Published : 29 Aug 2024, 02:20 AM
বন্যার পানি বাড়ির উঠানে সামান্য এলেও ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার জোহরা বেগম ভাবছিলেন ২১ অগাস্ট রাতটা হয়তো ঘরেই থাকতে পারবেন। কিন্তু বিকালের পর থেকেই পানি বাড়তেই থাকে। রাতে ঘরে থাকা অস্ভব হয়ে পড়ে।
একপর্যায়ে কোনো উপায় না থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে সাঁতরে একটু উঁচু জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নেন। বিধবা জোহরার সঙ্গে ছিলেন তার পক্ষাঘাতগ্রস্ত দেবর, তার স্ত্রী ও তাদের এক সন্তান। দেবরকে ঘর থেকে বের করতে খুব কষ্ট হয়েছে বলেও জানান জোহরা।
পরে তাদের ঘর পানির নিচে তলিয়ে যায়। তিনি চার দিন আর ঘরে ফিরতে পারেননি। অদূরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন চারজন। ঘর থেকে পানি নামার পর আবার বাড়ি এসেছেন। কিন্তু সবকিছু হারিয়ে তাদের অবস্থা এখন সঙ্গীন।
বুধবার সকালে উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের জঙ্গল মিয়া বাজার সংলগ্ন নিজ পানুয়া গ্রামের বড় খন্দকার বাড়ির প্রয়াত হাফিজু রহমানের স্ত্রী জোহরা বেগম সেদিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলছিলেন, “এক কাফড়ে ঘরতুন বাইর হইছি, হিন্দনের কাফোর ছাড়া কিছু নেই আন্ডার।” (এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়েছি। পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই আমাদের।)
তিনি বলেন, “বন্যা হইতে দেখছি। এত বন্যা আর ঘর বিরানা (নষ্ট) হয় নাই কোনো কালে। সাঁতার কেটে ঘর থেকে বেরিয়ে শুধু জীবন বাঁচাতে পেরেছি।”
জোহরার মতো একই সুরে কথা বলছিলেন একই ইউনিয়নের দক্ষিণ আন্দার মানিক গ্রামের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রিয়রঞ্জন পাল। তিনি বলেন, “ভাইসা, আঁর কিচ্ছু নাই। সব শেষ হই গেছেগই। বেগকিছু মাডির লগে মিশি গেছে। কবে এই ঘর জোড়ামু জানি না।”
কথাগুলো বলতে বলতে মাটিতে মিশে যাওয়া নিজের ঘরটি দেখিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন প্রিয়রঞ্জন। তিনি জানান, সেদিন আচমকা উজান থেকে আসা ঢলে ভেঙে পড়ে তার ঘর। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে কোনোমতে এক কাপড়ে বেরিয়ে আশ্রয় নেন পাশের একটি দোতলা ভবনের ছাদের উপর।
পানির স্রোত এতটাই তীব্র ছিল যে কিছুই বের করতে পারেননি তিনি। পেশায় কুমার এই পরিবার নিজেদের ঘরটি আবার কবে দাঁড় করাতে পারবেন সেটাই এখন দুশ্চিন্তার বিষয়।
একই গ্রামের রাজীব চন্দ্র পাল বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে যখন ঘরে পানি উঠছিল তখন তিনি ও তার ছোট ভাই নিপু চন্দ্র পাল পরিবার নিয়ে এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। পানি নামার পর ঘরে এসে দেখেন মাটির ঘরটি পুরোটাই ডেবে গেছে। ঘরের সব আসবাবপত্র মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে।
নিপু চন্দ্র পাল বলেন, “কুমারের কাজ করে পরিবার চলে। তৈরি সব জিনিসপত্র পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। বন্যার পানিতে ঘর গেছে, তৈরি পণ্য গেছে। এখন সামনের দিনগুলো কেমনে চলবে? সহায়তা না পেলে দাঁড়াতে পারব না।”
তিন বোনের সব বই নষ্ট
বন্যায় ভেঙে যাওয়া ঘর থেকে মালপত্র সরাতে ব্যস্ত দেখা গেল পঞ্চাশোর্ধ্ব সন্ধ্যা রানী পালকে। বন্যার পানি নামলেও তিন মেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি।
বলছিলেন, “থাকার ঘর নেই, খাবার নেই, পরনের একাধিক শুকনো কাপড় নেই। ছোট ছোট তিন মেয়ে নিয়ে কিভাবে সামনের সময় পার করবো?”
