Published : 25 Jul 2023, 12:49 AM
পোশাক কারখানার আগুন নেভাতে যাওয়ার পথে গাড়ি নিয়ে দুর্ঘটনার শিকার ফায়ার সার্ভিসের নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ স্টেশনের চালক জাহাঙ্গীর হোসেন আগে থেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন বলে সহকর্মী ও পরিবার জানিয়েছে।
সোমবার সকালে আগুন নেভাতে যাওয়ার পথে শহরের চাষাঢ়া ট্রাফিক বক্সের সামনে চলন্ত গাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান জাহাঙ্গীর। পরে সেই গাড়িটি আরও কয়েকটি গাড়ি ও রিকশাকে ধাক্কা দিলে তিনজন নিহত হন।
৪৮ বছর বয়সী জাহাঙ্গীরের বাড়ি কুমিল্লা সদর উপজেলার দুর্গাপুর আড়াইওরা এলাকায়। মৃত আব্দুল আজিজের ছেলে জাহাঙ্গীর ১৯৯৪ সালের ১৫ নভেম্বর চাকরিতে যোগ দেন।
ঘটনার সময় চালক জাহাঙ্গীরের পাশের আসনে ছিলেন হাজীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার ওবায়দুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আগুনের খবর পেয়ে স্টেশন থেকে গাড়ি বের হয়। সড়কে গাড়ি চলমান অবস্থায় হঠাৎ ঢলে পড়েন চালক জাহাঙ্গীর। এরপরই গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কিছু যানবাহনে ধাক্কা দেয়।
“গাড়ি চালানো অবস্থাতেই চালক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারণা করছি। ঘটনা এতটাই দ্রুত ঘটেছে যে, আমি গিয়ে স্টিয়ারিং ধরব বা কিছু করব তার সুযোগ ছিল না।”
জাহাঙ্গীর হোসেনের একাধিক সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোববার দিবাগত রাতে ফতুল্লার সস্তাপুর এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ডিউটিতে ছিলেন তিনি। ফজরের আজানের সময় তিনি গাড়িসহ স্টেশনে ফেরেন। সহকর্মীদের সঙ্গে নামাজ পড়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার সকাল ৮টা থেকে ডিউটি শুরু করেন।
সকাল সাড়ে ১০টায় বিসিক শিল্পনগরীতে অপর একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে গাড়ি নিয়ে বের হন। তবে বের হওয়ার সময় তার শারীরিক কোনো অসুস্থতা দেখেননি সহকর্মীরা।
ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মী টানা ৪৮ ঘণ্টা ডিউটি করেন। টানা ডিউটির পর ২৪ ঘণ্টা তিনি বিশ্রাম করেন বলে জানান নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন আহাম্মদ।
জাহাঙ্গীরের স্বজনদের বরাতে তিনি আরও বলেন, “জাহাঙ্গীর হোসেনের হৃদরোগজনিত সমস্যা ছিল। তিনি এর আগেও একবার হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন। তাকে ভারতে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয় বলেও স্বজনরা জানিয়েছেন।”
এই ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
এদিকে জাহাঙ্গীরের মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালে।
এ হাসপাতলের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শেখ ফরহাদ বলেন, “দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর হোসেনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। কী কারণে তার মৃত্যু হয়েছে তা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে নিশ্চিত করে বলা যাবে।”
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শহরের চাষাঢ়ায় সান্ত্বনা মার্কেটের সামনে ট্রাফিক সিগন্যাল পার হওয়ার পরই নিয়ন্ত্রণ হারায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়িটি। গাড়িটি সোজা চাষাঢ়া-পঞ্চবটি সড়কের দিকে যাওয়ার কথা থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়কের দিকে ঢুকে পড়ে।
এই সময় সড়কে থাকা আনন্দ পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস, প্রাইভেট কার, রিকশা ও দুটি ইজিবাইককে ধাক্কা দেয়। এতে রিকশা ও ইজিবাইক তিনটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
এ দুর্ঘটনায় সালাউদ্দিন সাবু (৪৫) নামে একজন পথচারী যাত্রীবাহী বাসটির নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। বাসটির প্লেট কেটে তাকে ভেতর থেকে বের করা হয় বলে জানায় পুলিশ।
গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান রিকশাচালক সিরাজুল ইসলামও (৫০)।
পরে রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চাঁদমারী এলাকার বাসিন্দা আমজাদ হোসেন (৪৫)৷ তিনি মামুন এন্টারপ্রাইজ নামে পরিবহনের ম্যানেজার ছিলেন বলে জানায় পুলিশ৷
রিকশাচালক সিরাজুলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সহকর্মী মো. সবুজ বলেন, একই গ্যারেজের রিকশা চালান তারা। সকালে রিকশা নিয়ে বের হন সিরাজুল। চাষাঢ়ায় দুর্ঘটনায় তিনি আহত হয়েছেন খবর পেয়ে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে যান। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলেন চিকিৎসক। ঢাকায় নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, দুপুর আনুমানিক ২টার দিকে হাসপাতালে আনার পর সিরাজুল ইসলামকে মৃত ঘোষণা করেন জরুরি বিভাগের চিকিৎসক। রাত ৯টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আমজাদ৷
এই ঘটনায় আরও ছয়জন আহত হয়েছেন। তারা হলেন- নারায়ণগঞ্জ শহরের খানপুর এলাকার ইরানি (২৬), জামতলা এলাকার সারা (১৮), একই এলাকার নাজমা (৪০), খানপুর সরদারপাড়া এলাকার মো. রোকন (৪০) এবং মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরের রেশমা (৪০)। তারা শহরের খানপুর এলাকায় অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগে চিকিৎসাধীন রিকশাচালক রোকন বলেন, শহরের পপুলার ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের সামনে থেকে দুজন যাত্রী নিয়ে চাঁদমারী এলাকার দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। এমন সময় ফায়ার সার্ভিসের গাড়িটি তার রিকশায় ধাক্কা দিলে তিনি ছিটকে পড়েন। গাড়ির চাপার নিচে পিষ্ট হয় তার বা পা। পরে ফায়ার সার্ভিসেরই আরেকটি গাড়িতে তাকে হাসপাতালে আনা হয়।
এ ঘটনায় রাত ১২টা পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি আনিচুর রহমান মোল্লা বলেন, এই দুর্ঘটনায় একত্রে কয়েকটি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছেন ফায়ার সার্ভিসের গাড়িচালক, একজন পথচারী ও একজন রিকশাচালক। কীভাবে এবং কী কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে এই বিষয়ে তদন্ত করছে পুলিশ।
“ফায়ার সার্ভিসের গাড়িটির চালক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন নাকি অন্য কোনো বিষয় ছিল, তা জানতে তদন্ত করছে পুলিশ”, যোগ করেন ওসি।