Published : 05 Jan 2024, 07:34 AM
মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে বরাবর বাবার মত সহজ জয়ই পেয়েছেন ছেলে মাহি বি চৌধুরী। শেষ নির্বাচনে সমঝোতার ভিত্তিতে নৌকায় উঠতে পারলেও এবার কুলা হাতে দৌড়াতে হচ্ছে বিকল্পধারা বাংলাদেশের এই প্রার্থীকে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছেলের সামনে এবার বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখতে পাচ্ছেন সাধারণ ভোটাররা। জয়ী হতে হলে সিরাজদিখান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নৌকা প্রতীকের মহিউদ্দিন আহমেদ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ট্রাক প্রতীকের গোলাম সারোয়ার কবীরকে মোকাবিলা করতে হবে মাহি বি চৌধুরীকে।
সাবেক বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার মেয়ে তৃণমূল বিএনপি চেয়ারপারসন অন্তরা হুদার বাড়ি দোহারে। কিন্তু তিনি পাশের এলাকা মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে এসে নির্বাচন করছেন। যদিও সোনালী আঁশ প্রতীকের প্রার্থী অন্তরা প্রচারে বড় ধরনের কোনো প্রভাব ফেলতে পারেননি।
সিরাজদিখান ও শ্রীনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনে চলছে শেষ মুহূর্তের নির্বাচনি উত্তাপ। প্রচার আর স্লোগানে মুখরিত চারপাশ। পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে পথঘাট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে প্রচারমূলক নানা কার্যক্রম।
ভোটারদের অভিমত, প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল ২০১৮ সালের মত এবারও আসনটি আওয়ামী লীগ বিকল্পধারা বাংলাদেশকে ছেড়ে দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলীয় প্রার্থী দেওয়ায় মাহী বি চৌধুরী তার দল থেকেই প্রার্থী হন।
এই আসনে নয়জন প্রার্থী থাকলেও লড়াই হবে ত্রিমুখী। এখানে এবার প্রায় সাড়ে ৬৮ হাজার নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছেন। এই নতুন ভোটার যেদিকে ঝুঁকবে তার জয়ের পাল্লা ভারী থাকবে।
তবে ভোটারদের একটি বড় অভিযোগ, কোভিডের সময়ে মাহী বি চৌধুরীকে সেভাবে এলাকায় পাননি সাধারণ মানুষ। এর প্রভাব এবারের ভোটে পড়তে পারে। তা ছাড়া বিগত নির্বাচনগুলোতে তার পক্ষে যেভাবে মানুষ জমায়েত হতেন, প্রচার কাজ চালাতেন, এবার সেখানে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। অবশ্য পারিবারিকভাবেই তিন প্রজন্মের রাজনৈতিক ঐতিহ্য রয়েছে তাদের। তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ‘শান্তি এক্সপ্রেস’ স্লোগানে প্রচার চালিয়েছেন।
এখানে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা তাদের পক্ষে ভাগ হয়ে গেছেন। ফলে নৌকার ভোট ভাগ হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
আবার এই নির্বাচনে বিএনপি আসেনি। বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পরিবার বিএনপির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে দলটির সঙ্গে যুক্ত ছিল। এখন পরিবারের সদস্যরা ওই দলের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও এলাকায় পুরনো নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ও সদ্ভাব সবসময়ই ছিল।
সেই ভোটারদের একটি অংশও যদি ভোট দিতে আসেন, তাহলে সেটা মাহি বি চৌধুরীর জয়ের পালেই হাওয়া দেবে বলে স্থানীয়রা মনে করছেন। ফলে জয়-পরাজয়ের হিসাব এখানে জটিল হয়ে উঠেছে।
এ আসনের অন্য প্রার্থীরা হলেন- জাতীয় পার্টির শেখ মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম (লাঙ্গল), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আতাউল্লাহ (বটগাছ), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির প্রার্থী দোয়েল আক্তার (আম), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির বাউল শিল্পী লতিফ সরকার (একতারা), বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী নুরজাহান বেগম রিতা (ডাব)।
মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে মোট ভোটার ৫ লাখ ৮ হাজার ৯৮৬ জন। নারী ভোটার ২ লাখ ৪৭ হাজার ১৩৮ জন এবং পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৬১ হাজার ৮৪৮ জন।
এই আসনের দুই উপজেলায় মোট ইউনিয়ন ২৮টি। মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১৭০টি। এর মধ্যে শ্রীনগর উপজেলায় মোট ভোটার ২ লাখ ৫৩ হাজার ৭৮৪ এবং সিরাজদিখান উপজেলায় মোট ভোটার ২ লাখ ৫৫ হাজার ২০২।
১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে বিএনপির হয়ে এখানে জিতেছেন এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত হন।
২০০৮ ও ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ থেকে এখানে নির্বাচিত হন সুকুমার রঞ্জন ঘোষ।