ছাগলনাইয়া মহিলা কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী সঞ্চিতা রানী পাল বলছিলেন, তার সব বই পানিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে।
বই নষ্ট হতে দেখে কান্না করছে ছোট দুই বোন জয়িতা রানী পাল ও সঙ্গীতা রানী পাল। সাংবাদিক দেখে দ্রুত ছুটে এসে ভেজা বইগুলো দেখাচ্ছিল। তারা বলছিল, বই না পেলে সামনে তাদের আর পরীক্ষা দেওয়া হবে না।
স্থানীয় ইলেকট্রিক দোকানদার অজয় কর্মকার বলেন, বন্যার পানিতে শুধু তার ঘরেই ক্ষয়ক্ষতি হয়নি; উপার্জনের একমাত্র দোকানটুকুও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দোকানে থাকা প্রায় তিন লাখ টাকার মালামাল নষ্ট হওয়ায় আগামীতে না খেয়ে থাকার উপক্রম হয়েছে।
এই ঘরগুলো পার হয়ে সামনে এগোতেই দেখা হয় স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী মোবারক হোসেনের সঙ্গে। তার বাবা নেই। তিন ভাই আর মা আছেন। পৈত্রিক সম্পত্তি বলতে মাটির ঘরই ছিলো শেষ সম্বল। তাও ভেঙে পুরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘর থেকে বের করা যায়নি কোনো আসবাবপত্র। শুধু গবাদিপশু রক্ষা করে উঁচু স্থানে সরাতে পেরেছিল তার পরিবার।
গ্রামটির বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব আব্দুর রহিম বলেন, তার জন্ম তো পরে, তার বাবার কিংবা দাদার জন্মেও এসব গ্রামে এত বেশি পানি কখনো দেখেনি কেউ। বন্যার কারণে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মাটি ও টিনের ঘরগুলো। এদিকে তেমন ত্রাণও বিতরণ হয়নি।
ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠাননগর ইউনিয়নের বাংলাবাজার গ্রামের ফারুক আহম্মেদ জানান, রোববার বন্যার পানিতে ভেলায় ভাসতে থাকা একটি লাশ দেখেছেন তিনিসহ গ্রামের লোকজন। চারিদিকে পানি থাকায় হয়তো মৃত ব্যক্তির দাফন করতে পারেননি স্বজনরা।
একই ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব হরিপুর গ্রামের ফরাজী বাড়ির বাসিন্দা জোসনা আক্তার (৫২) ও আবদুল ছলিম (৪০)। তাদের বসবাসের টিনের ঘর বন্যার স্রোতে ধসে পড়েছে। ফলে তাদের দুই পরিবারের ১২ জন সদস্যের মাথাগোঁজার শেষ আশ্রয়টুকুও হারিয়ে যায়। এমতাবস্থায় তারা কিভাবে আবার ঘর করবেন এ নিয়ে তাদের চোখে-মুখে হতাশা ফুটে ওঠেছে।
‘খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছি, ঘর করব কীভাবে’
ছাগলনাইয়া উপজেলার বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের পশ্চিম বক্সমাহমুদ গ্রামের মোহাম্মদ মুসা মিয়া বলেন, পশ্চিম বক্সমাহমুদ গ্রামটি নদীর পাড়ে হওয়ায় এ গ্রামের যত মাটির ঘরবাড়ি আছে সব ভেঙে গেছে।
এদিকে ফেনী সদর উপজেলার কাজিরবাগ ইউনিয়নে বিভিন্ন গ্রামের নিচু এলাকা এখনও পানিবন্দি রয়েছে।
মধ্যম কাজিরবাগ গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের অন্তত ৩০টিরও বেশি মাটির ঘর বন্যার পানিতে একেবারে ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গ্রামের কালু চন্দ্র পাল জানান, বন্যায় তার থাকার ঘর, রান্নাঘর একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। তিনি একটি ওষুধের দোকানে কাজ করে পরিবার চালাতেন। থাকার সহায়-সম্বল হারিয়ে তিনি এখন অনেকটা নিঃস্ব।
