Published : 24 Oct 2024, 12:00 AM
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির অধীন চা বাগানের শ্রমিকরা সাত সপ্তাহ ধরে ‘হাজিরা’ পাচ্ছেন না। বেতনের দাবিতে ধর্মঘটে থাকা শ্রমিকদের দাবি, তারা ‘খেয়ে না খেয়ে’ দিন কাটাচ্ছেন।
একই সঙ্গে সিলেট জেলায় ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক চা বাগানেও শ্রমিকদের বেতন বকেয়া পড়েছে। এজন্য মালিকপক্ষ নিলামে চায়ের দাম না বাড়াকে দায়ী করেছেন।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্যমতে, সারাদেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির ফাঁড়ি বাগানসহ ১৬টি চা-বাগান রয়েছে। এসব বাগানে প্রায় ১৭ হাজার চা-শ্রমিক কাজ করেন। তাদের ওপর আরও ৩০ হাজার মানুষের ভরণপোষণ নির্ভর করে।
বুধবার বিকালে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু গোয়ালা বলেন, সিলেটে এনটিসি মালিকানাধীন লাক্কাতুরা, দলদলি ও কেওয়াছড়া চা বাগানে সাত সপ্তাহ ধরে শ্রমিকদের বেতন বন্ধ রয়েছে। বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করছেন।
মঙ্গলবার সকালে লাক্কাতুরায় ন্যাশনাল টি কোম্পানির কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন শ্রমিকেরা। বকেয়া বেতনের দাবিতে বৃহস্পতিবার সকালে আবার মানববন্ধন করবেন তারা।
চলতি সপ্তাহে শ্রমিকরা তিন দিন ধরে কর্মবিরতি পালন করছেন। এর আগে শ্রমিকদের ছয় সপ্তাহের বেতন বকেয়া পড়েছে আর চলতি সপ্তাহ হলে সাত সপ্তাহ হবে। তবে কোম্পানি শ্রমিকদের বেতনের ব্যাপারে কিছু জানাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন রাজু গোয়ালা।
বেতন বন্ধ থাকার কারণে শ্রমিকেরা কষ্টে আছে জানিয়ে রাজু গোয়ালা বলেন, “চা শ্রমিকেরা ঠিকমত খেতেও পারছে না। বকেয়া বেতনের দাবিতে আমাদের কর্মবিরতি চলছে জেনে সিলেটের জেলা প্রশাসক তিনটি চা শ্রমিকের জন্য প্রায় ২৪ টন চাল বরাদ্দ দিয়েছেন; তা কাল (বৃহস্পতিবার) বিতরণ করা হবে। শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সিলেটের জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ জানাই।”
ন্যাশনাল টি কোম্পানির আওতাধীন সিলেট বিভাগের ১২টি চা বাগানেই বেতন বকেয়া পড়েছে বলে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু গোয়ালা জানান।
সিলেট শহরতলির লাক্কাতুরা চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি সিতু লোহার বলেন, “বৃহস্পতিবার আমরা আবার মানববন্ধন করব আমাদের বকেয়া বেতনের দাবিতে। আমাদের কর্মবিরতি চলছে, কিন্তু কোম্পানি আমাদের কিছুই জানাচ্ছে না।”
সিলেটের দলদলি চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি মিন্টু দাস বলেন, “চলতি সপ্তাহসহ আমাদের সাত সপ্তাহের বেতন বকেয়া পড়েছে। কোম্পানি আমাদের কিছু জানাচ্ছে না বকেয়া বেতনের বিষয়ে। বকেয়া বেতনের দাবিতে আমরা তিন দিন ধরে কর্মবিরতি পালন করছি। বেতন না পাওয়াতে শ্রমিকেরা মানবেতর জীবনযাপন করছে।”
লাক্কাতুরা চা বাগানের শ্রমিক লিটন গোয়ালা বলেন, “বেতন বন্ধ থাকার কারণে শ্রমিকেরা লাকড়ি ও বাগানে লতা তুলে যা ইনকাম হচ্ছে, তা দিয়েই সংসার চালাচ্ছে। চা শ্রমিকদের বেতন বন্ধ থাকলে যার হাতে টাকা থাকে সে খেতে পারে; আর যার হাতে টাকা নেই সে না খেয়ে থাকে। এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা। শ্রমিকরা প্রতিদিন যে টাকা বেতন পায় তা দিয়ে বর্তমানে এক কেজি পাঙ্গাস মাছও কেনা যায় না। আমাদের কথা ভাবে না সমাজে।”