সমঝোতার অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে আসনটি আওয়ামী লীগ বিকল্প ধারার কাছে ছেড়ে দেয়। বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছেলে মাহি বি চৌধুরী নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেন।
২০০২ সালে বদরুদ্দোজা চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর মুন্সীগঞ্জ আসনটি শূন্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। পরে সেখান থেকে মাহী বি চৌধুরী উপ-নির্বাচনে পাশ করে প্রথমবারের মত সংসদ সদস্য হন।
অভিশংসনের মুখে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করা বদরুদ্দোজা চৌধুরী পরবর্তীতে বিকল্পধারা বাংলাদেশ নামে দল গঠন করেন। ছেলে মাহী বি চৌধুরীও সেই দলে যোগ দেন। ২০০৪ সালের জুনে ফের উপ-নির্বাচন হলে বিকল্পধারার কুলা প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেন মাহী।
নৌকার প্রার্থী থাকলেও এখানে আওয়ামী লীগের নেতাদের একটি অংশ সরাসরি ট্রাক প্রতীকের প্রার্থী গোলাম সারোয়ার কবীরকে সমর্থন দিচ্ছেন। সিরাজদিখান উপজেলার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মইনুল হাসান নাহিদ, সিরাজদিখান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন, সহসভপতি মান্নান কোম্পানী, রফিকুল ইসলাম বাবুল, উপজেলা কমিটির সদস্য আবুল খায়ের ব্যাপারী, কেয়াইন ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফ আলী, সাধারণ সম্পাদক অসীত কুমার দাস, চিত্রকোট ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সামসুল হুদা বাবুল, সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব, রশুনিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাইদ ট্রাক প্রতীকের পক্ষে কাজ করছেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে যারা মাহী বি চৌধুরীর জন্য কাজ করেছিলেন, তারা এবার নৌকা ও ট্রাক প্রতীকে চলে গেছেন। মাহীর সঙ্গে কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকে দেখা যায়নি।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ মহিউদ্দিন আহমেদ বর্তমান সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কথা বলে ভোটারদের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাচ্ছেন।
সিরাজদিখান উপজেলার ইছাপুর ইউনিয়নের ডেকোরেটর ব্যবসায়ী আমির হোসেন বলেন, “আমরা এমন ব্যক্তিকে ভোট দেব, যাকে আমরা সবসময় পাশে পাই। বিপদে-আপদে কাছে পাই। বর্তমান সংসদ সদস্য মাহী বি চৌধুরী সিরাজদিখানে আসেন না। তিনি শ্রীনগরের মানুষ। শ্রীনগরেই তার কাছে প্রাধান্য পায়।”
শ্রীনগরের বিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্র সাকিব বলেন, “আমি এবছর প্রথম ভোট দেব। এটা আমার জন্য স্মরণীয় দিন হবে। আমরা চাই আমাদের দেশের উন্নয়ন হোক। এমন নেতাই আমরা চাই। সহিংসতা যারা করবে এমন নেতা আমরা চাই না। আবার যারা বিপদে দূরে সরে থাকবে এমন নেতাও আমরা চাই না।”
শ্রীনগর চক বাজারের ভ্রাম্যমাণ ফল বিক্রেতা সেলিম বলেন, “যখন আমরা চরম সমস্যায় ছিলাম, করোনাভাইরাসের সময় আমরা কাউকে পাই নাই। অনেক কষ্ট গেছে। কাম-কাজ ছিল না। ভয় আতঙ্ক ছিল।
“এবার আমরা হেরেই ভোট দিমু, যারে পাশে পামু। গরিবের পাশে যে দাঁড়াইতে পারে তারেই ভোট দিমু। গরিবে যেন তার সাথে কথা বলতে পারে তারেই ভোট দিমু। যে এখন গরিবের বোগলে আহে পড়ে ধাক্কা দিয়া ফালায় দিমু। তাগো তো ভোট দিয়া লাভ নাই। সবসময় আমরা গরিবরা যার লগে কথা কইতে পারুম তারে ভোট দিমু। এমন প্রার্থী আমাদের এখানে আছে। আমরা তারেই ভোট দিমু।”
প্রার্থীদের কথা
মাহী বি চৌধুরী বলেন, “এখানে আমাদের তিন পুরুষের রাজনীতি। আমাদের শেকড় অনেক গভীরে। আমরা এখানে ১০টি নির্বাচন করেছি। এখানে আমাদের দল ছোট হতে পারে। কর্মী কম হতে পারে। কিন্তু আমাদের সমর্থক প্রতি ঘরে ঘরে আছে।
“আমাদেরকে বলা হয় মানুষ ভালো, কিন্তু কাজ করে নাই। এটা মিথ্যা কথা। গত ৫ বছরে শ্রীনগর-সিরাজদিখানে ৬৩০ কোটি টাকার উন্নয়ন হয়েছে। আমার কর্মীরা কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়ে নাই। একটা টাকাও চাঁদাবাজি করে নাই। রাজনীতিতে একটি জিনিস শিখেছি, কর্মী যত কম, মানুষের শন্তি তত বেশি। কর্মী যত বেশি, মানুষের শান্তি তত কম।”
আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, “নৌকায় ভোট দিলে জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটে। আমি সারা জীবন আপনাদের পাশে ছিলাম, আছি, থাকব। আপনারাও আমাদের পাশে ছিলেন। আগামী ৭ জানুয়ারি সারাদিন নৌকা মার্কায় আমাকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেবেন।”
স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম সারোয়ার কবির বলেন, “আমি মনে করি, এখানকার মানুষের পাশে থেকে আমি তাদের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি আমি যেমন আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষের পাশে ছিলাম তারাও আমার পাশে থাকবে।”