Published : 10 Jun 2024, 09:16 PM
প্রায় দুই দশক আগে টিলা ধসে একজনের মৃত্যুর দুঃখজনক স্মৃতি আবার ফিরে এসেছে সিলেট মহানগরীর চামেলীবাগ এলাকার বাসিন্দাদের মনে। টানা বর্ষণের কারণে সোমবার ভোরে সেখানে আবার টিলা ধসে স্বামী-স্ত্রী ও তাদের শিশু সন্তানের মৃত্যু হয়েছে।
টিলা ধসে আটকা পড়েছিলেন একই পরিবারের ছয়জন। তাদের মধ্যে তিনজনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করতে পেরেছেন স্বজন, প্রতিবেশী ও স্থানীয় বাসিন্দারা।
কিন্তু অন্য ঘরে থাকা আগা করিম উদ্দিন (৩৫), তার স্ত্রী শাম্মী আক্তার রোজি (২৬) এবং তাদের ১৫ মাস বয়সী ছেলে নাফজি তানিমকে বাঁচানো যায়নি। করিম ওই এলাকার মৃত আলা উদ্দিনের ছেলে।
দুপুর ১টার দিকে নগরীর ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের চামেলীবাগ এলাকার ২ নম্বর রোডের ৮৯ নম্বর বাসা থেকে মাটিচাপা অবস্থায় তিনজনের লাশ উদ্ধার করেন সেনা সদস্যরা।
বেঁচে যান করিম উদ্দিনের মা ইয়াসমিন বেগম (৬৫), বড় ভাই আগা রহিম উদ্দিন (৪০), তার স্ত্রী তাহমিনা বেগম (৩০), মেয়ে তাহসিনা (১০), তাসনিয়া (৫) ও ছয় মাসের শিশু তাসকিয়া।
পরিবারটিতে চলছে শোকের মাতম। পরিবারের তিন সদস্যকে হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করছিলেন আগা করিম উদ্দিনের মা ইয়াসমিন বেগম।
স্বজনরা জানায়, বাড়িতে একই ছাদের নিচে আগা করিম উদ্দিন ও আগা রহিম উদ্দিনের আলাদা সংসার। বড় ছেলে রহিমের স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে থাকতেন মা ইয়াসমিন বেগমও।
ইয়াসমিন বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, তিনি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেন। বারান্দায় কিছু সময় হাঁটাহাঁটির পর তিনি ফের বিছানায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় হঠাৎ করে বিকট শব্দে ঘরের উপর কিছু একটা পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে মাটি এসে পুরো ঘর অন্ধকার করে ফেলে। ছোট ছেলে করিমের ঘর ছিল ভেতরের দিকে।
তিনি বলেন, টিলা ধসে প্রথমে ঘরের টিনসহ সবকিছু মাটির সঙ্গে মিশে যায়। তখন ঘটনাটি বুঝতে পেরে করিমের স্ত্রী, সন্তান ও তিনি মাটির ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনোভাবেই বের হতে পারছিলেন না। পরে প্রতিবেশী ও স্থানীয়রা গিয়ে তাদের উদ্ধার করেন।
ইয়াসমিন বলেন, “বড় ছেলে রহিম গলা পর্যন্ত মাটি চাপা পড়েছিল। অনেক চেষ্টা করে তাকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা। কিন্তু ছোট ছেলে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ঘুমে থাকায় তারা আর বেরিয়ে আসতে পারেননি।
“প্রায় ২০ বছর আগে একবার এই টিলা ধসে পড়েছিল। তখন একজন মারাও গেছে। আমরা এতদিন নিরাপদেই বসবাস করছি। অথচ আজ আমার সব শেষ হয়ে গেল”, বলছিলেন ইয়াসমিন বেগম।
তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করেই সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেখানকার চিকিৎসক তিনজনকেই মৃত ঘোষণা করেন। রহিম উদ্দিন (৪০) ও তার ছোট মেয়ে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় গেছেন।
