। আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে তাদের।
দাকোপ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আবুল হোসেন বলেন, নদীভাঙন আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ওই এলাকায় অভাব-অনটনে বিপর্যস্ত জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। জীবিকার অন্বেষণে এলাকা ছেড়ে শহর ও নিকটবর্তী জেলামুখী হচ্ছে মানুষ।
সিত্রাংয়ে ‘নতুন প্রযুক্তির' বেড়িবাঁধে ধস
অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সোমবার সকালে কয়রার হরিণখোলার ‘নতুন প্রযুক্তির' বেড়িবাঁধের প্রায় ৮০ মিটার ধসে গেছে।
মঙ্গলবার ভোর থেকে দিনভর শতাধিক শ্রমিক কাজ করে বাঁধ সংস্কার করলেও তা এখনও ঝুঁকিমুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন ইউপি সদস্য আবুল কালাম শেখ।
তিনি বলেন, “টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি আমাদের বহুদিনের। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকেই এ দাবিতে সোচ্চার ছিলাম আমরা।
“কিন্তু ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২ নম্বর কয়রার খালের গোড়া থেকে গোবরা পর্যন্ত কপোতাক্ষ নদের তীরের দুইপাশে মাটির দেয়াল ও মাঝখানে ড্রেন কেটে তাতে বালু ভরাট করে ৬০ মিটার ক্লোজার ও ১ হাজার ৬৪০ মিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কাজ শেষ হয়।”
আবুল কালাম বলেন, “বাঁধের পুরোটা মাটি দিয়ে করলে ধস নামত না।”
বাঁধ যাতে না ভাঙে, সে জন্য নদীরতীরে পাথর-সিমেন্টের ব্লক দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, জাইকার অর্থায়নে ওই এলাকায় ভিন্ন ডিজাইনে এ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। মাটির সংকট থাকায় প্রথমে বাঁধের মাঝের স্থানে ড্রেন কেটে বালু দিয়ে ভরাট করা হয়। পরে দুইপাশে মাটির দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। এটি 'নতুন প্রযুক্তি'।
আগামীতে এ প্রযুক্তিতেই সব বাঁধ নির্মাণ করা হবে বলেও জানান তিনি।