গ্রামের লক্ষ্মী চক্রবর্তীকে দেখা গেছে, বিধ্বস্ত রান্না ঘরের মাটি খুঁড়তে। তিনি বলেন, “বৃহস্পতিবার রাতে যখন পানি ঢুকছিলো তখন দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। রান্না করা ভাতগুলো খেতে পারিনি। আজ মাটি খুঁড়ে হাড়ি-পাতিল উদ্ধার করতে যেয়ে পাতিল ভর্তি নষ্ট ভাত দেখতে পেলাম।”
একই গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব মিলন চন্দ্র দে কোদাল দিয়ে ধসে পড়া ঘরের মাটি সরাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, “ছেলেমেয়ে নিয়ে পাঁচজনের সংসার। ঘরে পানি উঠায় পাশের তিনতলা বিল্ডিংয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। গত কয়েকদিনে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটিয়েছি। ঘর ঠিক করার টাকা পাব কোথায়?”
গ্রামের বিধান চন্দ্র পাল, রাজীব চন্দ্র পাল, ঝুলন চন্দ্র পাল, অমল পাল, কৃষ্ণ বণিক, প্রিয় লাল বণিকের মাটির ঘরগুলোরও একই দশা। তারাও হারিয়েছেন সর্বস্ব।
জেলায় ১৭ জনের মৃত্যু
ফেনীর জেলা প্রশাসক মোছাম্মৎ শাহিনা আক্তার বুধবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (এসবি) তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় জেলায় ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। জেলায় সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুল ইসলাম কমল বলেন, উপজেলায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এটি নিরূপণে কাজ চলমান রয়েছে। প্রতিটি বিভাগকে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে তালিকা দ্রুত তার কার্যালয়ে পাঠাতে বলা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, উপজেলায় কতজন নিহত হয়েছেন এই তথ্য এখনো নিরূপণ করা হয়নি। এই উপজেলায় ত্রাণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
আরও পড়ুন:
বন্যা: ফেনীতে কলার ভেলায় লাশ, সঙ্গে চিরকুট
ফেনী হাসপাতালে মোমের আলোয় ডেলিভারি, বেড়েছে সাপেকাটা রোগী
স্রোতের মুখে বাঁচতে পারবেন ভাবেননি, এখন ভবিষ্যতের ভাবনায় কপালে ভাঁজ
ঘরে ফিরে দেখেন সব শেষ, ত্রাণের জন্য রাস্তায়
অজানা দুশ্চিন্তায় ফিকে বন্দিদশা কাটার স্বস্তি
বানের পানি মাড়িয়ে হেঁটে দুই দিনে ভাগ্নের কাছে মামা
বন্যায় ৪৬২ কিলোমিটার সড়কের ক্ষতি
ফেনীতে পানিবন্দি এক লাখ মানুষ, স্বজনদের খোঁজ পেতে মরিয়া
বিদ্যুৎ-মোবাইল-নেটহীন ফেনী, পানিবন্দি ৪ লাখ মানুষ
মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন ফেনীর অর্ধেক মানুষ
ভয়াবহ বন্যায় বিচ্ছিন্নপ্রায় ফেনী, মহাবিপদে সাড়ে তিন লাখ মানুষ
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৭ কিলোমিটার প্লাবিত, চালকরা আতঙ্কে
বন্যা: ফেনীতে ২০০ গ্রাম প্লাবিত, প্রায় দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি