Published : 07 Mar 2025, 04:06 PM
অমর কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণ তার ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে নদীটির কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ আর প্রাণভরা উচ্ছ্বাসের কথা বর্ণনা করেছিলেন। সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছিলেন মালোপাড়ার জেলেদের জীবনযুদ্ধের চিত্র।
কিন্তু তিতাসের সেই ভরা যৌবন আর নেই। তাতে আরও কঠিন হয়েছে মালোপাড়ার জীবন।
১০৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৩০ মিটার প্রস্থের তিতাস নদীটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কয়েকটি উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে। প্রায় ৫৫ বছর ধরে এ নদীতে মাছ ধরছেন নির্মল মল্লবর্মণ।
শহরের মালোপাড়ার এ বাসিন্দা বলেন, ২০০৪ সালেও তার জালে ধরা পড়ত বড় বোয়াল, কাতলা, সিলভার কার্প, আইড়, চিংড়ি, পাবদা ও মাগুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। তখন একদিন জাল ফেলে যে মাছ ধরতেন তা বিক্রি করেই ভালোভাবে এক সপ্তাহ চলত সংসার। কিন্তু এখন আর নদীতে আগের মতো মাছ নাই।
৬৬ বছর বয়সী এ জেলে বলেন, অনেকবার পেশা পরিবর্তন করার কথা চিন্তা করলেও পূর্বপুরুষের পেশা হওয়ায় ছাড়তে পারেননি। ভরা মৌসুম ছাড়া নদীতে মাছ পাওয়া যায় না এজন্য জাল ছেড়ে ৮ মাস পুকুরের মাছ কিনে দোকানে বসে বিক্রি করেন। বাকী ৪ মাস তিতাসে মাছ ধরেন।
তিনি আরও জানান- তার দুই ছেলেও মাছ ধরতেন তবে তিতাসে মাছ না পাওয়ায় এক ছেলে এখন অটোরিকশা চালায় আরেক ছেলেকে সম্প্রতি বিদেশ পাঠিয়েছেন।
একই অবস্থা পাড়ার অন্য বাসিন্দাদেরও। ফলে মানবেতর দিন কাটছে তাদের।
মালোপাড়ার এই জেলেদের অনেকেই এখন পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। তাদের কেউ দর্জি, কেউ সেলুন, কেউ বা কাঠমিস্ত্রি, অটোরিকশা চালিয়ে দিনযাপন করছেন।
সম্প্রতি শহরের গোকর্ণঘাট এলাকায় তিতাস নদীর পাড়ে মালোপাড়ায় গেলে দেখা যায় পাড়ায় ঢোকার পথেই রয়েছে অদ্বৈত মল্লবর্মণের মূর্তি।
সেখানে কথা হয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে, তারা জানান- বর্তমানে মালোপাড়ায় শতাধিক জেলে পরিবার বাস করলেও কেবল ৮-১০টি পরিবার এখনো মাছ ধরা পেশায় যুক্ত রয়েছে।
একসময় নদীতে জাল ফেললেই ঝাঁকে ঝাঁকে নানা প্রজাতির মাছ ধরা পড়তো। সেই মাছ বাজারে ভালো দামে বিক্রি করে চলত পরিবারগুলো। কিন্তু এখন আর আগের সেই চিত্র নেই।
দুই পাড়ে অবৈধ দখল আর দূষণের কারণে দিন দিন জরাজীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে তিতাস নদী। বাসা-বাড়ি ও হোটেলের বর্জ্য ফেলা হয় নদীর তীরে।
ফলে যে তিতাস মালোপাড়ার জেলেদের জীবন জুড়ে সেই তিতাসই এখন তাদের একমাত্র দুঃখ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জেলেদের অভিযোগ, নদীতে আগের মতো মাছ তো নেই, যা আছে তা-ও ধরে ফেলা হচ্ছে অবৈধ কারেন্ট জাল, রিং জাল দিয়ে। তার সঙ্গে বর্তমানে যোগ হয়েছে ‘কারেন্টের শক’ দিয়ে মাছ ধরা।
মালোপাড়ার বাসিন্দা নগিন্দ্র মল্লবর্মণ (৬৪) বলেন, “৫০ বছর ধরে নদীতে মাছ ধরছি। মাছ বিক্রি করেই চলে সাত সদস্যের পরিবার। এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। কারণ রিং জাল, কারেন্ট জাল ও কারেন্টের শক দিয়ে ছোট থেকে বড় মাছগুলো বাহিরের জেলেরা ধরে নিয়ে যায়।”
‘কারেন্টের শক’ দিয়ে মাছ ধরা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “এক ধরনের রড আছে সেটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারির সাহায্যে জয়েন দিয়ে রডটি পানিতে ছেড়ে দেয়। তখন রডের ১০-১২ হাতের চারপাশে ছোট থেকে বড় যত মাছ সেগুলা কারেন্টের শক লেগে মরে গিয়ে ভেসে উঠে।”
তিনি অভিযোগ করেন, এ বিষয়ে মালোপাড়ার অনেকেই মৎস্য অফিসে জানালেও দিলেও তারা কোনো উদ্যেোগ বা অভিযান পরিচালনা করেনি।
কান্দিপাড়া মাইমলপাড়ার আব্দুল আওয়াল (৭২) বলেন, “তিতাসের খালের পাড়েই আমার জন্ম হইছে। আমার বাবা মাছ মারতেন, আমি লগে যাইতাম। মাছ ধরা দেখতে আমার বালা লাগতো।
“১৫ বছর আগেও নদীতে মাছ পাইতাম এখন আর পাই না। বাপ-দাদা মাছ ধরতো মাছের লগে থাইক্কাই বড় হইছি। এখনও আমি মাছ ধরি নাইলে মাছ কিন্না আইন্না বাজারে বেঁছি।”
বৃদ্ধ এই জেলে আক্ষেপ করেন, “বর্ষা মৌসুম ছাড়া নদীডা হুগাইয়া (শুকিয়ে) যাইগা- নদীডা যদি আবার কাটতো সবসময়ই ফানি (পানি) থাকতো তাহলে আগের মতই মাছ পাইতাম।”
এ বিষয়ে জানতে জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মো. ছায়েদুর রহমানের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সিফাত মো. ইশতিয়াক ভূঁইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জেলা প্রশাসনের মাসিক মিটিংয়ে তিতাস নদীর দূষণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমি মৎস্য কর্মকর্তার সঙ্গেও কথা বলেছি- অতি শীঘ্রই কারেন্ট জাল, রিং জালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে। ”
তবে ১২ বল্টের ব্যাটারি দিয়ে শক দিয়ে মাছ মারার বিষয়টি এই প্রথম শুনেছেন বলে জানান ইউএনও। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে তিনি জানেন না, আগে কেউ জানায়নি। বিষয়টি নিয়ে মৎস্য কর্মকর্তা ও মালোপাড়ার জেলেদের সঙ্গে কথা বলবেন তিনি।
তিতাস নদী খননের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এটা একটি সমন্বিত প্রয়াস। খননের বিষয়টিও জেলা প্রশাসনের মাসিক সভায় আলোচনা করা হবে।”