লাক্কাতুরা চা বাগানের নারী শ্রমিক সুনতি লোহার বলেন, “বেতন বন্ধ থাকার কারণে পরিবার নিয়ে না খেয়ে দিন যাচ্ছে। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে মহাঝামেলায় পড়েছি। তাদের কিভাবে বোঝাই যে বেতন বন্ধ রয়েছে।
“আমাদের ১৭০ টাকা মজুরি বন্ধ রেখে কী লাভ হয়? এই টাকা কী এমন মিলে যে বন্ধ রাখতে হয়। চা শ্রমিকদের কথা শুনার মত কেউ নাই দেশে। আমরা না খেয়ে মরলে গেলে কোনো ক্ষতি হবে না।”
এনটিসি কী বলছে
ন্যাশনাল টি কোম্পানি-এনটিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহমুদ হাসান বলেন, “কোম্পানি কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের ফান্ড জোগাড়ে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ হচ্ছে। চা শ্রমিকরা তাদের বকেয়া মজুরি পাবেন; আশা করছি, দ্রতই আমরা এ সমস্যার সমাধান করতে পারব।”
ব্যক্তি মালিকানা বাগানেও বকেয়া
সিলেটের বুরজান চা বাগান কোম্পানির অধীন বাগানের শ্রমিক ও কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের বেতনও বকেয়া পড়েছে।
তবে সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানিয়েছেন, চা পাতার দাম না বাড়ার কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সরকার যদি দ্রুত কোনো পদক্ষেপ না নেয় তাহলে চা শিল্প সংকটে পড়বে। সবকিছুর দাম বাড়লেও বাড়েনি চা পাতার দাম।
সিলেটের বুরজান চা বাগান কোম্পানির অধীন কালাগুল চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি রঞ্জু নায়েক বলেন, “আমাদের চা শ্রমিকদের পূজার আগে তিন সপ্তাহের বেতন বকেয়া রয়েছে। বর্তমানে চালু আছে। কাল (বৃহস্পতিবার) আমাদের বেতন হওয়ার কথা; তবে হবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আমরা খুব কষ্টে আছি। আমরা কার কাছে যাব বলেন? পূজার আগে বকেয়া বেতনের জন্য আমরা কর্মবিরতি পালন করেছি।”
বুরজান চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি সুবাস নায়েক রতিলাল বলেন, “আমরা যারা মাসিক বেতনে কাজ করি আমাদের ৩ মাসের বেতন বন্ধ রয়েছে। আর চা শ্রমিকদের চার সপ্তাহের বেতন বন্ধ রয়েছে। আমরা চা শ্রমিকরা কষ্টে দিন পার করছি। পাতার দাম নেই বলে কোম্পানি বেতন বন্ধ করে রেখেছে। আমাদের দুঃখ দেখার কেউ নেই।”
ছড়াগাঙ চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি চাষা বলেন, “আমাদের বাগানের শ্রমিকদের চার সপ্তাহের বেতন বকেয়া পড়েছে। তবে এক মাস ধরে বেতন রানিং আছে। আমাদের বকেয়া বেতনের জন্য পূজার আগে মিটিং হয়েছিল ম্যানেজারের সঙ্গে, তিনি বলেছেন বকেয়া বেতন দিয়ে দেবেন। তবে কবে আমাদের বকেয়া বেতন দেওয়া হবে তা জানানো হয়নি।”
বুরজান চা বাগান কোম্পানির ম্যানেজার মো. কামরুজ্জামান বলেন, “অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে এটি হয়েছে। প্রত্যেক জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে চা বাগানে শতকরা ৩০ ভাগ খরচ বেড়ে গেছে; এজন্য সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
“তবে আমরা বেতন রানিং রেখেছি। বকেয়া পড়া বেতন শ্রমিকদের দিয়ে দেওয়া হবে। বর্তমানে সিলেটের বিভিন্ন বাগানে মালিকপক্ষ লস দিয়ে বাগান চালাচ্ছেন। চা পাতার দাম না বাড়ালে; এভাবে কতদিন চলবে তাও বলা যাচ্ছে না।”