সিলেটে টিলা ধস, ৩ জনের লাশ উদ্ধার
পরে তিনটি মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে সন্ধ্যায় স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। স্বজনরা জানিয়েছেন, রাত ৯টায় তাদের জানাজা শেষে দাফন করা হবে।
বেলা ৩টার দিকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, করিমের শিশু ছেলের নিথর দেহটি পড়ে আছে। সঙ্গে থাকা স্বজনরা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন।
সাড়ে ৩টার দিকে কাগজপত্র নিয়ে হাসপাতালে আসেন নিহত আগা করিম উদ্দিনের চাচাতো ভাই আগা তাজিম উদ্দিন। তিনি পাশেই আরেকটি বাড়িতে থাকেন।
তিনি বলেন, “গিয়ে দেখি, টিলার পুরো মাটি ঘরের উপরে পড়ে আছে। বাসার পেছনের দেয়াল ও ঘরের দেয়াল ভেঙে গেছে। প্রথমে গিয়ে আমরা রহিম ভাই আর তাইনের ছোট মেয়েকে উদ্ধার করি। রহিম ভাই ছোট মেয়েকে উদ্ধার করতে গিয়ে আঘাত পেয়ে যান। তারপর চাচি, ভাবিসহ দুই মেয়েকে আমরা দূরে সরিয়ে আনি।
“কিন্তু করিম ভাই যে রুমে, ওই রুমসহ অন্য আরেকটি রুমের উপর টিলার মাটি বেশি পড়ার কারণে তাদের দেখা যাচ্ছিল না। পরে আমরা মাটি সরানোর কাজে লেগে যাই। পরে একে একে মাটি সরানোর কাজে এসে লাগে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনী; সঙ্গে ছিল স্থানীয়রাও। তবে রাস্তা ছোট থাকার কারণে মাটি সরানোর কাজ দেরি হয়েছে”, বলছিলেন তাজিম উদ্দিন।
নিহত করিম উদ্দিনের চাচাত ভাইয়ের স্ত্রী শিউলি বেগম বলেন, “গিয়ে দেখি পুরো টিলার মাটি বাসার উপরে। প্রথমে নিজেরা মাটি সরানো কাজে লেগে যাই। পরে আরও মানুষ এসে কাজে লাগেন। রাস্তার জায়গা ছোট হওয়ার কারণে দেরি হচ্ছিল। কিন্তু মাটি সারানোর পরও তাদের কোনো খোঁজ মিলছিল না।”
তিনি বলেন, “পরে সেনাবাহিনী কাজে লাগার আধ ঘণ্টার মধ্যে পালং (খাট) থেকে তাদের উদ্ধার করে। যেলা রাইত ঘুমাইছিলাইন ওলাও পাইছইন মাটি হরাইয়া। (যেভাবে বিছানায় ঘুমিয়েছিল মাটি সরিয়ে সেভাবেই পাওয়া গেছে)। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আনা হইল, কিন্তু কোনো লাভ হইল না।”
ওসমানী হাসপাতালের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন করিম উদ্দিনের শাশুড়ি রুমা বেগম (৪৫)। বলছিলেন, করিম একদিকে তার ভাসুরের ছেলে; অপরদিকে ‘দামান’ (মেয়েজামাই)। একই পাড়াতেই থাকে দুই পরিবার। তিন বছর আগে মেয়েকে বিয়ে দেন করিমের সঙ্গে। করিম স্থানীয় একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করতেন।
রুমা বেগম বলেন, “পুরা ঘরের মধ্যে টিলার মাটি পড়েছে। প্রথমে তাদের কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না। মাটি চাপার ছয় ঘণ্টা পর উদ্ধার করা হয়, এত সময় মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকবে?
“আমার মেয়ের মুখে মাটি পড়ে কালো দাগ হয়ে গেছে। দাঁত ভেঙে গেছে। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। ছোট নাতিটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। তারা রাইতে যেলা ঘুমাইছইন মাটি হরানোর পরে ইলাই মিলছে। মাঝখানে বাচ্চা আর দুইপাশে দুইজন” বলছিলেন রুমা বেগম।